কিছুদিন আগে সুপ্রিম কোর্ট এক জনস্বার্থ মামলার শুনানিতে উদ্বেগের সাথে বলেছিল, বিনামূল্যে পাইয়ে দেওয়া, ভোটের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলির খয়রাতি বিপজ্জনক৷ কোর্ট বলেছে, ভারতে দারিদ্র রয়েছে, তাই ক্ষুধার্তদের খাদ্য দেওয়ার মতো কর্মসূচি প্রয়োজন৷ কিন্তু খয়রাতির রাজনীতি বন্ধ করা প্রয়োজন৷ বিজেপি, কংগ্রেস সহ আপ, তৃণমূল, সিপিএম, ডিএমকে, বিজেডি–র মতো ভোটসর্বস্ব দলগুলির নেতারা ভোটের সময় নানা জিনিস ও পরিষেবা বিনামূল্যে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন এবং নির্বাচনের আগে নানা রকম খয়রাতিও তারা করে থাকেন৷ এরই সমালোচনা করতে গিয়ে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এন ভি রমনার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বলে, কল্যাণমূলক কর্মসূচি আর বিনামূল্যে বিতরণ বা খয়রাতি এক বিষয় নয়৷
বিষয়টিকে একটু তলিয়ে ভাবা দরকার৷ সাধারণত পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন ও উদারিকরণের সমর্থক অর্থনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকরা জোর গলায় প্রচার করে থাকেন– জনগণকে ভর্তুকি দিতে গিয়েই সরকারের রাজকোষ ঘাটতি বাড়ে৷ অতএব শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল ইত্যাদির জন্য সরকারি বরাদ্দ কমাও৷ তেল-গ্যাস-পরিবহণ ভর্তুকি বন্ধ কর৷ পুঁজিবাদী সরকারগুলির মন্ত্রী-আমলারা এই মতেরই সমর্থক৷ তাঁরাও জনকল্যাণে খরচ ছাঁটাই, ভর্তুকি কমানোর নীতি মেনেই বাজেট করেন৷ বর্তমান ভারতে তেল-গ্যাসে ভর্তুকি শূন্য৷ শিক্ষা স্বাস্থ্যে সরকারি খরচ যৎসামান্য৷ পানীয় জলেও কর বসছে বহু জায়গায়৷ তবু বারবার এই প্রশ্নটা উঠছে কেন?
সাম্প্রতিক বাজেটে কেন্দ্রীয় সরকার সামাজিক উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ অনেকখানি কমিয়ে দিয়েছে৷ এর ফলে প্রাপ্য নানা সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হবে৷ কিন্তু সরকার যে কথায় কথায় বলে চলেছে, সামাজিক উন্নয়নে খরচ করার মতো টাকা তার হাতে নেই, তার কারণটা কী? এর উদ্দেশ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি সহ উন্নয়নমূলক ক্ষেত্রগুলিতে সরকারি বরাদ্দ ছাঁটাই করে এসবের পরিকাঠামো দুর্বল করে দেওয়া, যাতে এই সব সরকারি পরিষেবা সম্পর্কে জনগণ আস্থা হারায় এবং সেই সুযোগে বেসরকারি পুঁজি অবাধে তার সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারে, তার ব্যবস্থা করে দেওয়া৷ নানা ক্ষেত্রে সরকার যে নামমাত্র ভর্তুকি এতদিন দিত, তা ক্রমাগত তুলে নেওয়া হচ্ছে৷ দেশ জুড়ে গরিব-মধ্যবিত্তের জন্য সস্তায় খাদ্যদ্রব্য দেওয়ার যে রেশন ব্যবস্থা, তাতেও ভর্তুকি তুলে দিয়েছে সরকার৷ খাদ্য নিরাপত্তা আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নীতি আয়োগের সুপারিশ, রেশনে খাদ্যে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে হবে৷ সেই সুপারিশ মেনে জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি থেকে সরকার হাত গুটিয়ে নিচ্ছে৷ অথচ ভোটারদের প্রলুব্ধ করতে টিভি, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, সাইকেল প্রভৃতি বিনামূল্যে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছেন নেতারা৷ কখনও নগদ অর্থ দিয়ে জনসাধারণের মনে নিজেদের স্থান পাকা করে নিতে চান তারা৷ অভাবি মানুষেরা এই প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেন৷
কৃষি, খাদ্য সরবরাহ, বিদ্যুৎ ইত্যাদি ক্ষেত্রকে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে রাখতে জনসাধারণের দেয় করের টাকা থেকেই কিছু কিছু ভতুর্কি দেয় সরকার৷ এই ভর্তুকি দেওয়ার দায়ও কেন্দ্র সরকার ঠেলে রাজ্যের দিকে, রাজ্য সরকার ঠেলে কেন্দ্রের দিকে৷ এনরেগার মতো প্রকল্পে গ্রামীণ মানুষকে কিছু কাজ দেয় কেন্দ্রীয় সরকার৷ সেই প্রকল্পেও এ রাজ্যের বকেয়া ৭ হাজার কোটি টাকা৷ ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’–এর নামে রাজ্য সরকার কিছু নগদ অর্থ দেয় মহিলাদের একাংশকে৷ এগুলির কোনওটাই কি সরকার জনগণের প্রয়োজনের কথা ভেবে দেয়, নাকি আসলে এই সব প্রকল্পগুলো না দিলে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা এতটাই তলায় নেমে যাচ্ছে যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চাকাটাই মন্দার গর্তে আটকে যেতে বসেছে৷ সেটা যাতে ধীরে হলেও গড়াতে পারে সে জন্য কিছু অনুদান ছুঁড়ে দিয়ে কোনও রকমে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখারই ব্যবস্থা এগুলি৷
মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন বজায় রাখতে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো অপরিহার্য ও বুনিয়াদি ক্ষেত্রের সুযোগ সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে রাখার ব্যবস্থা করা সরকারের অবশ্যকর্তব্য, অথচ এগুলি থেকে দ্রুত হাত গুটিয়ে নিচ্ছে সরকার৷ এখানেও তাদের যুক্তি, সরকারি তহবিলে টাকার অভাব৷ তা হলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি যারা বিপুল সম্পদ এবং অর্থের মালিক, যা এমনকি করোনা অতিমারির সময়েও অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে, তাদের কেন সরকার জল, জমি, বিদ্যুৎ, করে বিপুল ছাড় দিয়ে চলেছে৷ সরকারের যদি টাকার অভাব সত্যিই হয়ে থাকে তবে তো বরং সেই অভাব মেটাতে তাদের উপরই কর বসানো দরকার৷ দেখা যাচ্ছে, দেশের ১০ জন সবচেয়ে ধনী বহু-কোটিপতির উপর একবারের জন্য মাত্র ৫ শতাংশ কর বসালেই ১.৩ লক্ষ কোটি টাকা সংগ্রহ করা যেতে পারে৷
কর বসানো দূরের কথা, কর্পোরেট কোম্পানিগুলিকেই কর ছাড় দিচ্ছে সরকার৷ কর্পোরেটকে করছাড় সরকারের খয়রাতি নয় কেন, এই প্রশ্ন উঠছে স্বাভাবিকভাবেই৷ প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে সরকার কর্পোরেট কোম্পানিগুলিকে রাজস্ব ছাড় দেয়৷ সিএজি রিপোর্টে ২০১০-১১ সালে মোট ছেড়ে দেওয়া রাজস্বের পরিমাণ ছিল আদায় হওয়া প্রত্যক্ষ কর রাজস্বের ২১ শতাংশ৷ ওই রিপোর্ট বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে এই অনুপাতটি এসে দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশে৷ দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালে সরকার কর্পোরেট কর কমিয়ে দেওয়ায় পরবর্তী দু’বছরে সরকারের বার্ষিক ৯০ হাজার কোটি টাকা করে কম আয় হয়েছে৷ কর্পোরেট কোম্পানিগুলিকে এ ভাবেই খয়রাতি করছে সরকার। এ ছাড়াও সরকার নানা কর্পোরেট কোম্পানিকে করের বিশেষ হার, কর ছাড়, ডিডাকশন, রিবেট, দেরিতে কর দেওয়ার সুবিধা ইত্যাদি দিয়ে চলেছে৷ রফতানি করলে, পরিকাঠামো তৈরি করলে, বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালালে এবং উন্নয়নের কাজ করলে কর্পোরেট সংস্থাকে কর ছাড় দেয় সরকার৷ এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটেও এ সব ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে৷ এই কর ছাড় দেওয়াকে বলা হয় পরোক্ষ ভর্তুকি৷ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভর্তুকি মিলিয়ে কর্পোরেট সংস্থাগুলি সরকারের থেকে বিপুল পরিমাণ সুবিধা আদায় করে চলেছে৷ এর সাথে এখন ‘সোসাল রেসপন্সিবিলিটির’ নামে কর্পোরেট সংস্থাগুলি সরকারের থেকে মোটা টাকা ছাড় আদায় আইনসঙ্গত করছে৷ সম্প্রতি এ রাজ্যের সরকার কলকাতার এক শিক্ষা ব্যবসায়ীকে তাঁর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৪ কোটি টাকার কর মকুব করেছে৷
প্রশ্ন হল, খয়রাতি করার কী দরকার, যদি সাধারণ মানুষের হাতে কাজ থাকে, কাজের ন্যায্য মজুরি থাকে? তাহলে তো মানুষ শ্রমের বিনিময়ে মজুরি পেয়ে মর্যাদার সঙ্গে জীবন কাটাতে পারতেন৷ সরকার যদি কর্মহীন মানুষদের কাজ দেয়, বেকার যুবকদের চাকরি দেয়, তাহলে তাদের হাতে দয়ার দান ‘অনুদান’ তুলে দিতে হয় না৷ শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খাদ্য-এর মতো গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি সাধারণ মানুষকে সরকার দিলে খয়রাতি করে মানুষের মন ভোলাতে হয় না৷ তা এই দলগুলি করবে না৷ কারণ, এই অজ্ঞ, গরিব, খেটে খাওয়া মানুষগুলিকে তা হলে অনুদানের ফাঁদে জড়িয়ে ফেলা যাবে না৷ এই মানুষগুলি যে তাদের ভোটের বোড়ে এদের অজ্ঞানতা, অ-সচেতনতাই যে এদের মসনদে বসার পুঁজি।