জেএনইউ দেখাল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই পারে অন্যায় বিধিনিষেধ রুখে দিতে

স্বাধীন চিন্তা ও স্বাধীন মতামত সব সময়ই শাসকদের মাথাব্যথার কারণ। সব শাসকই চায় এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে। বিজেপি শাসন ক্ষমতায় আসার পর এই নিয়ন্ত্রণ ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে। প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের একাধিপত্য বজায় রাখতে নিজেদের পেটোয়া লোকদের ক্ষমতায় বসাচ্ছে, প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা তারা খর্ব করছে, জারি করছে নিত্য-নতুন বিধি-নিষেধ। তারই সাম্প্রতিক নজির দেখা গেল জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সেখানকার কর্তৃপক্ষ শৃঙ্খলা ও আচরণবিধির নামে চালু করেছিল ‘জেএনইউ রুলস’, যা সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের মেনে চলতে বলা হয়েছিল। কর্তৃপক্ষের ফতোয়া ছিল, ছাত্ররা ধরনায় বসলে ২০ হাজার, ভাঙচুরের অভিযোগ হলে ৩০ হাজার, ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ এলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। অনশনে বসলে বা জমায়েত করলেও মোটা টাকার জরিমানা গুনতে হবে। প্রয়োজনে তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের বহিষ্কার করতে পারবেন।

এই নিয়মের বিষয়ে একজিকিউটিভ কাউন্সিল (ইসি) এবং অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল সদস্যরা পর্যন্ত জানিয়েছেন তাঁদের অধিকাংশই কিছুই জানতেন না। একাধিক ইসি সদস্য মিটিংয়ে হঠাৎ এই বিষয়টি ওঠায় ‘ডিসেন্ট নোট’ অর্থাৎ আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী ছাত্রদের স্বার্থ যেখানে জড়িত, তেমন বিষয়ের আলোচনা প্রথমে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে করতে হবে। তা ছাড়া ইসি মিটিংয়ের অ্যাজেন্ডাতে স্পষ্ট করে বিষয়টি রাখা হয়নি। ফলে বিধিনিষেধের এই সার্কুলারটাই বেআইনি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গায়ের জোরে সেটি জারি করে দেয়।

জেএনইউ কর্তৃপক্ষ ভেবেছিলেন সকলকে তাঁরা এই নিয়ম মানতে বাধ্য করতে পারবেন। কিন্তু সে উদ্দেশ্য তাঁদের সফল হয়নি। এরকম একটা স্বৈরাচারী নিয়মের প্রতিবাদে স্বাভাবিকভাবেই ছাত্র-শিক্ষক-গবেষক সকলে একযোগে রুখে দাঁড়ান। এই কালা-নিয়মের প্রতিলিপি, কুশপুতুল পুড়িয়ে বিক্ষোভ দেখান, একের পর এক সভা-সমাবেশ করেন। প্রবল ক্ষোভের সামনে পড়ে কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত ফতোয়া প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। উপাচার্য শান্তিশ্রী ডি পণ্ডিত বললেন, ‘আমি ছিলাম না। সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে আমি জানতে পারলাম। আমি এই নিয়মবিধি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।’ বলা বাহুল্য, ঐক্যবদ্ধ ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনের চাপেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রত্যাহার করতে হয়েছে এই অন্যায্য নিয়মবিধি। ছাত্র-শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শিকল পরানোর উদ্দেশ্যে এই ষড়যন্ত্রের পিছনে থাকা আধিপত্যবাদী মন্ত্রী-নেতাদের মাথাও স্বাভাবিকভাবেই হেঁট হয়েছে।

সম্প্রতি মোদী জমানার সমালোচনামূলক বিবিসি ডকুমেন্টারি দেখানোর পরই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদ আন্দোলনকে দমন করতে এই ফতোয়া জারি করে কর্তৃপক্ষ। কেন্দ্রের অঙ্গুলি হেলনেই যে কর্তৃপক্ষের এই নির্দেশ জারি তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। তাঁদের লক্ষ্য ছাত্র আন্দোলন ও ক্যাম্পাস রাজনীতি বন্ধ করা। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা এর আগেও বহুবার ধুয়ো তুলেছেন দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জেএনইউ দেশের মধ্যে দেশ তৈরি করছে। আসলে তাঁরা প্রতিবাদের সমস্ত কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করতে চান। তাই পেটোয়া প্রশাসক, উপাচার্যদের দিয়ে এরকম নিত্য-নতুন বিধি-নিষেধ জারির অপচেষ্টা। কিন্তু ছাত্র-শিক্ষকরা এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছেন।

আগামী দিনে যতই বিজেপির অপশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজ মুখ খুলবে ততই দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে এরকম হাজারো কালা-কানুন, দানবীয় নিয়ম চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলবে। জেএনইউ-এর আন্দোলনের এই সাফল্য দেখিয়ে দিল ভবিষ্যতেও একইরকম ভাবে সেই সমস্ত কালা-কানুনকে গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ ব্যর্থ করে দেবে।