কীসের প্রয়োজনে আরএসএস–এর সেনাবাহিনী

70 year 27 Issue, 23 Feb 2018

 

 

আর এস এস–প্রধান মোহন ভাগবত ২০১৫ সালে মোদি সরকার প্রদত্ত জেড প্লাস নিরাপত্তাপ্রাপ্ত ভিভিআইপি৷ সম্প্রতি মুজফফরনগরের এক সভায় তিনি আস্ফালন করে সংঘের সেনাবাহিনীকে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছেন৷ তাঁর কথায় সেই সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে অনেক বেশি তৎপর৷ অর্থাৎ, কার্যত তিনি স্বীকার করেছেন আর এস এস সমান্তরাল সেনাবাহিনী পোষে৷ এর দ্বারা তাঁর এবং সামগ্রিকভাবে সংঘ পরিবারের চূড়ান্ত স্বৈরাচারী মনোভাব আবারও প্রকাশ্যে এল৷

সংঘ–প্রধানের এই স্বৈরাচারসুলভ আচরণের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ৷ গোটা দেশজুড়ে প্রতিবাদের চাপে পড়ে কিছুটা আমতা আমতা করেই আরএসএস–বিজেপির বিভিন্ন স্তরের নেতারা এখন তাঁদের শীর্ষ নেতার বক্তব্যের ‘আসল মানে’ বোঝাতে ব্যস্ত৷ কিন্তু আর এস এসের এই সেনাবাহিনী কোন কাজে লাগে? তা কি জনগণের আপৎকালীন প্রয়োজনে কাজে লাগার জন্য তৈরি? না৷ দেশের মানুষের অভিজ্ঞতা আর এস এসের সেনাবাহিনী কাজে লাগে দাঙ্গায়, কাজে লাগে সাম্প্রদায়িক হানাহানি, বিদ্বেষের বিষ ছড়াতে৷ ১৯২৫ সালে জন্মমুহূর্ত থেকেই আপাদমস্তক সাম্প্রদায়িক এই সংগঠনটি পেশাদার সেনাবাহিনী তৈরি করে ভারতবর্ষকে একটি ফ্যাসিবাদী হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে৷

দেশি–বিদেশি বিভিন্ন পুঁজিপতিদের এবং তাদের মদতপুষ্ট নানা সংগঠনের কাছ থেকে যথেচ্ছ টাকা নিয়ে এবং সেই টাকার লোভ দেখিয়ে দেশের বেকার যুবকদের একত্রিত করে ইতালিতে ১৯১৯ সালে পেশাদার সশস্ত্র সৈন্যবাহিনী তৈরি করেছিলেন মুসোলিনি৷ জাতি–বর্ণ–ধর্মবিদ্বেষের ভিত্তিতে বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া সেই হিংস্র বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে, জাতীয়তাবাদের নাম করে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং বিশেষ ভাবে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে প্রবল ঘৃণা ছড়িয়ে, লাগাতার তাঁদের উপর গণহত্যা চালিয়ে, যুক্তিশীল সমাজের উপর একের পর এক নৃশংস আক্রমণ নামিয়ে এনে মুসোলিনি ইতালির ক্ষমতা দখল করেছিলেন৷ ১৯২২ সালে কায়েম করেছিলেন ফ্যাসিবাদ৷ এতে উৎসাহিত হয়েছিলেন ভারতের ‘হিন্দুত্ববাদী’রা৷ ব্রিটিশ শাসকের কাছে মুচলেকা দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে সরে এসে সাভারকার ১৯২৩ সালে ‘হিন্দুত্ব’ নামে একটি বই লেখেন৷ ধর্মীয় ঘৃণা ছড়াবার জন্য তাতে প্রচার করেন– ভারতবর্ষে বসবাসের অধিকারী শুধুমাত্র হিন্দুরা৷ ১৯২৫ সালে তৈরি হয় ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ’৷ উল্লেখ্য, এ বছরই হিটলার প্রকাশ করেন ‘মাইন কাম্ফ’৷ এই বইয়ের মাধ্যমে সুচতুর ভাষায় প্রবল জাতিদম্ভের হিংস্র মানসিকতা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হয়৷ উৎসাহী সংঘকর্তারা ঘোষণা করে– ভারতের শত্রু ব্রিটিশ শাসকরা নয়, মুসলিমরা৷ দেশে তখন অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ক্রমশ তীব্র হচ্ছে৷ কিন্তু, স্বঘোষিত ‘দেশপ্রেমিক’ হিন্দুত্ববাদীরা ব্রিটিশবিরোধী কোনও আন্দোলনে না গিয়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াতেই ব্যস্ত থাকলেন৷ ১৯৩১ সালে বি এস মুঞ্জে নামে তাঁদের এক নেতা ইতালিতে গিয়ে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট বাহিনী গড়ার কায়দা–কানুন শিখে এসে একই পদ্ধতিতে সামরিক স্কুল খোলেন, অনতিবিলম্বে যা সংঘের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়৷ এই সময়ে ১৯৩৩ সালে মুসোলিনি–মডেল অনুসরণ করে নাৎসি বাহিনী গড়ে জার্মানিতে ক্ষমতা দখল করল হিটলার৷ আর এস এস–এর উৎসাহ অনেক গুণ বেড়ে গেল৷ ১৯৩৮ সালে তাদের এক গুরু গোলওয়ালকর বই লিখলেন ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’৷ তাতেও ধর্মের নামে প্রবল বিদ্বেষ ছড়িয়ে বলা হল– অ–হিন্দুরা যদি এ–দেশে থাকতে চায় তা হলে তাদের থাকতে হবে হিন্দুদের অধীনেই৷ তাঁরা কোনও নাগরিক অধিকারও পাবেন না৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ১৯৪২ সালে এদেশে উত্তাল গণআন্দোলনের সময়েও, যখন নেতাজি জার্মানিতে যুদ্ধবন্দী ভারতীয়দের নিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখন, ‘হিন্দুত্বপন্থী’দের প্রতি ‘বীর’ সাভারকারের নির্দেশ– যে যেখানে আছেন সেখানে লেগে থেকে ব্রিটিশ সরকারের সাথে সহযোগিতা করুন৷ এ সময়ে সাভারকারের অন্যতম স্লোগান ছিল ‘রাজনীতির হিন্দুকরণ এবং হিন্দুধর্মের সামরিকীকরণ’৷

আর এস এস আজও মুসোলিনি–হিটলারের সভ্যতাবিরোধী নীতি নিয়ে চলছে৷ জাতি–বর্ণ–ধর্মের নামে বিদ্বেষমূলক বর্বর ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রগঠনের ষড়যন্ত্র আজ মোদি সরকারের সৌজন্যে আরও বেশি করে চালাচ্ছে তাঁরা৷ যে কোনও অজুহাতে শিশু–কিশোরদের হাতেও অস্ত্র তুলে দিচ্ছে৷ এই অপকর্মকে উৎসাহ দিতেই আর এস এস–এর ‘সেনাবাহিনী’ নিয়ে মোহনভাগবতের দরাজ সার্টিফিকেট প্রদান৷