‘‘ফ্যাসিবাদ হল অধ্যাত্মবাদ ও বিজ্ঞানের এক অদ্ভূত সংমিশ্রণ। এতে জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নামে একই সঙ্গে থাকে ফ্যাসিবাদী রাষ্টে্রর অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিকে বাড়িয়ে তোলার স্বার্থে বিজ্ঞানের কারিগরি দিককে গ্রহণ করার কর্মসূচি এবং সমস্ত রকম অবৈজ্ঞানিক ধর্মীয় উন্মাদনা ও ভাববাদী ভোজবাজিকে (idealistic jugglery) শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং বর্তমান সমাজের আনুষঙ্গিক কুফলগুলি থেকে পরিত্রাণের সর্বরোগহর ঔষধ হিসাবে পরিবেশন করার চেষ্টা। এই ভাবে ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতি হল বৈজ্ঞানিক বা সত্যনিষ্ঠ চিন্তার সাথে অলীক চিন্তার এক বিচিত্র সংমিশ্রণ। এতে প্রকৃতি জগতের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, অন্য দিকে সামাজিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণায় অলীক চিন্তাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এর উদ্দেশ্য হল মানুষের চিন্তাপ্রক্রিয়াকে কার্য-কারণ সম্পর্ক যাচাই-এর বৈজ্ঞানিক পথ থেকে অন্ধবিশ্বাস, পূর্বধারণা ও কুসংস্কারের চোরাপথে চালিত করা এবং তার দ্বারা শেষপর্যন্ত সামাজিক ক্রিয়া সম্পর্কে অবজ্ঞা সৃষ্টি করা। অবৈজ্ঞানিক, অলীক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফ্যাসিবাদ সমাজবিজ্ঞানের শ্রেণিসংগ্রামের নিয়মকে সমাজ পরিবর্তনের চালিকাশক্তি হিসাবে দেখতে অস্বীকার করে এবং তার পরিবর্তে শ্রেণিসংহতি ও শ্রেণিসমন্বয়ের তত্ত্বকে সৃষ্টি করে। এই ভাবে ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতিতে প্রাধান্য পায় শ্রেণিবহির্ভূত অথবা শ্রেণিঊর্ধ্ব চিন্তাভাবনা।
জাতীয় উন্মাদনা সর্বদাই বুর্জোয়াদের হাতে একটি শক্তিশালী অস্ত্র– যার দ্বারা তারা জনমানসকে শ্রেণিসংগ্রামের আদর্শ এবং সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তোলে। ফ্যাসিস্টরা নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে এর পূর্ণ সদব্যবহার করে। এ কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, বুর্জোয়ারা যে প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদ প্রচার করে, তা এবং জনসাধারণের দেশপ্রেম, এ দু’টি এক জিনিস নয়। বিষয়বস্তু ও চরিত্র, দু’দিক থেকেই এরা ভিন্ন। জনসাধারণের দেশপ্রেমের সঙ্গে সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শের কোনও বিরোধ নেই, বরং বর্তমান যুগে কেউই প্রকৃত দেশপ্রেমী হতে পারে না, যদি না সে সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শে বিশ্বাসী হয়। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন। তা ছাড়া যেখানে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ বিশ্ব বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলনমাত্র এবং মানুষের দেশপ্রেমের আবেগকে বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থে আত্মসাৎ করার লক্ষ্যে শোষকের হাতে হাতিয়ার, সেখানে সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শের দ্বারা পরিচালিত দেশপ্রেমের ধারণা পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ব্যবস্থার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে শোষিত জনগণের হাতে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। যেখানে সমাজপ্রগতির পথে বাধা যে পুরাতন-পচাগলা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থান্বেষী বুর্জোয়া উদ্দেশ্য থেকে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ উদ্ভূত হয়, সেখানে সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শে বলীয়ান দেশপ্রেম মানুষের প্রতি প্রকৃত ভালবাসার উৎস থেকে উৎসারিত হয় এবং সমাজপ্রগতির পথে সমস্ত বাধাকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করার লক্ষে্য পরিচালিত হয়। অতএব ফ্যাসিবাদ মানুষের প্রকৃত দেশপ্রেমের অনুভূতিকে সহ্য করতে পারে না।
শ্রেণিসংহতি, শ্রেণিঐক্য, শ্রেণিঊর্ধ্ব জাতীয় স্বার্থের যে ধারণাকে ফ্যাসিবাদীরা প্রচার করে, সাধারণ মানুষের সামনে তাকে তারা এক বিশেষীকৃত রূপে তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করে। তাই ফ্যাসিবাদ কখনও কখনও অতিমানবের ধারণার প্রচার করে, যে অতিমানব হচ্ছে জাতীয় ইচ্ছা ও স্বার্থের মূর্তরূপ। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে, পুঁজিবাদ তার অধিকার প্রতিষ্ঠার সূচনাপর্বে যে ঈশ্বরচিন্তা ও মায়াবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েছিল, আজ ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার দিকেই আবার ঝুঁকছে এবং তাকে অবলম্বন করেই টিকে থাকার চেষ্টা করছে।”
(সময়ের আহ্বানঃ রচনাবলি, দ্বিতীয় খণ্ড)