রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রবল সংকটের মধ্যে ১৬ ফেব্রুয়ারি হতে চলেছে ত্রিপুরা বিধানসভার নির্বাচন৷ পাঁচ বছর আগে সিপিএমকে হারিয়ে রাজ্যে সরকারি ক্ষমতার মসনদ দখল করেছিল বিজেপি৷ ২৫ বছর ধরে একটানা সিপিএমের পুঁজিপতি তোষণকারী, জনবিরোধী অবাম নীতির শাসনে তিতিবিরক্ত ত্রিপুরার মানুষ সে সময় যে কোনও মূল্যে সিপিএমকে গদি থেকে হঠাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল৷ সে সময় বিরোধী হিসাবে ত্রিপুরার রাজনীতিতে ছিল কংগ্রেস, বিজেপি ছিল নিতান্ত নগণ্য শক্তি৷ সিপিএম সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের তীব্র ক্ষোভ যাতে আন্দোলনের পথে চলে না যায়, তার জন্য শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি খোঁজ করছিল এমন একটা নির্বাচনী বিকল্পের, যারা তাদেরই সেবক হিসাবে কাজ করে যাবে এবং ভোটে সরকার পাল্টে জনগণের মধ্যে ওঠা ক্ষোভকেও কিছুটা চাপা দেওয়া যায়৷ ছন্নছাড়া, দুর্বল কংগ্রেসকে দিয়ে এই কাজ তাদের চলত না৷ ত্রিপুরা রাজ্যে বিজেপি যতই নগণ্য শক্তি নিয়ে থাকুক, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তারা ইতিমধ্যেই একচেটিয়া মালিকদের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রমাণ করেছে৷ তাই সে সময় সমস্ত আনুকূল্য বিজেপির প্রতি ঢেলে দিয়ে বুর্জোয়ারা বিজেপিকেই সিপিএমের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে তুলে ধরে ব্যাপক ভোটে জিতিয়ে সরকারে বসিয়েছিল৷ সে সময় সিপিএম, কংগ্রেস, এমনকি কংগ্রেস ভাঙিয়ে অল্প কিছুদিন আগে ত্রিপুরায় শক্তিবৃদ্ধি করা তৃণমূল কংগ্রেস থেকেও দলে দলে নেতা কর্মীরা ভিড়েছিলেন বিজেপিতে৷
কিন্তু অতি অল্প দিনের মধ্যেই বিজেপির চরম জনবিরোধী, সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিস্ট স্বৈরতান্ত্রিক মুখটা মানুষের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়েছে৷ সরকারে বসার কিছুদিনের মধ্যেই যেভাবে ত্রিপুরা জুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে জমা হওয়া ক্ষোভের আগুন ধূমায়িত হচ্ছে তার আঁচ থেকে বাঁচতে গত বছর মে মাসে বিজেপি সে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী বদল করেছে৷ তাতে অপশাসনের ছবির কোনও বদল হওয়ার কথা ছিল না, হয়ওনি৷ আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, মদ–মাদকের অবাধ কারবার, মহিলাদের নিরাপত্তা বলতে কোনও কিছুই না থাকা, এ সবের সাথে যুক্ত হয়েছে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার লজ্জাজনক অবনতি৷ বিজেপির বাইক বাহিনীর দাপাদাপি, তোলাবাজি, বিরোধীদের ঘরবাড়ি ভাঙা, লুঠপাট পুলিশের সাহায্যেই অবাধে চলছে৷ বিজেপির ক্রিমিনাল বাহিনী ত্রিপুরা জুড়ে সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করেছে৷ গণতন্ত্র কথাটাই সেখানে প্রহসনে পরিণত৷ পাশাপাশি বিজেপি সর্বক্ষণ ধর্ম-জাত-ভাষার ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷
ত্রিপুরা জুড়ে ছড়িয়ে আছে ১৯টি আদিবাসী জনজাতি৷ এরা ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকে অর্থবান শ্রেণির চরম শোষণের শিকার৷ এমনকি সিপিএম শাসনেও তারা জনজাতিগুলির মানুষের আর্থিক, সামাজিক উন্নয়নের জন্য কিছুই করেনি৷ জনজাতিভুক্ত মানুষের সার্বিক উন্নতির ব্যবস্থা করে তাদের জীবনযাত্রাকে সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসা, সমস্ত জনজাতির মানুষের অন্য সমস্ত ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর সাথে অবাধ মেলামেশার পরিবেশ তৈরি করে তাদের অগ্রগতির পথে নিয়ে যাওয়া– এর কোনও কিছুই কংগ্রেস এবং তারপর সিপিএম শাসকরা করেনি৷ শাসকদের চোখে জনজাতির মানুষ কেবলমাত্র ভোটব্যাঙ্ক হিসাবেই কদর পেয়েছে৷ সে জন্য ক্রমাগত জনজাতির মানুষকে তারা ঠেলে দিয়েছে সংকীর্ণ এবং বিচ্ছিন্ন জাতিবাদী মানসিকতার দিকে৷ এর সুযোগ নিয়ে আঞ্চলিক বুর্জোয়াদের একাংশ এই জনজাতির মানুষের মধ্য থেকে অল্প কয়েকজন উচ্চাকাঙক্ষী ব্যক্তিকে বেছে নিয়ে তাদের জনজাতিগত পরিচয়কে কাজে লাগায়৷ যাতে তারা জনজাতিদের আপনজন সেজে প্রতিষ্ঠিত ভোটবাজ দলগুলির শরিক হিসাবে ক্ষমতার ভাগ পেতে নির্বাচনী ক্ষেত্রে ফয়দা এনে দিতে পারে তার ব্যবস্থা করে৷ আইপিএফটি (ইন্ডিজেনাস পিপলস ফ্রন্ট অফ ত্রিপুরা), তিপ্রা মথা (ত্রিপুরা ইন্ডিজেনাস প্রোগ্রেসিভ রিজিওনাল অ্যালায়েন্স) ইত্যাদি সংগঠনও এই পথেই গড়ে উঠেছে৷ এরা দরিদ্র আদিবাসী জনগণের মসীহা হিসাবে নিজেদের তুলে ধরে৷ আইপিএফটি এতদিন বিজেপির সাথে জোট করে চলছিল৷ এখন শোনা যাচ্ছে তিপ্রার প্রধান তথা পূর্বতন রাজ পরিবারের সদস্য ও কংগ্রেস এমপি প্রদ্যোৎ মাণিক্য দেববর্মনের সাথে বিজেপির রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়েছে৷ কিছু দিন পরেই আবার তিপ্রা বিজেপির বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকরার অভিযোগ করেছে৷ এসইউসিআই(সি)-র সংগ্রামী বাম-ঐক্যের আহ্বানে কান না দিয়ে সিপিএম তার ভরসা খুঁজছে কংগ্রেসের মধ্যে৷ এই কংগ্রেসের অপশাসনের জন্য আগেই ত্রিপুরার মানুষ তাদের খারিজ করেছিল৷ কংগ্রেস এখন ত্রিপুরাকে দু’টুকরো করে তিপ্রাল্যান্ড গঠনের দাবি তোলা বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি তিপ্রা মথার সাথে জোটের চেষ্টা করছে৷ এই তিপ্রা আবার ‘গাছেরও খাব, তলারও কুড়াবো’ নীতি নিয়ে বিজেপির সাথে বোঝাপড়ার চেষ্টা করছে৷ এ দিকে নিজের দলের কাছ থেকে টিকিট না পেয়ে এক সিপিএম বিধায়ক ও কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি বিজেপির সাথে ভিড়েছেন৷ কোনও আদর্শ বা নীতি নয়, ক্ষমতাই এদের একমাত্র মাথাব্যথার বিষয়৷
এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপদের বিরুদ্ধে জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী বামপন্থী আন্দোলন গড়ে তোলা৷ নির্বাচনকেও দেখা দরকার সেই আন্দোলনের একটা অংশ হিসাবে৷ কিন্তু সরকারি গদি ছাড়া অস্তিত্বের সংকটে ভোগা সিপিএম যে কোনও উপায়ে গদি ফিরে পেতে মরিয়া৷ তারা তিপ্রার সাথেও বোঝাপড়ার দরজা খুলে রাখতে চায়৷ স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতার এই দড়ি টানাটানির মধ্যে পড়ে সাধারণ মানুষের বিশেষ কিছু পাওয়ার নেই৷ তাদের শোষণ যন্ত্রণার অবসান অনেক দূরের কথা, তা আরও বাড়া এবং দীর্ঘায়িত করার ব্যবস্থাই এতে হচ্ছে৷ যখন বাকি সমস্ত শক্তি ব্যস্ত নিজের নিজের লাভের হিসাব কষতে, তখন একমাত্র এসইউসিআই(সি) মার্ক্সবাদ লেনিনবাদ শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারাকে হাতিয়ার করে সংগ্রামী বামপন্থার ঝান্ডাকে তুলে ধরতে সচেষ্ট৷ এই লক্ষ্য থেকে দল নিজ সাংগঠনিক ক্ষমতার জোরে পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে৷ যতদিন না বুর্জোয়াদের ভোটসর্বস্ব গদির রাজনীতি সম্বন্ধে জনগণ সচেতনভাবে মোহমুক্ত হচ্ছে, বিপ্লবী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শোষণমূলক বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে তারা উপড়ে ফেলে দিতে তৈরি হচ্ছে, ততদিন বিপ্লবী দলকেও নির্বাচনে যেতে হয় জনগণকে মোহমুক্ত করার কর্মসূচি নিয়েই৷ এই লক্ষ্য থেকেই এস ইউ সি আই (সি) ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচনেও লড়াই করছে৷