পাশ–ফেল চালু করা নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের তরফে প্রবল গড়িমসি চলছে৷ জনমতের চাপ বুঝে মাঝেমধ্যে কিছু কথা ছুঁড়ে দেওয়া ছাড়া কাজের কাজ তারা কিছুই করছে না৷ কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৫ সাল থেকে বলা শুরু করেছে তারা পাশ–ফেল বিষয়টি চালু করার জন্য ভাবনাচিন্তা করছে৷ সর্বশেষ পর্যায়ে শিক্ষার অধিকার আইন (২০০৯) সংশোধনের জন্য শীতকালীন অধিবেশনে সংশোধনী আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা কার্যকর করেনি৷ কেন্দ্রের প্রস্তাব মেনে দেশের ২৪টি রাজ্য পাশ–ফেল দ্রুত চালু করার জন্য ২০১৫–’১৬ সালেই লিখিত মতামত জানিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু কেন্দ্রের বিজেপি সরকার একই টালবাহানা করে চলেছে– যা চরম জনস্বার্থবিরোধী৷
পাশাপাশি রাজ্য সরকারের ভূমিকাও সদর্থক নয়৷ বিভিন্ন সময়ে তীব্র আন্দোলন এবং বিগত জুলাই মাসে এসইউসিআই (সি)–র বাংলা বনধ–এর চাপের মুখে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী বলতে বাধ্য হয়েছিলেন– তাঁরা পাশ–ফেল চালুর পক্ষে৷ সেই মর্মে গত ২৪ নভেম্বর বিধানসভায় শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণাও করেছিলেন৷ তারপর গত ২২ ডিসেম্বর বিকাশ ভবনে শিক্ষামন্ত্রীর পৌরোহিত্যে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ সেখানেও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক প্রতিনিধি ও শিক্ষক সংগঠনের অধিকাংশ প্রতিনিধি পাশ–ফেল চালুর পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছিলেন৷ অতঃপর শিক্ষামন্ত্রী বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে দ্রুত কার্যকরী করার আশ্বাস দিয়েছিলেন৷ কিন্তু নতুন একটি শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়ে গেলেও শিক্ষামন্ত্রী তথা রাজ্য সরকার নীরব থেকে জনজীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে চলেছেন৷
বিগত ৩৮ বছর ধরে এ রাজ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় পাশ–ফেল প্রথা বিলুপ্ত৷ পরিণতিতে প্রাথমিক শিক্ষার চরম বেহাল অবস্থা৷ ২০১০ সাল থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল না থাকায় মাধ্যমিক শিক্ষাও চরম সংকটে নিমজ্জিত৷ পরিণতিতে সাধারণ ঘরের কোটি কোটি ছেলেমেয়ের জীবন বিপর্যস্ত৷ শিক্ষা–চাকরি ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রেই তারা চরম বঞ্চনার শিকার৷
দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে এ রাজ্যে এবং ৮ বছর ধরে সারা দেশে পাশ–ফেল বিহীন শিক্ষাব্যবস্থা চলছে৷ ফেলের ভয়ে ছেলেমেয়েরা স্কুলমুখী হতে চায় না– এ কথা আদৌ সত্য নয়, বরং পাশ–ফেল না থাকায় সরকারি স্কুলে শিক্ষার যে শোচনীয় হাল হয়েছে তার ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই সমস্ত স্কুলের শিক্ষার প্রতি আগ্রহটাই কমেছে এবং তার ফলে তাদের স্কুলে আসার আকর্ষণও কমে গেছে৷ ২০১২ সালের ৬ জুন দিল্লিতে শিক্ষামন্ত্রীদের সম্মেলনেও এই চিত্রের প্রতিফলন দেখা গেছে৷ যে সব রাজ্য ২০১০ সাল থেকে পাশ–ফেল তুলে দিয়েছিল, সেইসব রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীরা দৃঢ় গলায় অভিমত ব্যক্ত করেছেন (যেমন বিহার, অসম, ছত্তিশগড়, হরিয়ানা প্রভৃতি)পাশ–ফেল না থাকায় ছেলেমেয়েদের স্কুলমুখী করা যাচ্ছে না৷
ঠিক একইভাবে এই অভিমতও তাঁরা ব্যক্ত করেছেন– এর ফলে স্কুলছুটও ব্যাপক হারে বাড়ছে৷ যারা স্কুলে আসছে তাদেরও ধরে রাখা যাচ্ছে না৷ এই চিত্র পশ্চিমবঙ্গেও দেখা যাচ্ছে৷ এ রাজ্যে যেখানে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয় ৩২/৩৩ লক্ষ ছেলেমেয়ে, সেখানে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসে কতজন? ১১/১২ লক্ষ অর্থাৎ প্রায় দুই–তৃতীয়াংশ স্কুলছুট হয়ে যাচ্ছে৷ এর মধ্যে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরনোর আগেই প্রায় ৪৬ শতাংশ ড্রপ আউট হয়ে যাচ্ছে, বাকিটা মাধ্যমিক স্তরে৷ পাশ–ফেল থাকলে স্কুলছুট বাড়ে এ কথা যাঁরা বলছেন তাঁদের বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্ক কতটুকু তাতে সন্দেহ থেকেই যায়৷ কারণ বেসরকারি স্কুলে, যেখানে কঠোরভাবে পাশ–ফেল–এর বিষয়টি মানা হয়, সেখানে কি ছাত্রের অভাব ঘটছে? নাকি ছাত্র উপছে পড়ছে? কেন? কারণ অভিভাবক বা শিক্ষার্থী কেউই চায় না– কিছু না জেনে, কিছু না শিখে– শুধু পাশ করতে৷ তাই বিনামূল্যের সরকারি স্কুল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধুঁকছে, অথচ প্রচুর অর্থের বিনিময়ে বেসরকারি স্কুলে ভিড় উপছে পড়ছে, এ সত্য অস্বীকার করা যায় কি?
কেউ কেউ বলে থাকেন– যাঁরা পাশ–ফেল চাইছেন– তাঁরা নাকি ফেল করাতে উদগ্রীব৷ সত্যিই কি তাই? কেউ কি চান ফেল করাতে? শিক্ষক–ভিভাবক কেউই চান না, কোনও ছেলেমেয়ে ফেল করুক৷ কিন্তু ভাবতে হবে যে কোনও ভাবেই হোক পাশ সার্টিফিকেট পাওয়াই কি মুখ্য উদ্দেশ্য? কিছু শিখুক না শিখুক, কিছু জানুক না জানুক– শুধু পাশ করিয়ে দিলেই উন্নতি হবে? শিক্ষা তো একটা কঠিন কঠোর অধ্যবসায়ের বিষয়৷ সুদূর অতীতকাল থেকে শিক্ষার জন্য কী কঠোর সাধনাই না করতে হয়েছে আর আজকের দিনে জন্মের পর থেকে কোনও ছেলেমেয়ে যদি জানে, একবার স্কুলে নাম লেখালেই পাশ– তাহলে সেই কঠিন অধ্যবসায়ের মানসিকতা তার মধ্যে জন্মাবে কী করে? আর পাশ–ফেল বিহীন শিক্ষার মধ্য দিয়ে তরতরিয়ে অষ্টম শ্রেণির একটা পাশ সার্টিফিকেট মিলে গেলে তার মূল্য কী?
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার দৌলতে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র নাম লিখতে পারে না, পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র বাংলা বাক্য পড়তে পারে না, সাধারণ যোগ–বিয়োগ করতে পারে না৷ এমনকী দেখা যাবে অষ্টম শ্রেণির পরেও সে অ, আ, ক, খ ভাল ভাবে পড়তে পারছে না৷ এই শিক্ষাই কি আমাদের কাম্য? তাই শুধু পাশ করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য কি গোড়াটাকেই নির্মূল করে দেওয়া নয়?
কেউ কেউ বলছেন, নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়ন (সিসিই) নাকি সর্বাপেক্ষা ভাল পন্থা৷ পাশ–ফেল বাদ দিয়ে যদি এটা করা যায়, তাতেই নাকি সবচেয়ে ভাল হবে৷ সঠিকভাবে নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়ন করতে হলে যে উপযুক্ত পরিবেশ–পরিকাঠামো প্রয়োজন, তার নূ্যনতম সংস্থানটুকু কি সরকার কোনও স্কুলে দিতে পেরেছে? বহু জায়গায় একটা ঘরে ৪/৫টা ক্লাস চলে, কোথাও আবার ঘরও নেই৷ সমস্ত রকম শিক্ষার উপকরণ নেই৷ নেই উপযুক্ত সংখ্যক শিক্ষক৷ এক বা দু’জন শিক্ষক দিয়ে চলে প্রায় ৩০ শতাংশ স্কুল৷ এছাড়া পানীয় জল, বিদ্যুৎ, শৌচাগার ইত্যাদি নানা সমস্যা রয়েছে৷ বিশ্বের যে সব দেশে নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়ন হয়, সেখানে ছাত্র–শিক্ষক অনুপাত কত? ১০ : ১ বা ১৫ : ১, কোথাও আরও কম৷ আর আমাদের দেশে ৪০ : ১ বা ৩০ : ১৷ তাও শ্রেণি অনুযায়ী যথেষ্ট সংখ্যায় নয়, চার বা পাঁচটা শ্রেণির জন্য মাত্র এক বা দু’জন শিক্ষক৷ তাহলে এসব সোনার পাথরবাটির উদাহরণ দিয়ে লাভ কী? আর সর্বোপরি যেটা মনে রাখতে হবে তা হল– নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়নের সঙ্গে পাশ–ফেলের কোনও বিরোধ নেই৷ নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়ন করে ছাত্রছাত্রীর যথার্থ মেধা যাচাই করে উপযুক্ত মানের না হলে অর্থাৎ কাঙিক্ষত মানের থেকে নিম্নগামী হলে তাকে উচ্চতর শ্রেণিতে তুলে না দেওয়াই শ্রেয়৷ সুতরাং একটাকে আরেকটার বিকল্প হিসাবে তুলে ধরার অর্থ হল, পুরো বিষয়টিকেই গুলিয়ে দেওয়া৷
শিক্ষা আনে চেতনা– যা সমাজকে, সভ্যতাকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যায়৷ শিক্ষা মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে, চরিত্র গঠন করে৷ শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করে, ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম গড়ে তোলে৷ তাই দেখা গেছে, যুগে যুগে শিক্ষার উপর শাসক শ্রেণি আক্রমণ নামিয়ে এনেছে৷ সর্বক্ষেত্রে উদ্দেশ্য– সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করা৷
পাশ–ফেল চালুর দাবির প্রতি দেশব্যাপী সার্বজনীন সমর্থন লক্ষ করে সরকার পরিস্থিতির চাপে পড়ে তা ফিরিয়ে আনার কথা বলতে বাধ্য হয়েছে৷ যদিও তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত গড়িমসি করছে৷ সরকারের এই স্থবিরতা ভাঙতে হলে আবারও গণআন্দোলনের ধাক্কা চাই৷ সেই লক্ষ্যেই ২২ ফেব্রুয়ারি রাজ্যের শিক্ষক, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, অভিভাবক, ছাত্রছাত্রীরা এই কর্মসূচিতে সামিল হবেন৷