১৮ ফেব্রুয়ারি ত্রিপুরা রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন৷ টাউন বরদোয়ালি, বনমালিপুর, বাধারঘাট, ধর্মনগর এবং মাতাবাড়ি – এই পাঁচটি কেন্দ্রে এস ইউ সি আই (সি) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে৷ প্রকৃত বামপন্থার রাজনীতিতে ভর করে জনজীবনের সমস্যা সমাধানে গণআন্দোলন শক্তিশালী করার বার্তা নিয়ে এস ইউ সি আই (সি) কর্মীরা ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন৷
১৯৬৩ সালে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ত্রিপুরা রাজ্যের মর্যাদা পায়৷ তারপর থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ১৪ বছর রাজ্যে কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল৷ ১৯৭৮ থেকে এ পর্যন্ত, মাঝে ৫ বছর (১৯৮৮–’৯৩) বাদ দিলে ৩৫ বছর ধরে রাজ্যে ক্ষমতায় সিপিএম৷ এদের শাসনে উত্তর–পূর্ব ভারতের এই ক্ষুদ্র রাজ্যটির উন্নয়নের যথাযথ চেষ্টা হয়নি৷ ফলে বারে বারে মানুষ পরিবর্তন চাইছে৷ কিন্তু যথার্থ বিকল্পের অভাবে পরিবর্তনের চিন্তা সফল হতে পারেনি৷
ত্রিপুরায় রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল ভাণ্ডার৷ রয়েছে বিশাল বনাঞ্চল৷ প্রাকৃতিক গ্যাস, বাঁশ, রবার ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে এখানে শিল্প গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে৷ কিন্তু কি কেন্দ্র, কি রাজ্য – কোনও সরকারই শিল্প বিকাশে গুরুত্ব দেয়নি৷ রাজ্যে শিল্প বলতে মূলত ইটভাটা এবং চা–শিল্প৷ স্বাভাবিকভাবেই শিল্পবিহীন এই রাজ্যে বেকার সমস্যা অত্যন্ত তীব্র৷ জনসংখ্যার এক–তৃতীয়াংশ বেকার৷ রাজ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ৷ মাত্র দু’টি মেডিকেল কলেজ– একটি সরকারি অন্যটি পি পি পি মডেলে এবং সেখানে চিকিৎসার পর্যাপ্ত পরিকাঠামো নেই৷ অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য অন্য রাজ্যে যেতে হয় এবং তার বিশাল খরচ সামলাতে স্থাবর–অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে সর্বস্বান্ত হতে হচ্ছে বহু মানুষকে৷
প্রার্থী তালিকা | ||
কেন্দ্র | জেলা | প্রার্থী |
১৷ বরদোয়ালি | পশ্চিম ত্রিপুরা | কমরেড শিবানী ভৌমিক |
২৷ বনমালিপুর | পশ্চিম ত্রিপুরা | কমরেড শেফালি দেবনাথ |
৩৷ বাধারঘাট | পশ্চিম ত্রিপুরা | কমরেড মৃদুলকান্তি সরকার |
৪৷ ধর্মনগর | পশ্চিম ত্রিপুরা | কমরেড সঞ্জয় চৌধুরী |
৫৷ মাতাবাড়ি | গোমতি | কমরেড বিভুলাল দে |
পরিবহণ ব্যবস্থাও খুবই অনুন্নত৷ নেই উন্নত সড়ক ব্যবস্থা৷ ফলে সূর্যাস্তের পর জেলা বা মহকুমা শহর থেকে রাজধানী আগরতলায় পৌঁছানো দুঃসাধ্য ব্যাপার৷ পর্যাপ্ত রেল ব্যবস্থা না থাকায় রাজ্যের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের যোগাযোগ অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল৷ সরকারি পরিবহণ ব্যবস্থাকেও ক্রমাগত বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে৷ কৃষিব্যবস্থা অনুন্নত৷ চাল, ডাল, গম, আটা মাছ ইত্যাদি খাদ্যপণ্যের জন্য অন্য রাজ্যের উপর নির্ভর করতে হয়৷ ফলে রাজ্যে খাদ্যশস্যের দাম অন্য রাজ্যের তুলনায় অনেক বেশি, কালোবাজারিও বেশি৷ তীব্র আর্থিক সংকটে সিংহভাগ মানুষের জীবন জর্জরিত৷
শাসক সিপিএম দলের স্লোগানেই শুধু ‘উন্নয়ন’ আছে, জনজীবনে তার ছোঁয়া নেই৷ অন্যান্য রাজ্যে বুর্জোয়া দলগুলি যেভাবে শাসন পরিচালনা করে, এ রাজ্যে সিপিএম শাসনও ঠিক তাই৷ তার মূল ধ্যানজ্ঞান যে কোনও ভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা৷ এই লক্ষ্যে সমাজবিরোধীদের নিয়ে একটি নেটওয়ার্ক তারা গড়ে তুলেছে৷ সিপিএম বিরোধী বিক্ষোভ হলে বা সিপিএম শাসন নিয়ে কোনও সমালোচনা হলে তৎক্ষণাৎ এই শক্তিশালী নেটওয়ার্ক দিয়ে মানুষের কণ্ঠ রোধ করা হয়৷ কোনও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধেরই মর্যাদা দেওয়ার সংস্কৃতি তাদের নেই৷ পুলিশ, গুন্ডা এবং অন্ধ অনুগত দলীয় কর্মীদের দিয়ে যে কোনওভাবেই হোক বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ করার যে অপরাজনীতি ওরা ৩৪ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে করে গেছে ত্রিপুরায় সেই একই ধারা চলছে৷ সর্বত্র দলীয় কব্জা কায়েমের চেষ্টা অত্যন্ত নগ্ন৷ মানুষ এই ফাঁস থেকে বেরোতে চায়৷
ত্রিপুরার জনগোষ্ঠীর ৩০ শতাংশ আদিবাসী৷ অর্থনৈতিক দিক থেকে এরা অত্যন্ত পিছিয়ে৷ শিক্ষার বিস্তারও এদের মধ্যে অত্যন্ত কম৷ স্বাধীনতার আগে এবং পরে শাসক শ্রেণি এই পশ্চাৎপদতা দূর করার কোনও চেষ্টাই করেনি৷ বরং তারা আদিবাসী বনাম অ–আদিবাসী বিভাজন খুঁচিয়ে তুলে মানুষের ঐক্য ভাঙতে চেয়েছে৷ সিপিএমও দীর্ঘকাল এই রাজ্যে ক্ষমতায় থাকলেও যথার্থ বামপন্থী ধারায় সাধারণ আদিবাসী ও অ–আদিবাসী মানুষদের যুক্ত করে গণআন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেনি৷ ফলে এদের অভাব অনটন এবং পশ্চাৎপদতার সুযোগ নিয়ে নানা বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি মাথা চাড়া দিয়েছে এবং আদিবাসীদের স্বার্থরক্ষার নামে নানা পার্টি এবং সংগঠন গড়ে তুলেছে৷ সিপিএমও আদিবাসী ভোটের দিকে তাকিয়ে ‘ত্রিপুরা ট্রাইবাল এরিয়া অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল’ গঠন করেছে, যদিও আজ পর্যন্ত এই কাউন্সিলকে তারা কোনও অটোনমিই দেয়নি৷ সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল অনুযায়ী অর্থ, পুলিশ এবং বিচারবিভাগের যে অটোনমি পাওয়ার কথা সিপিএম সরকার তা দেয়নি৷ এ নিয়ে আদিবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে৷ আদিবাসীদের কিছু গোষ্ঠী ‘অল ত্রিপুরা ইন্ডিজেনাস রিজিওনাল পার্টিস ফোরাম’ তৈরি করে যেমন ভোটের ময়দানে সিপিএমের সহযোগী হয়েছে, তেমনি কিছু গোষ্ঠী ‘ইন্ডিজেনাস ন্যাশনালিস্ট পার্টি অব ত্রিপুরা’ তৈরি করে বিজেপির সহযোগী হয়েছে৷ কংগ্রেসের ক্ষমতালোভী নেতৃবৃন্দ যারা রাজ্যে কংগ্রেসের কোনও ভবিষ্যৎ না দেখে তৃণমূল কংগ্রেসে গিয়েছিল এখন তারা বিজেপিতে যোগ দিয়েছে৷ বিজেপি হিন্দু ভোট কব্জা করার জন্য সাম্প্রদায়িক লাইনে প্রচারে নেমেছে৷
এই রাজনৈতিক মেরুকরণের মধ্যে এসইউসি আই (সি) যথার্থ বামপন্থী লাইনে পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে৷ এসইউসিআই (সি) এই রাজ্যে বিগত বছরগুলিতে বেশ কিছু আন্দোলনে জয়ী হয়েছে৷ তার অন্যতম অন লাইন লটারি বন্ধ হওয়া৷ রাজস্ব বাড়ানোর নামে সিপিএম সরকার অন লাইন লটারি চালু করেছিল৷ সাধারণ মানুষ এই লটারিতে সর্বস্বান্ত হচ্ছিল৷ এসইউসিআই (সি)–এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে৷ অর্থমন্ত্রীর দপ্তরের সামনে ব্যাপক ধরনা, লটারির কাউন্টার অবরোধ করা এবং ব্যাপক মানুষ তাতে সামিল হওয়ায় রাজ্য সরকার অনলাইন লটারি বন্ধ করতে বাধ্য হয়৷
ত্রিপুরায় পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতির জন্যও আন্দোলন গড়ে তুলেছে এসইউসিআই (সি)৷ ত্রিপুরায় এবং আসামে ব্রডগেজ রেল রূপায়ণ সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলে ধারাবাহিক আন্দোলন হয়েছে৷ দিল্লির যন্তরমন্তরেও ধরনা অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ অবশেষে কেন্দ্রীয় সরকার এই দাবি মেনে নিয়েছে৷ জনবিরোধী বিদ্যুৎ আইন ২০০৩ মেনে ত্রিপুরা সরকার বিদ্যুৎ দপ্তরকে কর্পোরেটমুখী করলে এবং বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য রেগুলেটারি বোর্ড গঠন করলে এসইউসিআই (সি) তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে৷ জনমতের চাপে সরকার তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়৷ শিক্ষাস্বার্থ বিরোধী নোডাল সিস্টেমও বাতিল হয় এসইউসিআই (সি)–র আন্দোলনের ফলে৷ এই আন্দোলনগুলি ছাড়াও জনজীবনের নানাবিধ সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করে যাচ্ছে এসইউসিআই (সি)৷
সিপিএমের অবাম শাসনে ক্ষুব্ধ ত্রিপুরাবাসীর সামনে যথার্থ বামশক্তির মর্যাদা নিয়ে এসইউসিআই (সি) দাঁড়িয়ে আছে৷ জনগণের সামনে এস ইউ সি আই (সি) স্পষ্ট করে বলছে, বুর্জোয়া দল বিজেপি সাধারণ মানুষের সামনে বিকল্প হতে পারে না৷ কেন্দ্রে এবং রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি চূড়ান্ত জনস্বার্থ বিরোধী নীতি কার্যকর করছে৷ আবার সিপিএম রাজ্যে বুর্জোয়াদের স্বার্থেই জনবিরোধী নীতি নিয়ে চলছে৷ এই অবস্থায় প্রকৃত বামপন্থী লাইনে গণআন্দোলনকে শক্তিশালী করাই শ্রমজীবী মানুষের কর্তব্য৷