আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম নামতে নামতে এখন ব্যারেল পিছু ৮০ ডলারের আশেপাশে। ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে এক সময়ে ব্যারেলে তা ১৩৯ ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল। দাম ১০০ ডলার ছাড়াতেই দেশের বাজারে জ্বালানির দাম তর তর করে বাড়তে শুরু করেছিল। স্বাভাবিক ভাবেই দেশের মানুষের আশা ছিল, এখন যখন দাম প্রায় ৬০ ডলার কমে গেছে তখন সরকার দেশের বাজারেও সেই অনুপাতে তেলের দাম কমাবে। কিন্তু মানুষ দেখছে মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে তেলের দাম আকাশছোঁয়াই থেকে গেছে। জনগণ দাম কমার কোনও সুবিধাই পাচ্ছে না।
তা হলে এই দাম কমার সুবিধাটা পাচ্ছে কারা? অনেকেরই মনে আছে লকডাউনের শুরুতে যখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম শূন্যে নেমে গিয়েছিল তখনও দেশের বাজারে বিজেপি সরকার তেলের দাম এতটুকুও কমায়নি, আকাশছোঁয়া ট্যাক্স চাপিয়ে দাম একই রেখে দিয়েছিল। আর এখন দাম কমার সুবিধের পুরোটাই ব্যবহার করে সরকারি এবং বেসরকারি তেল কোম্পানিগুলির লুটের ব্যবস্থা করে দিয়েছে সরকার। যদিও সরকার এতেই ক্ষান্ত হয়নি। আরও অবিশ্বাস্য লুটের ব্যবস্থা করেছে তারা যা অনেকেরই জানা নেই।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আমেরিকা এবং ইউরোপের ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো রাশিয়ার তেলের উপর নানা নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে। ফলে রাশিয়ার তেলের বাজার অনেকখানিই সঙ্কুচিত হয়েছে। এই অবস্থায় এশিয়ার দেশগুলিতে তেল বিক্রির চেষ্টা করছে রাশিয়া। বিজেপি সরকার যেহেতু এই যুদ্ধের বিরোধিতা না করে রাশিয়ার পক্ষ নিয়েছে, সেই সুবাদে তারা ভারতকে জলের দামে তেল বেচছে। ফলে ভারতের তেল কোম্পানিগুলি আগে ইরাক, ইরান, সৌদি আরব থেকে যে তেল কিনত তা প্রায় বন্ধ করে দিয়ে সিংহভাগ তেল এখন রাশিয়া থেকেই কিনছে।
সরকারি এবং বেসরকারি তেল কোম্পানিগুলি কত দামে তেল কিনছে রাশিয়া থেকে ভারতের ‘গণতান্ত্রিক সরকার’ তা কিন্তু দেশের মানুষের সামনে কিছুতেই আনতে রাজি নয়। তবে এটুকু জানা আছে যে, শুরুতে যখন রাশিয়া ৪০ ডলারে তেল বেচছিল তখনই ঘোষণা করেছিল প্রয়োজনে আরও কম দামে তারা ভারতকে তেল দিতে রাজি আছে। সম্প্রতি জি-৭ ভুক্ত দেশগুলি নতুন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে এসেছে রাশিয়ার উপর। আমেরিকা, ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের দেশগুলি ইউক্রেনকে প্রকাশ্যেই অস্ত্র এবং অর্থ সরবরাহ করছে। এই অবস্থায় একদিকে যেমন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে রাশিয়ার খরচের জোগান বজায় রাখার তাগিদ রয়েছে, তেমনই তেলের খনিগুলি থেকে উত্তোলিত তেল না বেচে তার উপায় নেই। কারণ যে বিপুল পরিমাণ তেল রাশিয়া উৎপাদন করে তা যেমন জমিয়ে রাখা সম্ভব নয়, তেমনই উৎপাদনের প্রক্রিয়াও বন্ধ করা যায় না। তাই লকডাউনে তেল উৎপাদক সংস্থাগুলিকে শূন্য ডলারেও তেল বেচতে হয়েছে। এই অবস্থায় ভারত যে ৪০ ডলারের থেকে অনেক কম দামেই তেল হাতিয়ে নিচ্ছে তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া অন্য দেশগুলি থেকে ভারতের তেল কেনা বন্ধ করা থেকেও এ সত্য স্পষ্ট।
তা হলে জলের দামে যে তেল দেশীয় কোম্পানিগুলি কিনছে তার সুবিধা দেশের জনগণ পাবে না কেন? তেলের চড়া দামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে প্রতিটি জিনিসের দাম। গণপরিবহণের খরচও এই অজুহাতে আকাশ ছুঁয়েছে। লকডাউন সাধারণ মানুষের জীবন ছারখার করে দিয়ে গেছে। কোটি কোটি মানুষ কাজ হারিয়ে রোজগারহীন হয়ে পড়েছে। যাদের কাজ কোনও ক্রমে রক্ষা পেয়েছে তাদেরও অধিকাংশই অনেক কম বেতনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এই অবস্থায় যে কোনও একটি গণতান্ত্রিক সরকার, যে জনগণের সুবিধা-অসুবিধার কথা এতটুকু ভাবে, তার তো তেলের উপর ট্যাক্স কমিয়ে, কোম্পানিগুলির বিপুল মুনাফায় লাগাম পরিয়ে দাম জনগণের আয়ত্তের মধ্যে নিয়ে এসে তাদের জীবন-যন্ত্রণার কিছুটা সুরাহা করার কথা! অথচ দেশের মানুষ দেখছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তেলের দাম এতটুকুও না কমিয়ে জনগণের জন্য মাত্রাছাড়া দুর্দশা আর তেল কোম্পানিগুলির জন্য সীমাহীন লুটের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
তেল কোম্পানিগুলি একদিকে যেমন জলের দামে তেল কিনে তা আগুন দামে দেশের জনগণের কাছে বেচছে, তেমনই ইউরোপের বাজারেও চড়া দামে বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করছে। স্বাভাবিক ভাবেই বহু মানুষ এই প্রশ্ন করছেন যে, একটি নির্বাচিত সরকার কি এমন নির্লজ্জ ভাবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থকে দু’পায়ে মাড়িয়ে শুধু তেল কোম্পানিগুলির স্বার্থ দেখতে পারে ? দেশের মানুষের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবিকে তারা ফুৎকারে উড়িয়েই বা দিতে পারছে কী করে?
পারছে এই কারণে যে, যতই দেশের মানুষ মনে করুক যে এটি একটি নির্বাচিত সরকার, অতএব একটি গণতান্ত্রিক সরকার, বাস্তবে এই সরকার দেশের শিল্পপতি-পুঁজিপতিদেরই সরকার। শুধুমাত্র তাদেরই স্বার্থরক্ষাকারী সরকার। তাদের দ্বারাই নির্বাচিত সরকার। তাদের টাকার থলি, তাদের প্রচার কাজে লাগিয়ে তাদেরই পছন্দে তৈরি হওয়া সরকার। নির্বাচনে পুঁজিপতিদের প্রভাব আজ এতখানি যে, তারা শুধু কে কোন দপ্তরের মন্ত্রী হবে তা-ই ঠিক করে দেয় না, কে কোন কেন্দে্র প্রার্থী হবে তা-ও ঠিক করে দেয়। কংগ্রেসের মনমোহন সিংয়ের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়ে টু-জি কেলেঙ্কারির তদন্তে উঠে এসেছিল, তৎকালীন টেলিকম মন্ত্রী এ রাজা ছিলেন টাটাদের মনোনীত। বিজেপি শাসনে তেলমন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান ছিলেন আম্বানিদের মনোনীত। বর্তমান তেলমন্ত্রী হরদীপ পুরী যে ভাবে তেল কোম্পানিগুলির লোকসানের গল্প একঘেয়ে সুরে গেয়ে চলেছেন তাতে তিনি যে কোম্পানিগুলিরই ঘরের লোক তাতে কোনও সন্দেহ থাকে না। এই তেলমন্ত্রীর উমেদারিতেই অর্থমন্ত্রক গ্যাস উৎপাদনে ‘লোকসান হচ্ছে’ এমন হাস্যকর দাবি মেনে তেল কোম্পানিগুলিকে ২২,০০০ কোটি টাকা পুষিয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ মুখে যা-ই বলা হোক, বাস্তবে এই সরকার শিল্পপতিদের দ্বারা, শিল্পপতিদের জন্য, শিল্পপতিদেরই সরকার।
সরকার এমন একটা চরম অন্যায় লাগাতার চালিয়ে যেতে পারছে আরও একটি কারণে। সরকারের ধুরন্ধর নেতা-মন্ত্রীরা জানে, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, ছাঁটাই প্রভৃতি কারণে জনগণের অসন্তোষ যতই বাড়ুক, বাস্তবে এই বিক্ষুব্ধ জনগণ পরস্পর বিচ্ছিন্ন, অসংগঠিত। বিচ্ছিন্ন ক্ষোভ প্রকাশ ছাড়া তারা আর কিছুই করতে পারবে না। এই অবস্থায় তেল-গ্যাসের দাম কমানোর মতো জনগণের ন্যায্য দাবিগুলিকে সরকারকে মানতে বাধ্য করতে হলে এই বিচ্ছিন্ন ক্ষুব্ধ জনগণকে সংগঠিত ভাবে, ঐক্যবদ্ধ ভাবে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তথাকথিত বিরোধী দলগুলি আজ বাস্তবে তাদের বিরোধী ভূমিকা ত্যাগ করেছে। তাই জনগণকে সঠিক নেতৃত্ব চিনে নিয়ে নিজস্ব উদ্যোগে আন্দোলনে এগিয়ে আসতে হবে। আন্দোলন তুঙ্গে তুলে সরকারকে বাধ্য করতে হবে ন্যায্য দাবি মানতে।