‘দর্শন’–এই কথাটাই সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ভয় মিশ্রিত, আবেগহীন শ্রদ্ধার ভাব জাগিয়ে তোলে। দর্শনের মতো গুরুগম্ভীর জটিল একটা বিষয় যে সাধারণ মানুষের জন্য নয়–এই ধারণাটা প্রায় সমস্ত স্তরের মানুষের মধ্যেই কমবেশি প্রচলিত আছে। সাধারণ মানুষ বড় জোর পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, জীববিজ্ঞান বা মনস্তত্তে্বর মতো বিষয়গুলি নিয়ে একটু আধটু নাড়াচড়া করতে পারে। কারণ এসব বিষয়গুলি তবু ধরাছোঁয়া যায়, বোঝা যায়। এমনতরো বিশেষ বিশেষ বস্তু সম্পর্কেই তারা আলোচনা করতে সক্ষম। কিন্তু দর্শন! সীমাহীন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সংখ্যাহীন বিষয়বস্তু সম্পর্কে অন্তহীন তর্ক-বিতর্কের দিগ্বিদিকহীন এক গোলকধাঁধা–এ ছাড়া আর কী বা বলা যায় দর্শনকে?
দর্শন বিষয়টি যে সত্যিই কী–সে সম্পর্কে একটা সঠিক ধারণা দেওয়ার জন্য এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ও তত্ত্বগত ক্ষেত্রে পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, জীববিজ্ঞান বা মনস্তত্ত্বকে যেমন নিজেদের কাজে লাগানো হয়, তেমনই দর্শন শাস্ত্রটিকেও আমাদের কোনও কাজে আমরা লাগাতে পারি কি না, সেটা দেখার জন্য বর্তমান আলোচনার অবতারণা।
দর্শন বলতে সাধারণ অর্থে আমরা বুঝি– ‘এই দুনিয়াটা কী রকম’, ‘মানুষ কী করে এল’? ‘কী উদ্দেশ্যে এল’? ‘জীবনের অর্থ কী’? ইত্যাদি নানাবিধ প্রশ্ন সম্পর্কে নানা মুনি যে নানা রকম মত জাহির করে গেছেন–তাই, এবং সত্যি সত্যিই এই নানা মুনির নানা মতের মধ্য দিয়ে ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত এমন জটিল অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, এমনকি দর্শন শাস্ত্রের বিষয়বস্তুটা ঠিক কী, অথবা কোনও দর্শনের প্রকৃত অর্থ ঠিক কী–এ বিষয়ে দর্শনের অধ্যাপকরা পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে একটা মতৈক্যে এসে পৌঁছতে পারেননি। এত বহু বিচিত্র মত ও পথের গোলকধাঁধাঁয় পড়ে তাই শেষপর্যন্ত সমস্ত লোকই–এ সম্পর্কে আর বিশেষ মাথা ঘামানো উচিত নয় স্থির করে যে যার নিজের নিজের আখের গোছানোর দিকে নজর দিয়েছে–ধর্মপ্রাণ বৃদ্ধ আশ্রয় নিয়েছে ভগবানের কোলের মধ্যে, সংশয়বাদীরা আত্মসমর্পণ করেছে জীবন-বিদ্বেষী আত্মসর্বস্বতার ধারণার কাছে, বিজ্ঞানী তার ল্যাবরেটরিতে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছে, আর মুনাফাখোর ব্যবসায়ী তার লাভের অঙ্ক বাড়াবার দিকেই নজর দিয়েছে। দর্শনের মতো এত বড় একটা ব্যাপার, এত জটিল তত্তে্বর পিছনে নষ্ট করার মতো সময় কোথায় তাদের!
কিন্তু মানুষ, ‘দর্শনকে’ ছাড়তে চাইলেই বা দর্শন মানুষকে ছাড়ে কই? ওই সব অ-দার্শনিক লোক, যারা সযত্নে দর্শনের ছায়াটুকু পর্যন্ত পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে, তারা জানেও না যে তাদের এই কাজের মধ্যেও একটা দর্শন কাজ করে চলেছে। দর্শন হচ্ছে এমন একটা জিনিস, যা আমাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই বর্তমান। মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনযাপনের পথে, প্রতি দিন নানা ভাবে নানা দিক থেকে প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং তার আশেপাশের আর পাঁচটা মানুষের সঙ্গে এক এক সময় এক এক ভাবে দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়, সংঘর্ষ ও মিলনের সম্পর্ক স্থাপন করছে। তার নিজের সঙ্গে সমাজের এবং প্রকৃতির এই বিভিন্ন ধরনের সম্পর্কের মধ্য দিয়েই তার নানা রকমের ভাবনা, ধারণা, বিশ্বাস বা সংস্কার গড়ে উঠছে। এবং এর মধ্য থেকেই তার নিজের সম্পর্কে আর আশপাশের মানুষগুলি সম্পর্কে, সমাজ সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে, এই দুনিয়া সম্পর্কে তার যে ধারণা গড়ে উঠছে তাই হচ্ছে দর্শনশাস্তে্রর প্রাথমিক ভিত্তি।
যেহেতু প্রত্যেক মানুষেরই এই সমস্ত বিষয়গুলি সম্পর্কে কিছু কিছু নিজস্ব ধারণা, ভাবনা, বিশ্বাস বা সংস্কার আছে এবং যেহেতু এই সমস্ত বিষয়গুলিই দর্শনশাস্ত্রের এক্তিয়ারভুক্ত, তাই এ সম্পর্কে সামান্য কিছু আলোচনা নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলেই মনে হয়।
কিন্তু এই সমস্ত বিষয়গুলি সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই যে প্রশ্নটা উঠবে, তা হচ্ছে, এই যে জীবন, সমাজ ও দুনিয়া সম্পর্কে এক একজন মানুষের এক একটা ব্যক্তিগত ধারণা বা চিন্তা–দর্শন বলতে কি কেবলমাত্র এইটুকুকেই বোঝায়, নাকি এর চাইতে বেশি কিছু বোঝায়? এর জবাব মিলবে দর্শনশাস্ত্রের ইতিহাস কিছুটা পর্যালোচনা করলে।
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকেরা বস্তুজগত সম্পর্কে তাদের নিজের নিজের ব্যক্তিগত ধারণা বা ব্যক্তিগত চিন্তাকে প্রকাশ করতে গিয়ে কেউ কেউ বললেন, সৃষ্টির আদিতে ছিল জল, কেউ বললেন, জল নয়, বায়ু। আবার আর একজন বললেন, জলও নয়, বায়ুও নয়, সমস্ত বিশ্ব জগতের সৃষ্টির মূলে রয়েছে অগ্নি। এই তিন ব্যক্তির তিনটি চিন্তা পাশাপাশি ধরলে দেখতে পাব এগুলির কোনওটিই কারও ব্যক্তিগত খেয়ালি কল্পনা বা আন্দাজি ধারণা মাত্র নয়। কারণ এই তিনজনের তিনটি ধারণার মধ্যে পার্থক্য আছে সত্য, কিন্তু এই পার্থক্যের চাইতেও তিনজনের মতৈক্যটাই বেশি লক্ষণীয়। প্রথম মতৈক্য, তিনজনেরই এক প্রশ্ন–বস্তু জগতের উৎস কী? তিন জনেরই সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর পিছনে সমকালীন চিন্তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ধারণা বর্তমান। যেমন প্রত্যেকেই এটা ধরে নিয়েছেন যে সারা দুনিয়ায় যত বিভিন্ন রকমের জড়পদার্থ বা জীবজন্তু দেখা যায় সেই সমস্তগুলিই কোনও সাধারণ মৌলিক বস্তু থেকে ক্রমাগত পরিবর্তনের পথে সৃষ্ট হয়েছে। আমাদের প্রাচীন দর্শনশাস্ত্রে যেমন ক্ষিতি (পৃথিবী, মাটি), অপ (জল), তেজ (অগ্নি), মরুৎ (বায়ু) এবং ব্যোম (শূন্য)– এই পাঁচটিকে প্রাথমিক পদার্থ বলে মনে করা হত তেমনি প্রাচীন গ্রিসের দর্শন শাস্ত্রেও এর প্রথম চারটিকে, অর্থাৎ মাটি, জল, অগ্নি এবং বায়ুকে মৌলিক পদার্থ বলে মনে করা হত। এঁরা তিনজনে তিনটি বিভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে ওই চারটি মৌলিক পদার্থেরই কোনও না কোনওটিকে মূল পদার্থ বলে ধরে নিয়েছেন, তখনকার সমাজের সাধারণ অভিজ্ঞতার বাইরে যাননি। তিনজনের চিন্তাধারার এটা দুই নম্বর মিল।
তৃতীয় মতৈক্য দেখতে পাওয়া যায় এঁদের একটা সাধারণ ধারণার মধ্যে যে, একই সাধারণ মৌলিক পদার্থ থেকে আজ যে এই বহুবিধ জড় ও জীবের আবির্ভাব ঘটেছে, এটা ঈশ্বর বা অন্য কোনও দেবদেবীর মর্জি বা খেয়ালখুশিতে ঘটেনি, প্রকৃতি জগতের একাধিক নিয়ম-নীতি অনুসরণ করেই একটিমাত্র মৌলিক পদার্থের মধ্য থেকে ক্রমাগত পরিবর্তনের পথে দুনিয়ার যাবতীয় জড় ও জীবের আবির্ভাব ঘটেছে।
এই তিন প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকের বক্তব্য যত অস্পষ্ট বা অগোছালোই হোক না কেন, একটা কথা খুব স্পষ্ট যে এঁদের তিনজনের ধারণার প্রভেদ যতটুকু, মিল ছিল তার তুলনায় অনেক বেশি। পরবর্তী কালের দর্শনের ইতিহাস আলোচনা করলেও আমরা দেখতে পাব যে অপেক্ষাকৃত জটিলতর এবং যুক্তিবহুল দার্শনিক চিন্তাধারাগুলির শেষ সিদ্ধান্তগুলি যতই পরস্পরবিরোধী হোক না কেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই কতগুলি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর খোঁজবার চেষ্টা হয়েছে। কাজেই বিভিন্ন দার্শনিকের বিভিন্ন চিন্তাধারা ও সিদ্ধান্তের পার্থক্যের মধ্য দিয়ে ‘দর্শন কী’ তা বোঝার চেষ্টা না করে বিভিন্ন দার্শনিকের বাস্তবতা বা সত্য সম্পর্কে একই ধরনের প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে তা বুঝতে গেলে তার চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা হবে।
একই অভিজ্ঞতার উপরে দাঁড়িয়ে একই প্রশ্নের উত্তরে এক এক দার্শনিক এক এক রকম সিদ্ধান্তে গিয়ে পৌঁছেছেন। এর কারণ কী? ইতিহাসকে সতর্কভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে নিছক যুক্তি-তর্ক বা নিছক ঘটনার উপর ভিত্তি করেই এই সমস্ত দার্শনিক সিদ্ধান্তের পার্থক্য ও বিভেদের সৃষ্টি হয়নি, বরং সমাজের অভ্যন্তরে পরস্পরবিরোধী শক্তির সংঘাত, পরস্পরবিরোধী ভাবনা ধারণার অস্তিত্বই একই প্রশ্নের মীমাংসায় এক একজন দার্শনিককে এক এক দিকে ঠেলে দিয়েছে। যে বিশেষ যুগে যে বিশেষ সামাজিক পরিবেশে দার্শনিকের জন্ম, যে বিশেষ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে যে গোষ্ঠী বা শ্রেণির মধ্যে তাঁর অবস্থান, সেই বিশেষ কালের, সেই বিশেষ সমাজের সেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে যদি আমরা লক্ষ না করি, তা হলে তাঁর সেই বিশেষ সিদ্ধান্ত–যা অন্য অনেক দার্শনিকের সিদ্ধান্তের বিরোধী–তার উৎপত্তির কারণও আমরা খুঁজে বের করতে পারব না।
সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পটভূমিকা একেবারে অগ্রাহ্য করে যদি আমরা কোনও দার্শনিককে বিচার করতে যাই তা হলে আরও একটা কথা খুঁজে বের করা আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হবে। যে ভাবে প্রাচীন দার্শনিকেরা বাস্তব জগতের চার দেওয়ালের মধ্যেই তাঁদের প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলেন পরবর্তী কালের দার্শনিকেরা কেন আর সেই পূর্বপ্রদর্শিত পথ অনুসরণ করলেন না? কেন তাঁদের দর্শনচর্চা বিজ্ঞানের সঙ্গে ক্রমশই সম্পর্ক কাটিয়ে আনল। কেন তাঁদের দর্শনচর্চা পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র বা জীববিজ্ঞানের থেকে আলাদা হয়ে বাস্তব জগতের সঙ্গে যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন করে সম্পূর্ণ আলাদা একটা শাস্ত্র হিসাবে কখনও এগুলির সমর্থনে কখনও এগুলির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীন স্বতন্ত্র বিজ্ঞান নিরপেক্ষ ‘দর্শনশাস্ত্রে’ পরিণত হল?
মানবসভ্যতার ইতিহাসের পটভূমিকায়, আদিমকাল থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের জীবনের সামগ্রিক পরিবর্তনের পটভূমিকায় রেখে যদি দর্শনের ইতিহাসকে বিচার করি, তা হলে দুটো সত্য অত্যন্ত স্পষ্টভাবে আমাদের সামনে বেরিয়ে আসে।
প্রথমত, দর্শন অর্থে কোনও কালেই নিষ্পৃহ, নিরাসক্ত, নিঃস্বার্থ সত্যানুসন্ধান বোঝায়নি।
দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক যুগের প্রত্যেক দর্শনই হয় প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার, ভাবনা-ধারণা, বিশ্বাস ও সংস্কারকে সমর্থন করেছে, নয় এগুলির বিরুদ্ধতা করেছে।
এইভাবে প্রত্যেকটি দর্শনকে যদি বিচার করি তা হলেই আমরা সেগুলির যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারব। নইলে এই ঐতিহাসিক পটভূমিকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে গেলে কোনও দর্শনেরই উৎপত্তির ইতিহাস, উৎপত্তির কারণ এবং তাৎপর্য আমার বুঝতে পারব না।
দর্শন শাস্ত্রের আগাগোড়া ইতিহাস লক্ষ করলে দেখতে পাওয়া যাবে, দুটি প্রশ্ন সেখানে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। প্রথম এবং প্রধান প্রশ্ন, ‘অন্তিম সত্য কী’ (অর্থাৎ কিসের উপর এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত বস্তু এবং সমস্ত ঘটনা নির্ভরশীল) – বস্তু না ভাব? এক দলের মতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত পদার্থের, অর্থাৎ জড়, জীব, মানুষ অথবা মানুষের সমাজ, মানুষের মন তথা চিন্তাজগত এ সব কিছুরই আবির্ভাব ঘটেছে বস্তু থেকে। এখানে বস্তু বলতে কোনও বিশেষ একটি বস্তুকে বোঝায় না, সাধারণ ভাবে নির্বিশেষ বস্তু বোঝায়। আবার আর এক দলের মতে আইডিয়া বা ভাবই হচ্ছে সমস্ত কিছুর মূলে। এখানে ‘ভাব’ বলতে কোনও বিশেষ ব্যক্তির ভাবনা বা চিন্তা বা আদর্শকে বোঝায় না, ভাব বলতে বোঝায় ব্যক্তি-নিরপেক্ষ, বস্তু-নিরপেক্ষ, কোনও স্বয়ম্ভু (সেল্ফএগজিসটেন্ট) নিয়ম-নীতি বা আদর্শের আদি অন্তহীন শাশ্বত, সনাতন চিন্তা ব্যবস্থাকে। এ ‘ভাব’ মানুষের মস্তিষ্কের বাইরে, ছাপার অক্ষরে লেখা বইয়ের বাইরে, মনে করে রাখা স্মৃতির বাইরে, আমাদের এই ধরা-ছোঁয়ার জগতের বাইরে, ব্যক্তি নিরপেক্ষ, বস্তু নিরপেক্ষ ভাবে স্বয়ম্ভু অবস্থায় বিরাজমান। এ ‘ভাবের’ অস্তিত্ব স্থান-কাল-পাত্রের ঊর্ধ্বে।
দর্শন শাস্ত্রের ইতিহাসে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা উঠেছে– নিত্যতা বা অনিত্যতার মধ্যে কোনটি সত্য? যা স্থায়ী, যা ধ্রুব, যা চিরন্তন বা নিত্য, সেটাই সত্য, নাকি, যা অস্থায়ী, যা স্বল্পকালীন, যা সাময়িক, বা অনিত্য সেটা সত্য?
এই দু’টি প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের আলোচনা করতে গেলে দেখা যাবে যে, দু’টি প্রশ্নের মধ্য থেকেই দর্শন এবং বিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রশ্নটি প্রকট হয়ে উঠেছে।
বিজ্ঞান কী করে? বিজ্ঞান প্রকৃতিজগতের বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে ভর (মাস) ও শক্তির (এনার্জি) বিভিন্ন রূপের কি পরিবর্তন ঘটছে, কেন ঘটছে কী ভাবে ঘটছে তার হদিশ বাতলায় এবং এরই মাধ্যমে মানুষ যাতে প্রকৃতিকে বুঝতে পারে এবং তাকে নিজের কাজে লাগাতে পারে এ ব্যাপারে সাহায্য করে। বিজ্ঞানের সব কিছু কাজ কারবার ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বস্তু নিয়ে। বিশেষ বিশেষ বিজ্ঞান বস্তুর বিশেষ বিশেষ রূপের ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে আমাদের অবহিত করে। কিন্তু বিজ্ঞানের কোনও বিশেষ শাখাই, ‘এই দুনিয়াটা কী রকম’, ‘বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কী? এই ধরনের তত্ত্বগত প্রশ্নের কিংবা ‘জীবনের উদ্দেশ্য কী?’, ‘মানুষের কর্তব্য কী’– এই ধরনের আনুসঙ্গিক নীতিগত প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা বিশেষ বিশেষ বিষয় বা বস্তু সম্পর্কে বিশেষ বিশেষ সত্যের সন্ধান দিতে পারে কিন্তু সাধারণ ভাবে দুনিয়া সম্পর্কে বা জীবন সম্পর্কে কোনও সাধারণ সত্যের সন্ধান দিতে পারে না। এই সব দার্শনিক তত্ত্বগত বা নীতিগত প্রশ্নের জবাব মানুষ তখনই পেতে পারে যখন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশেষ বিশেষ সত্যগুলির মধ্যকার, সাধারণ যোগসূত্রটা খুঁজে বের করে তার ভিতর থেকে সে জগত সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে একটা সামগ্রিক ধারণা গড়ে তুলতে পারে। এবং এই সামগ্রিক ধারণা, এই সাধারণ সত্যের উপলব্ধিই হচ্ছে দর্শন।
(এই নিবন্ধটি ১৯৬২ সালে গণদাবী ১৫ বর্ষ ৬ সংখ্যা থেকে ৯ সংখ্যা পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। নিবন্ধটির গুরুত্ব বিবেচনা করে পুনঃপ্রকাশ করা হল। এ বার প্রথম অংশ)