Breaking News

ভাণ্ডারে উপচে পড়া খাদ্য তবু দেশে এত মানুষ ক্ষুধার্ত

ক্ষুধা নিয়ে ভারতে যত গবেষণা হয়েছে, তার যত রিপোর্ট বেরিয়েছে, পর পর রাখলে বোধহয় চাঁদে পৌঁছে যাওয়া যায়। প্রতি বছর নানা জাতীয়, আন্তর্জাতিক সংস্থা এইসব রিপোর্ট বের করে। তাতে বারে বারে দারিদ্রের ভয়াবহ চিত্রই উঠে আসে। দেখা যায়, দারিদ্র ক্রমাগত বাড়ছে, অপুষ্টি বাড়ছে, শিশু, প্রসূতি মায়ের মৃত্যুও ক্রমাগত বাড়ছে। তারপর কী হয়?

এমন খবরে যেখানে সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের লজ্জায় অধোবদন হওয়া উচিত, নিজেদের অপদার্থতায় আত্মগ্লানিতে ভোগা উচিত, দারিদ্র-অপুষ্টি দূর করতে কোমর বেঁধে নামার কথা ঘোষণা করা উচিত, সেখানে শোনামাত্র তাঁরা রিপোর্ট অস্বীকার করতে থাকেন। বলেন, এ সব ভুল রিপোর্ট। ভুল পদ্ধতিতে তৈরি এবং অবশ্যই সরকারের দুর্নাম করার উদ্দেশ্যেই এমন রিপোর্ট বানানো হয়েছে– ঠিক যেমন এবারের বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের রিপোর্টে ভারতের দুদর্শার চিত্র ফুটে উঠতে দেখে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের মন্ত্রীরা বলেছেন। তাঁরা বলেছেন, বাস্তবে এমন কোনও পরিস্থিতিই নেই, দেশে ক্ষুধার অস্তিত্বই নেই। যেন শুধু সবটাই কৌশল, শুধু পদ্ধতির খেলা!

২০১৪ সালে ১০১টি দেশের ক্ষুধা তালিকায় ভারতের জায়গা হয়েছিল ৫৫ নম্বরে। ২০২০তে ৯৪। ২০২১-এ ১১৬টি দেশের মধ্যে ১০১-এ। এবার ২০২২-এ ১২১টি দেশের মধ্যে ভারত ১০৭ নম্বরে। অর্থাৎ একের পর এক রিপোর্ট বেরোচ্ছে, ক্ষুধা তালিকায় ভারত ক্রমশ খারাপ থেকে আরও খারাপের দিকে নেমে চলেছে। তার মানে, ক্ষুধা, অপুষ্টি, দারিদ্র যতই বাড়ুক, যতই তা কেউ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিক, তাতে শাসকদের কিছু যায় আসে না। তারা নির্বিকার। কারণ তারা জানে, এই কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষ দলবেঁধে তাদের কাছে খাদ্য চাইতে আসবে না, তাদের খাদ্য জোগাতে বাধ্য করবে না। কিংবা খাদ্য না পেলে খাদ্যভাণ্ডার লুঠ করার কথা ভাববে না। এমন আত্মবিশ্বাসের কারণ মানুষকে তারা ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে।

ক্ষুধা সংক্রান্ত রিপোর্টগুলিতে কী থাকে? থাকে ক্ষুধার চরিত্র বর্ণনা, ক্ষুধার ফল বর্ণনা। এই যেমন এবারের রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, দেশের মানুষের ১৬.৩ শতাংশ তথা ২২.৪ কোটি মানুষ অপুষ্টির শিকার। ১৯.৩ শতাংশ শিশুর ওজন উচ্চতার তুলনায় কম। ৩৩.৫ শতাংশ শিশুর বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম। কিন্তু এইসব রিপোর্টে বলা থাকে না কেন এই অপুষ্টি? প্রয়োজনীয় পরিমাণ পুষ্টি তারা কেন পায় না? দেশে কি খাদ্যের উৎপাদন কম হয়েছে? খাদ্যের মজুত কম হয়েছে? বাস্তবটা মোটেও তা নয়। বরং দেশবাসীর মোট প্রয়োজনের তুলনায় উৎপাদন অনেক বেশি। তবুও কেন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও বিপুল পরিমাণ দেশবাসী অর্ধাহারে-অনাহারে থাকে? মাথার উপর ছাদ পায় না? রোগে ওষুধ পায় না? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা এসব রিপোর্টে থাকে না।

২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর আনন্দবাজারে প্রকাশিত একটি খবরে দেখা যাচ্ছে, সরকারের গুদামে চাল সহ বিভিন্ন খাদ্যশস্য উপচে পড়ছে। আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য ‘বাফার স্টকে’ যে পরিমাণ চাল থাকা জরুরি, সরকারি গুদামে মজুত রয়েছে তার প্রায় দ্বিগুণ। এই খাদ্য দেশের ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কোনও চেষ্টা সরকার করেনি। পরিবর্তে মদ কোম্পানিগুলিকে সরকার বিপুল পরিমাণ শস্য দিয়ে দিচ্ছে ইথানল তৈরির জন্য। এতদিন পর্যন্ত আখের রস এবং গুড় থেকেই যে ইথানল তৈরি হত, ওই খবর অনুযায়ী সরকারি পরিকল্পনায় ১৭৫ লক্ষ টন চাল-গম-ভুট্টা-বার্লির মতো খাদ্যশস্য দিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেই ইথানল তৈরির জন্য। মদের প্রসার ঘটিয়ে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য খাদ্য চাল-গমকে ইথানল তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ-ই হল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চরিত্র। এখানে যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্য মজুত থাকলেও কোটি কোটি মানুষকে ক্ষুধার্ত থাকতে হয়। কারণ খাদ্য এখানে মুনাফার পণ্য, জীবনধারণের অপরিহার্য দ্রব্য নয়। খাদ্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরিমাণে মজুত থাকলেও তা কেনার ক্ষমতা যেহেতু ক্ষুধার্ত মানুষের থাকে না, তাই তাকে অনাহারেই থাকতে হয়।

একদল গবেষক আবার ক্ষুধা এবং দারিদ্রকে আলাদা করে অপুষ্টির কারণ ব্যাখ্যা করছেন। এমন ব্যাখ্যা শাসকদের দ্বারা খুব প্রশংসিতও হচ্ছে। হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ এর দ্বারা ক্ষুধার আসল কারণটিকে আড়াল করে ক্ষুধার্ত মানুষের উপরেই তার দায় চাপিয়ে দেওয়া যায়। এই পণ্ডিতদের বক্তব্য, এই ক্ষুধা, এই অপুষ্টির কারণ দারিদ্র নয়। কারণ, দরিদ্র মানুষ নাকি হাতে পয়সা পেলে খাবার কেনার আগে মোবাইল, কেবল টিভির পিছনে খরচ করে। তারা নাকি খাবার না কিনে আগে শ্যাম্পু কেনে। কে নাকি এই গবেষকদের বলেছে, ‘রোজ একটা ডিম খেলাম কি না সেটা তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু শ্যাম্পু করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’ অর্থাৎ এই যাদের মানসিকতা তাদের তো অপুষ্টি হবেই! সরকার আর কী করবে! ধনীর সন্তানের খাদ্যগ্রহণে অনীহার কারণে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে যাওয়ার উদাহরণ টেনে এনে এঁরা দরিদ্রের সন্তানের অনাহারের অপুষ্টিকে ব্যাখ্যা করেন! উদোর দায় বুদোর ঘাড়ে ফেলা আর কাকে বলে! গরিব মানুষ যদি সত্যি অসচেতনই হন, তাঁদের এই অসচেতনতার দায় কি সরকার এবং মিডিয়া হাউসগুলোর উপরও বর্তায় না? সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা জাগাতে না পারলে তারা এতদিন কী করেছেন? তার চেয়েও বড় কথা এবং আসল কথা, গরিব মানুষকে ডিম এবং শ্যাম্পুর মধ্যে যে কোনও একটা বেছে নিতে হবে কেন? কেন তাদের মোবাইল খরচ, কেবলের খরচ মেটানোর পর খাবারের খরচ অবশিষ্ট থাকবে না? যখন এক একটা নির্বাচন আসে, পাতা জোড়া, রাস্তা জোড়া বিজ্ঞাপনে এবং বত্তৃতায় এঁরা প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেন, জনগণের সব দুঃখ-দুর্দশা দূর করে উন্নয়নে মুড়ে দেওয়ার গল্প শোনান। আর ভোট চলে গেলে তখন দারিদ্র, অপুষ্টি-ক্ষুধার দায় হয়ে যায় জনগণের! তাদের বোঝানো হয়– তোমরা সচেতন নও, তোমাদের পুষ্টি-অপুষ্টি জ্ঞান নেই, তোমরা নিজেদের ভাল নিজেরা বোঝ না। তোমাদের ভাল কে করবে! শাসকের এই চালাকি অবশ্য নতুন নয়। স্বাধীনতার বছর কয়েক আগে যখন বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখনও সিনেমা হলের সামনে ভিড় দেখিয়ে ব্রিটিশ শাসকের তাঁবেদার একদল লোক ‘কোথায় অভাব, মানুষ দিব্যি সিনেমা দেখছে’ গোছের যুক্তি করার চেষ্টা করতেন। শাসকের রঙ বদলেছে, ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।

কেউ কেউ আর একটু ভারিক্কি চালে বলেন। এই ক্ষুধা-অপুষ্টির জন্য তাঁরা দায়ী করেন সামাজিক অসাম্য, অসম বণ্টন, সরকারি নীতির ব্যর্থতাকে। অর্থাৎ সরকারের সদিচ্ছা বা নীতিতে গলদ নেই, যা-কিছু গলদ বা ব্যর্থতা তা ওই নীতি কার্যকর করাতেই। যেন সামাজিক অসাম্য আকাশ থেকে পড়া কোনও বিষয়! সম্পদের অসম বণ্টন যেন নিয়তির খেলা! অর্থাৎ সমীক্ষা, গবেষণা, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ যা-ই হোক না কেন, সবেরই উদ্দেশ্য আসলে নানা অজুহাতকে যুক্তির মোড়কে সাজিয়ে পরিবেশন করা। স্বভাবতই সংবাদপত্রে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এ-সব ফলাও করে প্রচার করা হয়। যাতে সযত্নে আড়াল করা যায় ক্রমবর্ধমান অনাহার-অর্ধাহারের আসল কারণ এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে– ব্যক্তিমালিকানা এবং শোষণই যে-ব্যবস্থার ভিত্তি, যে-ব্যবস্থায় অন্যের শ্রম চুরি করা ন্যায্য এবং আইনসঙ্গত। অতিমারিতে যখন কোটি কোটি মানুষ গরু-ছাগলের মতো বিনা চিকিৎসায়, বিনা ওষুধে মরে, কোটি কোটি মানুষ লকডাউনে কাজ হারিয়ে পরিবার নিয়ে পথে বসে ঠিক তখনই এই ব্যবস্থার গুণে একদল পুঁজিপতি অবিশ্বাস্য রকমের মুনাফা করে। অর্থাৎ বেশির ভাগ মানুষকে অনাহারে রেখে মুষ্টিমেয় মালিকের মুনাফা করার মতো সমস্ত সুযোগ এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছে। এই অন্যায় বৈষম্যই শাসক শ্রেণির বেঁচে থাকার উৎস। এর উপরই নির্ভর করে আছে তাদের অস্তিত্ব, সম্পদ, ঐশ্বর্য, যাবতীয় ভোগ-বিলাস। অন্যের শ্রম চুরি করে যেমন তাদের মুনাফা, তেমনই বিরাট একটা সংখ্যায় মানুষকে খাদ্য থেকে বঞ্চিত করে, ক্ষুধার্ত রেখেই তাদের সম্পদ-বৈভব। তাই ক্ষুধার্ত মানুষের দিকে কখনও কিছু খুদ-কুঁড়ো ছুঁড়ে দিলেও এই শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ ক্ষুধা। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার, পুঁজিপতি শ্রেণির অস্তিত্বের সঙ্গেই তা জড়িয়ে রয়েছে।

ক্ষুধার্ত মানুষকে আজ পরিষ্কার বুঝে নিতে হবে, ক্ষুধার কারণ হিসাবে শাসকরা যত কারণই দেখাক, তার আসল কারণটি যে শোষক-শোষিতে বিভক্ত এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, তা তারা কখনওই প্রকাশ হতে দেবে না। তাই ক্ষুধা নিয়ে যত তথ্য, যত করুণ রিপোর্টই সামনে আসুক, শাসকের অন্যায় শোষণ, অপশাসনের গায়ে তা একটি আঁচড়ও কাটতে পারে না। এই কারণেই সাম্প্রতিক ক্ষুধা-রিপোর্টে শিশুদের মর্মান্তিক চিত্র প্রকাশ পাওয়ার পরেও মিড ডে মিল প্রকল্পে প্রাথমিক এবং উচ্চ প্রাথমিক স্তরে জন প্রতি বরাদ্দ ৪৮ ও ৭২ পয়সার মতো লজ্জাজনক পরিমাণে বাড়াতে শাসকদের হাত কাঁপেনি। কোটি কোটি মানুষকে ক্ষুধার্ত রেখে লক্ষ লক্ষ টন চাল-গম-বার্লি মদ কোম্পানিগুলির হাতে তুলে দেওয়ার মতো অমানবিক কাজ তারা অনায়াসে করতে পেরেছে। কাজেই এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে আড়াল করে, একে সমূলে উৎপাটন না করে দারিদ্র-অপুষ্টি-অনাহার কমানোর কোনও বাস্তব পথ মানুষের সামনে নেই। এই ব্যবস্থা যতদিন অটুট থাকবে, ততদিন সমাজে ক্ষুধাও থাকবে শুধু নয়, ক্রমশ বাড়বে অনাহারে মৃত্যু, ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা। যদি শাসকদের থেকে সামান্য দাবিও আদায় করতে হয় তবে তা ক্ষুধার্ত মানুষের, শোষিত মানুষের সংগঠিত প্রবল গণআন্দোলনের দ্বারাই একমাত্র সম্ভব।