সিঙ্গুর আন্দোলন ছিল কর্পোরেট আগ্রাসন এবং সরকারের মালিক-তোষণ নীতির বিরুদ্ধে

বাজেমেলিয়া হাসপাতাল মাঠে জনসভায় বক্তব্য রাখছেন কমরেড প্রভাস ঘোষ। ৩ নভেম্বর ২০০৬

২০২৩ সালে রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট। সেই দিকে লক্ষ রেখে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি শিলিগুড়ির কাওয়াখালিতে বিজয়া সম্মিলনীতে ভাষণ দিতে গিয়ে সিঙ্গুর প্রসঙ্গ খুঁচিয়ে তোলেন। বস্তুত সিঙ্গুর এখন শাসক ও বিরোধী ভোটসর্বস্ব দলগুলির কাছে একটা রাজনৈতিক ইস্যু। মুখ্যমন্ত্রী শিল্পমহলের আশীর্বাদ পেতে প্রমাণ করতে চাইছেন তিনি শিল্পবিরোধী নন। সিঙ্গুর আন্দোলনের পথ বেয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও তাই আজ অতীতকে ভুলে যেতে চাইছেন। যদিও ভোটের আগে আবার তিনি এর কৃতিত্ব আত্মসাৎ করতে চাইবেন। উল্টোদিকে তৎকালীন শাসক সিপিএম নিজের গায়ের কৃষকবিরোধী দাগ তুলে ফেলতে এবং নিজেকে শিল্পপ্রেমী প্রমাণ করতে সে সময়েই অসার প্রমাণ হওয়া যুক্তিগুলি মানুষকে বিভ্রান্ত করতে আবার তুলে আনছে। দেখাতে চাইছে সেদিনের লড়াইটা যেন শিল্প বনাম কৃষির ছিল।

সিঙ্গুরের লড়াইটা কি শিল্প বনাম কৃষি ছিল?

না। সিঙ্গুরের লড়াই ছিল এক বর্বর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, যার কল্যাণে কর্পোরেট একচেটিয়া পুঁজির মালিকরা চাইলেই যে কোনও মানুষের জমি, ভিটেমাটি, বনজঙ্গল, প্রাকৃতিক যে কোনও সম্পদকে দখল করতে পারে, মানুষকে যথেচ্ছ উচ্ছেদ করতে পারে। শিল্পের বিরোধিতা সিঙ্গুরের কৃষকরা করেনি। তারা দাবি তুলেছিল, বহুফসলি উর্বর জমিকে শিল্পের নামে ধ্বংস না করে লক্ষ লক্ষ একর অনাবাদী, পতিত, অকৃষি জমিতে শিল্পের পরিকাঠামো গড়ে উঠুক। বন্ধ কলকারখানার হাজার হাজার একর জমি উদ্ধার করে সেখানে শিল্প গড়ূক সরকার। সরকারের কাছে সিঙ্গুরের মানুষের দাবি ছিল শ্রমনিবিড় শিল্প পরিকাঠামোর। তারা চেয়েছিল শিল্প গড়ার নামে অতিরিক্ত জমি কেড়ে নিয়ে সেখানে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার ফন্দি বন্ধ হোক। সেদিন সিঙ্গুর আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সামনে এনেছিল– অত্যন্ত উর্বর বহুফসলি জমি অফুরন্ত নয়। এমন জমি গড়তে লাগে শত শত বছর, নষ্ট করা যায় একদিনে। সিঙ্গুর আন্দোলন সেদিন সুনির্দিষ্টভাবে দেখিয়েছিল, শিল্পায়নের ধুয়ো তুলে হাজার হাজার একর জমি একচেটিয়া দৈত্যাকার পুঁজির মালিকরা দখল করতে চাইছে একদিকে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসার জন্য, অন্য দিকে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষি ফসলের বাজারে নিজেদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য কায়েমের ধূর্ত পরিকল্পনায়। আর তার জন্য সরকার এত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় টাটাদের জমি দিয়েছিল ৪৫ বছরে ৮০০০ টাকা একর হিসাবে। শর্ত ছিল, জল, বিদ্যুৎ, রাস্তা সহ সব পরিকাঠামো বিনা পয়সায় দেবে সরকার। টাটারা বিদ্যুৎ পাবে ৩ টাকা ইউনিট দরে এবং তা ৫ বছর বাড়বে না। যদিও তখন পশ্চিমবঙ্গে গৃহস্থরা বিদ্যুতের দাম দিতেন প্রায় ৬ টাকা প্রতি ইউনিট। টাটাদের ভ্যাট, কর্পোরেট সার্ভিস ট্যাক্স, কর্পোরেট ইনকাম ট্যাক্স সব মকুব হয়েছিল। ১ শতাংশ সুদে ২০০ কোটি টাকা ঋণের ব্যবস্থা ছিল। কথা ছিল তাও তারা শোধ করা শুরু করবে ২১ বছর পর থেকে। অর্থাৎ জনগণের ঘাড় ভেঙে আদায় করা ট্যাক্সের টাকাতেই ব্যবসা করবে টাটারা। টাকা জনগণের, লাভ টাটাদের!

সিঙ্গুরের মানুষ সেদিনই দাবি তুলেছিলেন, ১৮৯৪ সালের সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের জমি অধিগ্রহণ আইন বদলাক সরকার। দাবি ছিল, জনস্বার্থে সরকারকে যদি কোনও জমি অধিগ্রহণ করতেই হয়, শুধু জমির মালিক নয়, বহু দশক ধরে যাঁরা জমির উপর নির্ভরশীল সেই ভাগচাষি ও খেতমজুরদের শুধু ক্ষতিপূরণ নয় তাদের যথাযথ পুনর্বাসন এবং জীবিকার সঠিক ব্যবস্থা করেই একমাত্র তা করতে হবে। সিপিএম পরিচালিত রাজ্য সরকার বলেছিল, টাটার মতো একচেটিয়া মালিকের লাভের জন্য জমি কেড়ে নেওয়াটাই জনস্বার্থ। কারণ তাতে নাকি কর্মসংস্থান হবে। দেশের ছেলেমেয়েরা চাকরি পাবে। যদিও পরে হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তথাকথিত জনস্বার্থের এই অজুহাত খারিজ হয়ে গেছে। আর নৈতিকতার দিক থেকে সিঙ্গুর প্রশ্ন তুলেছিল, অত্যাধুনিক মোটর গাড়ি শিল্পে ১০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে বড়জোর ৩০০ লোকের কাজ হতে পারে। তার জন্য এমন একটি জনবহুল এবং উর্বর কৃষি জমি এলাকাকে বেছে নেওয়া হবে কেন? প্রায় ৩০ হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করে কোন উপকারটি হবে? সরকার উত্তর দিয়েছিল, টাটার বাবু সাহেবদের বাগানের মালি, বাসনমাজার লোক, রান্নার লোক, জুতো পালিশের লোক লাগবে। ওটাও কর্মসংস্থান! সম্পন্ন চাষি এবং জমিতে সোনা ফলিয়ে সচ্ছল খেতমজুর-ভাগচাষিদের জন্য এমন শিল্প-কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাই সরকার করেছিল! সিঙ্গুর তা ঘৃণায় ফিরিয়ে দিয়েছে।

সিঙ্গুরের কৃষক প্রতিরোধ সারা দেশে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে

নন্দীগ্রামের প্রতিরোধ সিঙ্গুরে হল না কেন?

জনমনে এই প্রশ্ন তখন প্রবল ভাবে উঠেছিল যে, নন্দীগ্রামের মানুষ সরকারের প্রবল দমন-পীড়ন মোকাবিলা করে সালেমের জন্য জমির দখল নেওয়া প্রতিরোধ করতে পারলেও সিঙ্গুরের কৃষক আন্দোলন তা পারল না কেন?

২০০৬ সালের ১ ডিসেম্বর সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ শুরু হবে জানতে পেরে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) বাংলা বনধের ডাক দেয়। প্রশাসন জমিতে বেড়া দিতে শুরু করলে দলের উদ্যোগে কৃষকরা ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু তৃণমূল নেতৃত্ব সেই প্রতিরোধ আন্দোলন থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখে। যদিও তাদের সমর্থকরা সরে থাকেননি। ফলে সশস্ত্র পুলিশ, র‍‍্যাফ, কমব্যাট ফোর্স সহ সিপিএম আশ্রিত ক্রিমিনাল বাহিনী চাষিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেদিন সিপিএম সরকারের প্রশাসন চাষিদের উপর যে নির্মম অত্যাচার নামিয়ে আনে তা দেখে সারা দেশের মানুষ শিউরে উঠেছিল। এই নৃশংস অত্যাচারের প্রতিবাদে ৩ ডিসেম্বর রাজ্যের সর্বত্র সড়ক অবরোধ করে ধিক্কার জানায় এস ইউ সি আই (সি)। ৫ ডিসেম্বর বাংলা বনধের ডাক দেয়। তা ব্যাপক ভাবে সফল হয়। এই ভাবে সিঙ্গুরের চাষিরা যখন জীবনপণ করে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলছেন তখনই তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দে্যাপাধ্যায় হঠাৎই ৪ ডিসেম্বর সিঙ্গুর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে কলকাতার ধর্মতলায় অনশন করার কথা ঘোষণা করেন। এতেই তৃণূলের স্থানীয় নেতারা বুঝে যান দলনেত্রী সিঙ্গুরে প্রতিরোধ আন্দোলনে যাবেন না। নেত্রীর এই ভূমিকায় প্রতিরোধ সংগ্রামে ভাটা পড়ে। এই সুযোগে সিপিএম সরকার পুলিশি ঘেরাটোপে জমি পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলে।

রাজভবন চুক্তিকারা ভেঙেছিল

ডিসেম্বর ২০০৬ থেকে আগস্ট ২০০৮, দীর্ঘ ২০ মাস তৃণমূল নেতৃত্ব সিঙ্গুর নিয়ে আন্দোলনের কোনও কর্মসূচি নেননি। তৃণমূল নেতৃত্বের এই ভূমিকায় বারবার হতাশাবাদ আন্দোলনে ছাপ ফেলেছে। এ অবস্থাতেও এস ইউ সি আই (সি) নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেছে সংগ্রামী তেজে সিঙ্গুর আন্দোলনকে দাঁড় করাতে। এই পরিস্থিতিতে নন্দীগ্রামের ধারায় আন্দোলন গড়ে তুলতে এস ইউ সি আই (সি) তৃণমূল নেত্রীকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ে লাগাতার অবরোধের প্রস্তাব দেয়। তাঁর পার্টি অতটা সুসংগঠিত নয়, এই কথা বলে তৃণমূল নেত্রী প্রথমে রাজি না হলেও পরে মাত্র দু’দিনের জন্য রাজি হন। এস ইউ সি আই (সি) প্রথম দিন থেকেই এই কর্মসূচিতে পূর্ণশক্তি নিয়োগ করে। এবং এস ইউ সি আই (সি)-র পরিকল্পনাতেই ধরনা লাগাতার রূপ নেয়। অষ্টম দিনে তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ বত্তৃতা দেন। এক্সপ্রেস ওয়ে অবরোধ সরকারের উপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করে। ১৫ দিনের ধরনা চলাকালে সিপিএম সরকার নতি স্বীকারে বাধ্য হয়। ৭ সেপ্টেম্বর রাজ্যপালের মধ্যস্থতায় সরকার পক্ষ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে ‘রাজভবন চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। বলা হয়, ‘যে কৃষকরা জমির বিনিময়ে ক্ষতিপূরণ নেননি তাঁদের দাবিতে সাড়া দিয়ে বেশিরভাগ জমি প্রকল্প এলাকার মধ্য থেকে এবং বাকি জমি লাগোয়া এলাকা থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।’ চুক্তির পর ধরনা প্রত্যাহৃত হয়।

কিন্তু তারপরই টাটারা ঘোষণা করল, প্রকল্প এলাকা থেকে এক ইঞ্চিও জায়গা ছাড়া যাবে না। শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন মুখ্যমন্ত্রীকে পাশে বসিয়ে ঘোষণা করলেন টাটা প্রকল্পের ভিতর থেকে জমি ফেরত দেওয়া যাবে না। এ ভাবে চুক্তির কালি শুকোবার আগেই সিপিএম সরকার তা ভঙ্গ করার নজির রাখল। গোটা বাংলা এই বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে ধিক্কারে ফেটে পড়ল। জেলায় জেলায় এস ইউ সি আই (সি)-র পক্ষ থেকে চুক্তি কার্যকর করার দাবিতে বিক্ষোভ চলতে থাকল। ১৬ সেপ্টেম্বর সিঙ্গুরে এক সভায় এস ইউ সি আই (সি) নেতা কমরেড সৌমেন বসু বললেন, চুক্তিভঙ্গকারী এই সরকারের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতাই নেই। সিপিএম টাটাদের সাথে যোগসাজশে কৃষক-খেতমজুর-বর্গা চাষিদের সঙ্গে প্রতারণায় নেমেছে। আপনারা সর্বাত্মক প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত হোন।

আন্দোলনের মুড দেখে টাটা গোষ্ঠী যখন বুঝল সিঙ্গুরের চাষিদের এবং পশ্চিমবঙ্গের জনগণের প্রতিরোধ মোকাবিলা করে সিপিএম সরকার তাকে জমি পাইয়ে দিতে পারবে না, তখন ৩ অক্টোবর ২০০৮ তারা ঘোষণা করল সিঙ্গুর ছেড়ে তারা চলে যাচ্ছে। অবশ্য ইতিমধ্যে তলে তলে টাটারা গুজরাটে বিজেপি সরকারের সঙ্গে আরও সুবিধাজনক শর্তের আশ্বাস আদায় করে নিয়েছিল।

জীবন পণ করে প্রতিরোধ গড়েছিলেন সিঙ্গুরের কৃষকরা

সিঙ্গুর থেকে গুজরাটের সানন্দে ন্যানো কারখানা যাওয়ার পর সেখানের অবস্থা কী?

জমিদাতা উত্তর কোটপুরা, ছিরোরি সহ সাতটি গ্রামের মানুষের কিছুই জোটেনি। প্রথম কিছুদিন ৬ থেকে ৭ হাজার টাকায় টাটার কারখানায় তাদের কাজ জুটেছিল। এখন টাটারা স্থানীয়দের আর নেয় না। বেশিরভাগ কর্মীই সেখানে কন্ট্রাকচুয়াল। তাদের গড় বেতন ১০ হাজার টাকার বেশি নয়। যে জমি দিয়ে গ্রামের মানুষ ২০ লক্ষ টাকা পেয়েছে বলে বিজেপি প্রচার করে, সেই জমি এখন প্রোমোটাররা বেচছে ৫ কোটি টাকায়। গ্রামের মানুষের পানীয় জল, বিদ্যুৎ নেই। নর্মদা নদীর জল টাটার উপনগরীতে পৌঁছালেও গ্রামের বাসিন্দাদের সে জল পাওয়ার রাস্তা বন্ধ। কোটপুরার ১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলও বন্ধের পথে। কারণ স্থানীয় বাসিন্দারা বেশিরভাগ পরিযায়ী শ্রমিকের দলে নাম লিখিয়েছেন (এনডি টিভি, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৭)। সানন্দে যে ন্যানো কারখানা হল, কেন তাতে আজ লালবাতি জ্বলছে? কেন জামসেদপুরে টাটার ইস্পাত কারখানাতেও উৎপাদন শক্তিকে অলস করে রাখতে হচ্ছে? উৎপাদনের শিফট কমাতে হচ্ছে? তবুও সিপিএম নেতারা পুরনো বুলিই আওড়ে যাচ্ছেন।

সিঙ্গুরের কৃষক আন্দোলন কি শিল্প বিরোধী ছিল?

শিল্পের জন্য জমি প্রয়োজন। কিন্তু জমি পেলেই কি শিল্পপতিরা শিল্প করে? রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রকের তথ্য বলছে, ২০১৭ থেকে ২০২১ পর্যন্ত রাজ্যে ৫৮৩টি সংস্থাকে গড়ে ৫.৯ একর, অর্থাৎ ৬ একর করে জমি দেওয়া হয়েছে (আনন্দবাজার পত্রিকাঃ ১৮-০২-২০২১)। কটা শিল্প তারা করেছে? সিপিএম আমলে রাজ্যে ৫৬ হাজারেরও বেশি কল-কারখানা বন্ধ হয়েছে। এখন তা আরও ১০ হাজার বেড়েছে। ২০১৯ সালের ২ জুলাই কেন্দ্রীয় সরকার লোকসভায় জানিয়েছিল, সারা দেশে ৬ লক্ষ ৮০ হাজারেরও বেশি রেজিস্টার্ড কারখানা বন্ধ। মহারাষ্ট্রে বন্ধ ১ লক্ষ ৪২ হাজার কারখানা, দিল্লির আশপাশ মিলিয়ে বন্ধ ১ লক্ষ ২৫ হাজার কারখানা। গুজরাটে বন্ধ ৩০ হাজারের বেশি। এ সব কারখানা কি আন্দোলনের জন্য বন্ধ হয়েছে? স্পেশাল ইকনমিক জোন (সেজ)-এর জন্য অধিগ্রহণ করা ৫৯ হাজার একরেরও বেশি জমি অব্যবহৃত পড়ে আছে। শুধু গুজরাটেই সেজের জমি পড়ে আছে ১৫ হাজার ৬৪২ একরেরও বেশি। সেগুলিতে শিল্প হয়নি কেন? পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে বন্ধ কারখানার জমি ছাড়াও অনুর্বর এবং এক ফসলি জমিতে শিল্প হতে পারে। অনুর্বর এলাকার চাষি এবং জমিতে বসবাসকারী সমস্ত পরিবারকে উপযুক্ত দাম, জীবন-জীবিকার গ্যারান্টি সহ সঠিক পুনর্বাসন দিলে, শিল্পে নিয়োগের সুযোগ দিলে তারা জমি দেবে না এমন কথা শোনা যায়নি। বরং জমি পেয়েও শিল্পপতিরা শিল্প গড়েনি। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর, পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনিতে জিন্দালরা ৫ হাজার একর জমি নিয়ে ফেলে রেখেছে। বেশিরভাগ শিল্পপতিরই জমি নিতে যতটা আগ্রহ, শিল্প গড়তে তার কানাকড়ি পরিমাণও দেখা যায়নি। আসলে শিল্পায়নের নামে বেশি বেশি জমি পুঁজিপতিরা পেতে চায় রিয়েল এস্টেট ব্যবসার জন্য। শিল্পায়নের ধুয়ো তুলে এ হল জমি হাতানোর এক ধূর্ত কৌশল।

শিল্পসঙ্কটের মূল কারণ কী?

শিল্পসঙ্কটের প্রধান কারণ, বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটির নিজস্ব সঙ্কট–বাজারসঙ্কট। অর্থাৎ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অভাব। বর্তমানে খাদ্যপণ্য, শিক্ষা, চিকিৎসার খরচ ইত্যাদি এত বেশি যে, সিংহভাগ মানুষের শিল্পপণ্য কেনার সামর্থ্য নেই। ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশে মাত্র ৮ কোটি ৪০ লক্ষ লোকের কিছু ভোগ্যপণ্য কেনার ক্ষমতা আছে। এইটুকু ক্রয়ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে কি লাগাতার শিল্পায়ন হতে পারে? জনগণের এই আর্থিক দুর্দশা তৈরি হয়েছে এবং বেড়ে চলেছে পুঁজিবাদের শোষণ-বঞ্চনার নিয়মেই।

তা হলে পুঁজিবাদের এই মুমূর্ষু স্তরে শিল্পায়ন কর্মসংস্থানের যে সঙ্কট তার সমাধান কোথায়?

পুঁজিবাদের এই মুমূর্ষু স্তরে আঠারো-উনিশ শতকের মতো ব্যাপক শিল্প হতে পারে না। বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত একটা দুটো শিল্প এখানে সেখানে হতে পারে। এ যুগে শিল্পপতিরা শ্রমিকনির্ভর শিল্প বন্ধ করে যন্ত্রনির্ভর শিল্প গড়ায় খুবই তৎপর। কারণ তাতে পুঁজিপতিদের মুনাফা বাড়ে বিপুল হারে, কিন্তু সঙ্কুচিত হয় কাজের সুযোগ। এই যে সমস্যা– এর সমাধান পুঁজিবাদী রাস্তায় নেই। সেজন্যই তো পুঁজিবাদ উচ্ছেদের সংগ্রাম। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সংগ্রাম। এই কঠিন কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজটি বাদ দিয়ে হবে না। একে এড়িয়ে আজ শিল্পায়ন-কর্মসংস্থানের সঙ্কট সমাধান করা যাবে না।

এই বর্বরতাকে ধিক্কার জানিয়েছিল সারা দেশ