৯ বছরের ছেলেটা ‘স্বাধীনতা’র মানে বুঝল রক্তের নোনতা স্বাদে

স্বাধীনতার ৭৫ বছর যেদিন পালিত হচ্ছে মহা ধুমধামে, তার ঠিক আগের দিন অত্যাচারের দগদগে ক্ষত নিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল ইন্দ্র মেঘওয়াল, রাজস্থানের ৯ বছরের এক স্কুল-ছাত্র। দলিত পরিবারের সন্তান ইন্দ্রের অপরাধ, তেষ্টা পাওয়ায় সে উচ্চবর্ণের জন্য নির্দিষ্ট কলসি থেকে জল খেয়ে ফেলেছিল। উচ্চবর্ণের শিক্ষক প্রচলিত প্রথায় তাকে সবক শেখাতে নির্বিচারে চড়-থাপ্পড় মারায় ছিঁড়ে গেল কানের শিরা। স্বাধীনতা দিবসে স্কুলের বন্ধুদের সাথে তেরঙা পতাকা তোলার সাক্ষী হওয়া আর হল না ইন্দ্রের। ১৫ দিন নানা হাসপাতাল ঘুরে অবশেষে ১৪ আগস্ট আহমেদাবাদের এক হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে তার পাঞ্জা কষা শেষ হল।

একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও তেষ্টার জল খাওয়ার অপরাধে কিশোর ইন্দ্রের মর্মান্তিক মৃত্যু বেশ কিছু প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেল, কতটা মানবিক, আদৌ কতটা সামাজিক হতে পেরেছে এ দেশের মানুষ? মহাকাশে রকেট পাঠানোর গর্ব করেন দেশের যে নেতারা, তাঁরা মানুষের মধ্যে থাকা জাতপাত, অস্পৃশ্যতার বীজকে, বিদ্বেষের বিষকে কতটুকু তুলে ফেলতে সফল হয়েছেন?

শুধু রাজস্থান তো নয়, সমাজ জুড়েই জাতপাতের এই ভেদাভেদ আজও অটুট। তেমনই অটুট নিম্নবর্ণের প্রতি উচ্চবর্ণের মানুষের অগুণতি অত্যাচারের ঘটনাও। বিজেপি ক্ষমতায় বসার পর তা আরও উচ্চমাত্রা পেয়েছে। নিম্নবর্ণ, দলিত কিংবা মুসলিমরা যেন মানুষই নয়, তাদের পাওনা পদে পদে অবমাননা। স্বাভাবিকভাবেই মেঘওয়াল ঘরের ছেলেদের পড়াশোনা, চাকরির ক্ষেত্রে সুযোগ কম। স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায় যারা, তাদের স্কুলের মেঝে পরিষ্কার করা, নানা ফাইফরমাশ খাটা, এ সব কাজেই সাধারণত নিয়োগ করা হয়। উচ্চবর্ণের মানুষের সাথে মেলামেশাও বারণ। উচ্চবর্ণের কোনও হিন্দু ছেলে নিম্নবর্গের কোনও হিন্দু ছেলের সাথে বন্ধুত্বও করতে পারে না, তাকে বাড়িতে ডাকতে পারে না। এই ভেদাভেদ স্বাধীনতার সাড়ে সাত দশকেও দূর হল না। শাসকদের সমর্থন ছাড়া এ জিনিস কি সম্ভব?

রাজস্থানের এই গ্রামের মতো দেশের নানা গ্রামে, স্কুলে-কলেজে, বাড়ির মধ্যে সর্বত্র দলিতরা ভয়ে ভয়ে জীবন যাপন করে। দলিত হওয়ার অপরাধে বাড়ির কিশোরীকে তুলে নিয়ে গিয়ে দিনের পর দিন গণধর্ষণ চলে, যুবকদের পিটিয়ে খুন করা হয়, কিংবা দড়ি দিয়ে বেঁধে উলঙ্গ করে পিটিয়ে সোসাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট করা হয় সোৎসাহে। পুলিশ-প্রশাসন উচ্চবর্ণের প্রভাবশালীদের কথাই শোনে, তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর পর্যন্ত নেয় না। দেখা যাচ্ছে, প্রতি দশ মিনিটে এক জন দলিতের উপর আক্রমণ হচ্ছে দেশে। ২০২০-তেই শুধু ৫০ হাজারের বেশি দলিত মানুষের উপর হিংসা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৩,৩৭২টিই ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা, ১১১৯টি হত্যার চেষ্টা ও ৮৫৫টি হত্যার ঘটনা। এটা তো শুধু নথিভুক্ত। অনথিভুক্ত যে এর থেকে বেশি তা বলা বাহুল্য। এনসিআরবি-র রিপোর্ট বলছে, ১৯৯১-২০২০তে ৭ লাখের বেশি দলিতের উপর অত্যাচার হয়েছে, এর মধ্যে ৩৮ হাজারের বেশি দলিত মহিলা ধর্ষিতা হয়েছেন।

স্বাধীনতার পর থেকে সরকার বদল হয়েছে বহুবার, কিন্তু দলিতদের এই দুর্ভাগ্যের বদল হয়নি। কেন এর বদল হল না? আসলে দুর্বলতাটা থেকে গিয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যেই। ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসকামী ধারার নেতারা স্বাধীনতা আন্দোলনকে শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক আন্দোলন হিসাবেই দেখেছিলেন। দীর্ঘ সামন্তী শাসনে জাতপাত, ধর্মবর্ণে বিদ্বেষ-বিভাজনের যে ক্লেদ সমাজ জুড়ে জমা হয়েছিল, তাকে মুছে ফেলার জন্য যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দরকার ছিল, তাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। কংগ্রেসের গান্ধীবাদী নেতারা বেশিরভাগই এসেছেন তথাকথিত উচ্চবর্ণ থেকে। তাঁরা উচ্চবর্ণজনিত গর্ববোধ থেকে মুক্ত ছিলেন না। স্বাধীনতা আন্দোলন জাতপাত-ধর্মবর্ণের সাথে প্রধানত আপস করেই পরিচালিত হয়েছিল। হিন্দুধর্মীয় প্রভাবে আচ্ছন্ন ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদ। সমাজের রন্ধে্র রন্ধে্র অটুট থেকে গিয়েছিল কুসংস্কার, অস্পৃশ্যতা, নানা কু-প্রথা। গান্ধীজির মতো কিছু নেতা অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধতা করলেও তাকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করার কোনও উদ্যোগ কংগ্রেস নেয়নি। স্বভাবতই সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কাজ থেকে গিয়েছে চরম অবহেলিত। স্বাধীনতার পরও স্বাভাবিক ভাবেই এ কাজে কোনও উদ্যোগ নেননি সরকারি নেতা-মন্ত্রীরা। দলিতদের, পিছড়ে বর্গের মানুষকে ভোটের বোড়ে হিসাবে ব্যবহার করা ছাড়া এবং জাতপাত-ধর্মবর্ণের বিদ্বেষকে মদত দেওয়া ছাড়া আর কিছু করেননি তাঁরা। এখন দলিত ছাত্রের মৃত্যুর পর তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলে সহানুভূতি কুড়নোর চেষ্টা করছেন কংগ্রেসের নেতারা। দলিতদের উপর সীমাহীন নিপীড়ন যে আজও টিকে থাকতে পারল তার জন্য তাদের অনুসৃত নীতিই কি দায়ী নয়?

আর বিজেপির অ্যাজেন্ডাই তো ‘হিন্দু, হিন্দি, হিন্দুস্তান’, দেশটাকে সামাজিক, রাজনৈতিক ভাবে সম্পূর্ণ ‘হিন্দু’ রাষ্ট্রে পরিণত করা। এই হিন্দুরাষ্ট্রের হিন্দু কোনও নিম্নবর্ণের দলিত নয়, শুধুমাত্র উচ্চবর্ণ। মনু সংহিতার বিধান অনুসারী বিজেপি নেতারা চায় উচ্চবর্ণের আধিপত্য। আর নিম্নবর্ণের মানুষেরা থাকবে তাদের সেবক হিসাবে। এই চিন্তার ভিত্তিতেই তাদের সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। নতুন শিক্ষানীতি প্রচলন, নতুন করে ইতিহাস রচনা, পাঠ্যপুস্তকে বিষয়বস্তু নির্বাচন– সবই সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে। পাশাপাশি শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক সেবক হিসাবে তাদের লক্ষ্য, ধর্ম-বর্ণকে ভিত্তি করে মানুষে মানুষে বিভেদকে জিইয়ে রাখা। তা হলে শাসকদের জনবিরোধী নীতিগুলি কার্যকর করতে সুবিধা। জনসাধারণ যদি নিজেদের মধ্যে বিদ্বেষ-বিভেদে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে তবে এর বিরুদ্ধে একজোট হয়ে প্রতিবাদ করবে কী করে? ব্রিটিশের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির রূপায়ণ স্বাধীন ভারতের শাসকরা এভাবেই ঘটিয়েছে। এখন রাজস্থানে কংগ্রেস পরিচালিত সরকারের বিরুদ্ধে সোরগোল ফেলে দিয়ে বিজেপি নেতারা প্রমাণ করতে ব্যস্ত তারা কত দলিত-দরদি!

স্বাধীনতার আগে বি আর আম্বেদকর জনগণের টাকায় তৈরি মহারাষ্ট্রের মহাদ-এ চাভদর লেক থেকে দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের জল নেওয়ার অধিকারের দাবিতে ১৯২৭ সালে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। উচ্চবর্ণের প্রভাবশালীরা ব্যাপক অত্যাচার নামিয়ে এনেছিল এই আন্দোলনের উপর। কিন্তু কংগ্রেসের নীতির পরিণতিতে দলিতদের মর্যাদা অর্জনের লড়াইটি স্বাধীনতা আন্দোলনের সামগ্রিক লড়াইয়ের অংশ হতে পারল না, তা একটি বিচ্ছিন্ন আন্দোলনে পরিণত হল। সেদিন এই লড়াইটা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নিষ্ঠুর শোষণ থেকে ভারতবাসীর মুক্তির লড়াই। একই সাথে তা ছিল ক্ষমতা দখল করতে চাওয়া ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণির বিরুদ্ধে খেটেখাওয়া মানুষের লড়াই। এতে ধর্ম-বর্ণ-জাত নির্বিশেষে সকল খেটেখাওয়া মানুষের স্বার্থ নিয়োজিত ছিল। তাই জাতপাত বিরোধী লড়াই স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশ হিসাবেই আনা দরকার ছিল। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব যেমন সামাজিক এই আন্দোলন থেকে দূরে থাকল তেমনই আম্বেদকর শুধু দলিতদের অধিকার অর্জনের জন্য আলাদা করে লড়াইয়ের কথা বললেন এবং সিডিউল কাস্ট ফেডারেশন গড়ে তুললেন। এতে কার্যত একদিকে জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে ফাটল ধরল, উচ্চবর্ণের প্রাধান্য আরও দৃঢ় হল। তিনি পুঁজিবাদী শোষণযন্তে্রর গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত কাটতে পারলেন না এবং অস্পৃশ্যতাও অটুট থাকল।

স্বাধীন ভারতে জাতপাত-অস্পৃশ্যতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে আইনে গৃহীত হলেও তাতে দলিত, নিম্নবর্গের মানুষের উপর অত্যাচার বন্ধ হল না। ১৯৫৫-তে প্রোটেকশন অব সিভিল রাইটস, প্রিভেনশন অফ অ্যাট্রোসিটিস অ্যাক্ট ইত্যাদি গালভরা নানা আইন এনেছে সরকার। কিন্তু দলিতদের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়নি।

বিএসপি, আরজেডি, জেডিইউ সহ দলিত বা নানা জাতের স্বার্থের দাবিদার নানা দল এই বঞ্চনাকে ক্ষমতায় বসার সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করেছে। সিপিএম, সিপিআই প্রমুখ বামপন্থী নামধারী দলগুলি মুখে জাতপাতের বিরোধিতা করলেও এর বিরুদ্ধে কোনও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেনি। নকশালপন্থী দলগুলি আবার জাতপাতের লড়াইকে ‘শ্রেণিসংগ্রাম’ আখ্যা দিয়ে এই লড়াইকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। দলিতদের ভোটার হিসেবে ব্যবহার করেছে। ফলে লড়াইয়ের সঠিক দিশা না পেয়ে দলিত সহ নিম্নবর্ণের মানুষেরা এই শোষণমূলক রাষ্ট্রের জাঁতাকলে পিষ্টই হয়ে চলেছে।

তাদের এই শোষণ যন্ত্রণা, অবমাননা থেকে মুক্তির যথার্থ পথ দেখালেন এ যুগের মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর প্রতিষ্ঠাতা কমরেড শিবদাস ঘোষ। তিনি বললেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলিকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দাবি আদায়ের কর্মসূচির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কাজ পূরণ করার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে, যা আমাদের দেশে আজও অপূরিত আছে। জাতপাত-ধর্মবর্ণ প্রভৃতি সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার যে অবশেষগুলি আজও সমাজে রয়ে গেছে, এগুলির বিরুদ্ধে বুর্জোয়ারা আজ আর কোনও আন্দোলন তো করবেই না, উপরন্তু এগুলিকে কাজে লাগিয়ে তারা ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করছে। তাই এই আন্দোলনকে আজ পুঁজিবাদী শোষণের জোয়াল থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে পরিচালিত শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামের সাথে যুক্ত করতে হবে।

পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে আপামর শোষিত শ্রেণির যে লড়াই তার সাথে জাতপাত, ধর্মবর্ণ, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনকে যুক্ত না করা গেলে আবারও ঘোড়ায় চড়ার অপরাধে, সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার অপরাধে, উচ্চবর্ণের জন্য নির্দিষ্ট পাত্রের জল খাওয়ার অপরাধে ইন্দে্রর মতো কিশোরদের অকালমৃত্যু ঘটতেই থাকবে, মা-বোনেরাও ধর্ষিতা হতেই থাকবেন। আমরাও দর্শক হয়েই থাকব একের পর এক মর্মান্তিক ঘটনার।