ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদীদেরই লড়াই — ইউক্রেন কমিউনিস্ট পার্টি

ইউক্রেন সরকারের দ্বারা নিষিদ্ধ ইউক্রেনের কমিউনিস্ট পার্টি ‘দ্য ইউনিয়ন অফ কমিউনিস্টস ইউক্রেন’ (ইউসিইউ)-এর মতে, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ হল দুটি সাম্রাজ্যবাদী জোটের দ্বন্দ্বের পরিণাম। যার একটির নেতৃত্ব দিচ্ছে আমেরিকা, অপরটির রাশিয়া। উভয় জোট যুদ্ধের যে কারণগুলি দেখাচ্ছে তার তীব্র বিরোধিতা করেছে ইউক্রেনের কমিউনিস্ট পার্টি।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রাশিয়া যে বলছে, এই যুদ্ধ ‘রাশিয়ার জনগণের স্বার্থে’, ‘ইউক্রেনে বসবাসকারী রুশভাষী জনগণের সুরক্ষার স্বার্থে’ বা ‘ইউক্রেন রাষ্ট্রের নাৎসিকরণ রুখতে’– ইউসিইউ তা নস্যাৎ করছে। ইউসিইউ-র মূল্যায়ন, রাশিয়ার পুঁজির স্বার্থেই এই যুদ্ধ, যার মধ্য দিয়ে বিশ্বে উদ্ভূত নতুন পরিস্থিতিতে রাশিয়া তার পুঁজির বৃদ্ধি এবং অধিক মুনাফার সুযোগ তৈরির চেষ্টা করছে।

অন্যদিকে ইউক্রেন সরকারের বক্তব্য, এই যুদ্ধ ইউক্রেনীয় জাতির স্বার্থে, ইউক্রেনীয় ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা করতে। এই বক্তব্যকেও সঠিক মনে করে না ইউক্রেনের কমিউনিস্ট পার্টি। তাদের বক্তব্য, আমেরিকার নেতৃত্বে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ইউক্রেন এবং উত্তর আমেরিকার পুঁজিপতিদের দ্বারা সংগঠিত এই যুদ্ধের লক্ষ্য–রুশ পুঁজিপতিদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া। ইউক্রেনীয় জনগণের স্বার্থ বা অধিকার আদৌ এই যুদ্ধে বিবেচনাধীন নয়। বরং এই যুদ্ধে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের স্বার্থই বিপন্ন হচ্ছে এবং তারাই ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

এই যুদ্ধে ইউক্রেন এবং রাশিয়া–উভয় দেশের শ্রমিকদের সরকার নির্ধারিত একটাই অধিকার ও কর্তব্য পালন করতে হচ্ছে, তা হল, সম্মুখ সমরে যোগ দেওয়া এবং প্রাণ দেওয়া, যাতে বিশ্ব পুঁজিপতিদের একটি গোষ্ঠী পুঁজিপতিদের অপর একটি গোষ্ঠীকে পরাজিত করতে পারে এবং নিজ দেশ এবং বিজিত দেশের শ্রমিকশ্রেণির উপর শোষণ নিপীড়ন চালানোর একচেটিয়া অধিকার করায়ত্ব করতে পারে।

এই যুদ্ধের থেকে বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণির পাওয়ার কিছু নেই। বরং এই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ সব দেশের সর্বহারা শ্রেণির জীবনে বিপর্যয় নামিয়ে এনেছে। এই যুদ্ধের পরিণাম– ক্ষুধা, দারিদ্র, বেকারত্ব, বেতনহ্রাস, যা ইতিমধ্যেই বিশ্বের সর্বত্র দেখা যাচ্ছে। জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি এই যুদ্ধের প্রত্যক্ষ পরিণাম। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি মুদ্রাস্ফীতি কমানোর নামে মুদ্রার সঞ্চালন নিয়ন্ত্রণ করবে। এর সম্ভাব্য পরিণাম হল, অর্থনীতি মন্দায় নিমজ্জিত হবে, যা বিশ্বব্যাপী শ্রমিক পরিবারে অর্থনেতিক সঙ্কটকে আরও গভীর করবে।

এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইতিমধ্যেই ৫ কোটি মানুষ অনাহারের মধ্যে পড়েছেন। খাদ্যশস্যের সরবরাহ ভেঙে পড়া এবং পরিবহণ খরচ ব্যাপক বেড়ে যাওয়ায় খাদ্যদ্রব্যের মূল্য গরিবের নাগালের বাইরে চলে গেছে। একই সঙ্গে, বেতন না বাড়ায়, মূল্যবৃদ্ধি ঘটায় গোটা বিশ্বের প্রকৃত আয় কমছে।

ইউক্রেনের মাটিতে চলা এই সামরিক সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধিতে স্পষ্ট, এতে উভয় সাম্রাজ্যবাদী জোটের প্রকাশ্য বিরোধই শুধু বেড়ে চলেছে, যার একদিকে রয়েছে রাশিয়া ও তার সহযোগী শক্তিগুলি, অন্য দিকে রয়েছে ন্যাটো। এর একটাই অর্থ– এই যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত আণবিক যুদ্ধে রূপান্তরিত হবে ও মানবসভ্যতায় ধ্বংসের বিপদ নামিয়ে আনবে।

বিশ্বের বাজার, কাঁচামাল, বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা, সামরিক ও কৌশলগত সুবিধাজনক এলাকার দখলদারি কায়েমের লক্ষ্যে পুঁজিপতিদের মধ্যেকার স্থায়ী দ্বন্দ্বই যে সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ– মার্ক্সবাদের এই বুনিয়াদী শিক্ষাকে ইউক্রেনের কমিউনিস্টরা আবারও তুলে ধরছে। পুঁজির প্রতিযোগিতার সঙ্কট যুদ্ধ ডেকে আনে। তাই মানবসভ্যতার ধ্বংস আটকাতে পুঁজির এই দ্বন্দ্বকে নির্মূল করতে হবে।

যুদ্ধের বিরুদ্ধে সংগ্রাম হল সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, কারণ তারাই যুদ্ধ বাধায়। বিবাদমান দুই দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির বিরুদ্ধেই এই সংগ্রাম চালাতে হবে। কখনওই এক দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির বিরুদ্ধে অপর দেশের পুঁজিপতি শ্রেণিকে শ্রমিক শ্রেণি সমর্থন করতে পারে না– যেমন তাদের কারওরই সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রকে অস্বীকার করতে পারে না।

দ্য ইউনিয়ন অফ কমিউনিস্টস অফ ইউক্রেন মনে করে সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে নিছক বিমূর্ত শান্তির স্লোগান বা নিরস্ত্রীকরণ নয়, জরুরি প্রয়োজন হল– পরজীবী এবং ধ্বংসাত্মক সামাজিক ব্যবস্থা হিসাবে পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করা।

সেই লক্ষ্যেই লেনিনের শিক্ষাকে সামনে রেখে তাঁদের প্রস্তাব–এই যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ বা শ্রেণিযুদ্ধে পরিণত কর। রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণির কাছেও এই আহ্বান তাঁরা রেখেছেন।