জবকার্ড হোল্ডাররা কেমন আছেন প্রধানমন্ত্রী জানতে চেয়েছেন কি

ফাইল চিত্র

হিমাচল প্রদেশের সিমলায় এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ফাইল সই করার সময়টুকু বাদ দিলে তাঁর নাকি মনেই থাকে না তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি তখন শুধুই দেশের সেবক, ১৩০ কোটি মানুষের নিরলস সেবক মাত্র।

কী ভাবে তিনি সেবা করেন? তিনি ভিডিও-র মাধ্যমে দেশের নানা প্রান্তে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাছে জানতে চান ওই প্রকল্পগুলির সুফল পেয়ে তাদের জীবন কী ভাবে বদলেছে? এর মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, উজ্জ্বলা, জনধন, আয়ুষ্মান ভারত, স্বচ্ছ ভারত, প্রধানমন্ত্রী কিসান সম্মাননিধির মতো নানা প্রকল্প। এর মধ্যে ১০০ দিনের কর্মসংস্থান প্রকল্পের কথা উল্লেখ নেই কেন? তা বেমালুম ভুলে গেলেন, না কি ভুলে থাকার চেষ্টা করলেন? অন্যান্য যে সব প্রকল্পের সুবিধার কথা প্রধানমন্ত্রী নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে গেলেন, সেগুলির সুবিধা প্রাপকরা কতটা পাচ্ছেন।

প্রধানমন্ত্রী কাদের প্রশ্ন করবেন এবং তার উত্তরে কী বলতে হবে সে সবই আমলারা ঠিক করে দেন। দেশের প্রান্তে-প্রত্যন্তের কৃষকেরা, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ জানেন– এ সব কথা নেতাদের মন্ত্রীদের, প্রধানমন্ত্রীদের বলতে হয় নির্বাচন এলে। হিমাচল প্রদেশেও ৬ মাসের মধ্যে ভোট, তাই প্রধানমন্ত্রীর এই আত্মপ্রচার!

কিন্তু ১০০ দিনের প্রকল্প নিয়ে তিনি চুপ কেন? কারণ এই প্রকল্প থেকে বিজেপি সরকার হাত গুটিয়ে নিয়েছে। ৪৫ বছরে সর্বাধিক বেকারির রেকর্ড গড়া বিজেপির ভারতে রোজগারহীন মানুষ, ছাঁটাই শ্রমিক, বন্ধ চা-বাগানের হাড় জিরজিরে শ্রমিক বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে এই ১০০ দিনের কাজের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। হাড়ভাঙা খাটুনির পর দিনশেষে ২৮০ থেকে ২৮৫ টাকা পেত। তাও বন্ধ হওয়ার পথে। এই প্রকল্প ঘিরে বহু চুরি-দুর্নীতি-দলবাজি থাকলেও তা বাদ দিয়ে তাদের হাতে যেটুকু পয়সা আসত, তাতেই ক’দিন পেটে কিছু পড়ত। মোদি সরকারের ‘দাক্ষিণ্যে’ সেই সুযোগও বন্ধের মুখে।

১০০ দিনের কর্মসংস্থান প্রকল্প কী? ২০০৬ সালে এটি চালু হয়েছিল গ্রামীণ মানুষকে সামান্য হলেও কিছু রোজগারের বন্দোবস্ত করে দিতে। এর মাধ্যমে দেশ জোড়া অর্থনৈতিক সংকটের সর্বগ্রাসী হাঁ-কে একটু নিরস্ত করার আশা ছিল সরকারের। কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ অর্থে রাজ্যে রাজ্যে গরিব মানুষরা এই প্রকল্পের মাধ্যমে রাস্তা তৈরি, মাটি কাটা, কুয়ো খোঁড়া, খাল কাটা, সেচের কাজ কিংবা শৌচালয় তৈরি করার কাজ করে থাকেন। বহু অস্বচ্ছতা থাকলেও এই প্রকল্পে কাজ করে বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১০০ দিন, কোথাও বা ৮০-৯০ দিন কাজ পেয়েও কিছু মানুষ সামান্য হলেও রোজগার করতেন। এতে কম-বেশি ৫ কোটি পরিবারের এক জন্য সদস্যের কাজ জুটত। শ্রমিকদের মধ্যে যখন দাবি উঠছে এই প্রকল্পে বছরে ২০০ দিন কাজ দিতে হবে তখন মোদি সরকার এই প্রকল্পকে আরও দুর্বল করছে। গত বছরের হিসাব অনুযায়ী ন্যূনতম ৯৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের দরকার ছিল এই প্রকল্পে। কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে মাত্র ৭৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে বিজেপি সরকার।

এই প্রকল্পে শুধুই বরাদ্দ কমাচ্ছে না সরকার, উপরন্তু এই প্রকল্প থেকে দেশের দরিদ্র মানুষকে দূরে ঠেলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে নানা কৌশল নিচ্ছে। এই প্রকল্পে কর্মরতদের বিশেষ মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে ছবি সহ হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ জারি করেছে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক। এই নির্দেশিকার ফলে সব কর্মীর অ্যান্ড্রয়েড ফোন থাকা বাধ্যতামূলক, যা বেশিরভাগ গরিব পরিবারের পক্ষে অসম্ভব। এ ছাড়াও স্বল্পশিক্ষিত কর্মীদের পক্ষে ফোনে ইংরেজিতে প্রতিটি ধাপ বুঝে দিনে দু’বার হাজিরা নথিভুক্ত করাও সম্ভব নয়। আর নথিভুক্ত করাতে না পারলে তাদের কাজের সুযোগ বন্ধ, বন্ধ আয়ও।

দীর্ঘদিন থেকেই এই প্রকল্প বন্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে বিজেপি সরকার। কখনও দুর্নীতি দমনের নামে, কখনও কৃষিপ্রধান এলাকায় কৃষিতে মজুর পাওয়া যাচ্ছে না এই অজুহাতে বরাদ্দ বন্ধ করে, মাসের পর মাস টাকা বকেয়া রেখে এই প্রকল্পকে নড়বড়ে করার চেষ্টা করছিল। এখন পশ্চিমবঙ্গেই খালি সাত হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। অন্যান্য রাজ্যগুলিতেও হাজার হাজার কোটি টাকা বকেয়া। কোটি কোটি দরিদ্র মানুষ যারা এই প্রকল্পের সাথে যুক্ত ছিলেন, তারা এক ধাক্কায় পথে বসেছেন। ১০০ দিনের কাজ অনিয়মিত হওয়ায় ‘হাত সম্বল করে’ জমিতে, নির্মাণক্ষেত্রে, পরিযায়ী শ্রমিক, পরিচারিকা, হকার, রাঁধুনির কাজ, এমনকী সেলাইয়ের মতো টুকিটাকি কাজ করে সংসার চালানোর চেষ্টা করতে হচ্ছে এঁদের।

সরকারের কি টাকার অভাব? তাও নয়। প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ে নরেন্দ্র মোদি সরকারের ভারত রয়েছে তৃতীয় স্থানে, আমেরিকা ও চীনের পরে। নেতা-মন্ত্রী-আমলাদের বিলাস-ব্যসনে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়, তবে ১০০ দিনের প্রকল্পেই বা টাকার অভাব হবে কেন?

কয়েক বছর আগে এই প্রকল্প সংকোচনের সর্বনাশা সিদ্ধান্ত সরকার ঘোষণা করার পরপরই তীব্র প্রতিবাদ হয়েছিল। বহু অর্থনীতিবিদ দেশের গরিব মানুষের স্বার্থে তা প্রত্যাহার করার জন্য চিঠি পাঠান স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে। সেই প্রতিবাদ বা দাবির তোয়াক্কা করেনি মোদি সরকার। উল্টে সরকারের এই পদক্ষেপের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী নীতিন গডকরি। তিনি বলেছেন, ‘পাঞ্জাব, হরিয়ানার মতো কৃষিকেন্দ্রিক রাজ্য চাষের মজুর পাচ্ছে না, ফলে রাজ্যগুলিতে কৃষিকাজ করার জন্য তারা দেশের ২০০টি জেলার মধ্যে ১০০ দিনের প্রকল্প সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছেন।’ এটাই হল আসল কথা, যা গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রীর মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। বিপুল কৃষি-মজুরদের বেকারত্বের সুযোগে সস্তায় মজুরদের কাজে লাগিয়ে কিছু সংখ্যক ধনী চাষি বা একচেটিয়া কৃষি-কর্পোরেটদের আকাশছোঁয়া মুনাফার সুযোগ করে দিতেই তাদের এই পদক্ষেপ। একটা ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্টে্র সরকারের যেটুকুও জনকল্যাণমুখী প্রকল্পের সুবিধা জনসাধারণকে দেওয়ার কথা, তার থেকেও হাত গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এইভাবে একটু একটু করে এই প্রকল্পকে নানা অজুহাতে দুর্বল করা হয়েছে। এবারে বাজেটে বরাদ্দ ছাঁটাইয়ে এই প্রকল্প বন্ধের সরকারি অভিসন্ধিই প্রমাণিত হল।