লেখাপড়া শিখে, নিয়ম মেনে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে স্কুলে শিক্ষকতার পেশাকে বেছে নিতে চেয়ে পশ্চিমবঙ্গের হাজার হাজার মেধাবী যুবক-যুবতী আজ প্রতারিত। তাঁদের প্রাপ্য চাকরির নিয়োগপত্র পিছনের দরজা দিয়ে হাসিল করে ফেলেছেন মন্ত্রী-নেতাদের কন্যা-পুত্র-স্বজন এবং দলীয় ‘সম্পদ’রা, অথবা দুর্নীতিচক্রের হাতে হাজার হাজার টাকার প্রণামী গুঁজে দেওয়া অযোগ্য প্রার্থীর দল। নার্সিংয়ের ট্রেনিং নিয়ে যাঁরা স্বচ্ছতার সঙ্গে এই পেশায় আসার স্বপ্ন দেখছিলেন, প্রতারিত তাঁরাও। সেখানেও চলেছে নিয়োগে দুর্নীতি, স্বজনপোষণ। পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরিচালিত সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা নিয়েও জালিয়াতির অভিযোগ। এ যেন বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশের ব্যাপম কেলেঙ্কারির নতুন সংস্করণ! পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বলছেন সিপিএম আমলে নিয়োগ নিয়ে যে স্বজনপোষণ দলবাজি চলত, তার পরিবর্তন দূরে থাক, তা আরও তীব্র আকার নিয়েছে। সারা দেশেই সরকারের গদি আর দুর্নীতির পাঁক যেন এক হয়ে গেছে আজ।
২৯ জুন আইন অমান্যের দাবিসমূহ
|
এদিকে সারা ভারতেই বেকারত্বের জ্বালায় আজ প্রায় প্রতিটি পরিবার। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের একচেটিয়া মালিক তোষণকারী নীতির কল্যাণে বেকারত্বের হার সব সীমা ছাড়িয়ে আরও অনেকদূর এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের কর্মক্ষম মানুষের অর্ধেকের বেশি কর্মহীন। যেটুকু কাজ আছে তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের মতোই রাজ্যে রাজ্যে সব সরকার বলে দিচ্ছে চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী নিয়োগই চলবে। মিলবে না পুরো বেতন, কোনও সামাজিক সুরক্ষা। সরকারের কাজ ক্রমাগত চলে যাচ্ছে বেসরকারি হাতে। ফলে সরকারি দপ্তরে নতুন নিয়োগ দূরে থাক ক্রমাগত পদ বিলোপ করে চলেছে কেন্দ্র এবং রাজ্য দুই সরকারই। কেন্দ্রীয় সরকার রেল, এয়ার ইন্ডিয়া, এলআইসি, বিপিসিএল-এর মতো লাভজনক সংস্থাকে বেচে দিচ্ছে একচেটিয়া মালিকদের হাতে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার বৃহৎ পুঁজিমালিকদের হাতে বেচে দিতে চাইছে সরকারি স্কুল, হাসপাতাল। এখন জনগণের পয়সায় তৈরি জাতীয় সড়ক এবং বড় বড় সেতুর টোল আদায়ের অধিকার পাচ্ছে কর্পোরেট সংস্থা। সারা দেশে বন্ধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং কলকারখানার সংখ্যা ৭ লক্ষ ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলি মিলে কত লক্ষ সরকারি পদ যে খালি তা কখনও তারা সুনির্দিষ্টভাবে বলে না। শুধু কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তরেই সংখ্যাটা ২৪ লক্ষের মতো। এর মধ্যে নতুন করে রেলে ৮০ হাজার পদ বিলুপ্ত করে দিল কেন্দ্রীয় সরকার। পশ্চিমবঙ্গে ১.৫ লক্ষ শিক্ষক ও ২ লক্ষের বেশি সরকারি অফিস কর্মচারীর পদ খালি। শোষণে পিষ্ট জনগণের ক্রয়ক্ষমতা যত কমছে তত বাড়ছে বন্ধ কলকারখানা-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। কিন্তু সরকারি দপ্তরে নিয়োগ না করতে বদ্ধপরিকর সরকার।
জনজীবনের যন্ত্রণাকে বাড়িয়ে এর সাথে যুক্ত হয়েছে প্রতিদিন প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বেড়ে চলা দাম। শুধু পেট্রল-ডিজেল-রান্নার গ্যাসের দাম বেড়েছে তা নয়, কেরোসিনের দাম লিটারে ৩০ টাকা থেকে বেড়ে বছর খানেকের মধ্যেই ৯২ টাকা হয়েছে। ভোজ্য তেল থেকে চাল-ডাল-আটা-ময়দার দাম যা দাঁড়াচ্ছে তাতে পেট-ভরানোর মতো একটু খাবারের সংস্থানেই নিম্নবিত্ত পরিবারের আয়ের সবটা ঢেলে দিয়েও কুলোচ্ছে না। এর সাথে আছে ওষুধের দামবৃদ্ধি, চিকিৎসা খরচের বিপুল বৃদ্ধি, শিক্ষার সমস্ত ক্ষেত্রে ফি বৃদ্ধির আঘাত। বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। গৃহস্থ ঘর থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র শিল্প, চাষি সকলেই এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত।
শিক্ষায় গণতান্ত্রিক পরিবেশের যে ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট ছিল তাকে খতম করার ব্যবস্থা করেছে বিজেপি সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি। আর রাজ্যের তৃণমূল সরকার রাজ্যপালের অসহযোগিতার দোহাই দিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রীকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্যের চেয়ারে বসিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল স্তর থেকে ওঠা ধিক্কারে কান দেওয়ার মতো চক্ষুলজ্জাটাও তারা ঝেড়ে ফেলেছে। অথচ রাজ্যপাল, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী বা এই ধরনের সরকারি কর্তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে নাক গলাবেন কেন, কোন অধিকারে? সে জবাব রাজ্য সরকার দেয়নি। শিক্ষা পরিচালনা করবেন শিক্ষাবিদরা, শিক্ষক-ছাত্র-শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্বাচিত কোনও বডি তাঁদের সাহায্য করবে, মতামত দেবে। সরকারের কাজ শুধু শিক্ষাকে অবাধ করার জন্য অর্থ জোগান দেওয়া। এ দেশের স্বাধীনতার সময় থেকে ওঠা শিক্ষানুরাগী মানুষের এই দাবিকে সরকারগুলি নস্যাৎ করে দিচ্ছে।
এ রাজ্যের জেলায় জেলায় চাষিরা ধান নিয়ে মাণ্ডিতে গেলে অফিসাররা ফিরিয়ে দিচ্ছে তাদের। চাষি বাধ্য হচ্ছে নামমাত্র দামে ফড়েদের কাছে ধান বেচতে। অথচ ফড়েরা ওই চাষিদের নামেই মিথ্যা রেজিস্ট্রেশন করে সহায়ক মূল্যে ধান বিক্রি করছে সরকারকে। পাট বিক্রি নিয়েও চলেছে এইরকম অসাধু কারবার। এ রাজ্যে আলুচাষি, পাটচাষি, পানচাষি থেকে শুরু করে প্রায় সমস্ত চাষের ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিরা ফসলের দাম না পেয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। হাজার হাজার চাষি প্রতি বছর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন। কেন্দ্রীয় সরকার কৃষিকে পুরোপুরি একচেটিয়া মালিকদের হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে তিনটি কৃষি আইন এনে আন্দোলনের চাপে আপাতত পিছিয়ে গেলেও নানা কায়দায় একই নীতি চালুর চেষ্টা করে যাচ্ছে। একইভাবে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস সহ সমস্ত রাজ্যের শাসক দল নানা কায়দায় কৃষিকে একচেটিয়া মালিকদের অবাধ বিচরণের ক্ষেত্র করে দিতে চেষ্টা করে চলেছে। এর ফলে যেমন মরছে সাধারণ চাষি, একই সাথে এই ক্ষেত্রে বৃহৎ পুঁজির কারবারের ধাক্কায় বাজারের সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে ক্ষুদ্র ক্রেতা সকলেই অর্থনৈতিক আক্রমণের শিকার।
গ্রাম-গঞ্জ, শহরে সরকারি দল এবং পুলিশ ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদতে গড়ে উঠেছে নানা কারবারের অসাধু সিন্ডিকেট। তোলা আদায় থেকে বেআইনি নানা কারবারের সাহায্যে তারা ফুলে ফেঁপে উঠছে। এদের মধ্যে এলাকা দখলের কাড়াকাড়িতে বীরভূমের বগটুইয়ের গণহত্যার মতো ঘটনা বারবার ঘটছে। মাফিয়া আর মদ্যপদের দৌরাত্মে্য নারী নির্যাতন প্রতিদিনের ঘটনায় দাঁড়িয়েছে। বিজেপির শাসনে যেমন উত্তরপ্রদেশে হাথরস, উন্নাও, জম্মুর কাঠুয়ায় গণধর্ষণ এবং হত্যা চলছেই, এ রাজ্যেও হাঁসখালি, বারাসাত, ধূপগুড়ির ভয়াবহ ঘটনার স্রোত থামছে না। পুলিশ প্রশাসন এমনকি সরকারের শীর্ষ কর্তারাও দোষীদের ধরার থেকে ব্যস্ত থাকেন অভিযুক্তদের আড়াল করতে।
প্রতিবাদের মেরুদণ্ড ভাঙতে তৎপর পুলিশ কখনও আনিস খানদের মতো প্রতিবাদী যুবকদের হত্যা করছে, কখনও প্রতিবাদীদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে জেল খাটাচ্ছে। বিজেপি সরকারও যে কোনও প্রতিবাদী মানুষের বিরুদ্ধেই দেশদ্রোহের অভিযোগ এনে বিনা বিচারে তাদের জেলবন্দি রাখার ব্যবস্থা করছে। একই সাথে কেন্দ্রের বিজেপি এবং রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার মানুষ গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটাকেই মেরে দিতে মদ এবং মাদকের প্রসারের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। পূর্বতন কংগ্রেস এবং সিপিএম সরকারও একইভাবে রাজ্যে মদের প্রসারের জন্য চেষ্টা চালিয়ে গেছে। এখন তৃণমূল একেবারে ‘দুয়ারে মদ’ পৌঁছে দেওয়ার আয়োজন করছে।
বিজেপি সরকার চেষ্টা করছে মানুষের ক্ষোভকে বিপথে পরিচালিত করার জন্য জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, অন্ধবিশ্বাসকে উসকে তুলতে। এই লক্ষে্যই তারা জ্ঞানবাপী মসজিদ, মথুরার ইদগাহ, কুতুব মিনার, টিপু সুলতানের সৌধ, এমনকি তাজমহল নিয়ে পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করছে। কখনও হিজাব বিতর্ক কখনও আজান দেওয়া নিয়ে অবান্তর বিতর্ক তুলে সংঘ পরিবার-বিজেপি এ দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকা দীর্ঘদিনের সম্প্রীতির বাতাবরণকে নষ্ট করতে চাইছে। খেটে খাওয়া মানুষের ঐক্য ভাঙাই তাদের উদ্দেশ্য। একই সাথে কেন্দ্রীয় সরকার চেষ্টা করছে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০-র মাধ্যমে শিক্ষা ক্ষেত্রেও অন্ধবিশ্বাস এবং কুসংস্কারকে সিলেবাসে ঢোকাতে।
সাধারণ মানুষের প্রশ্ন–এর থেকে কি মুক্তির রাস্তা নেই? বিজেপি সরকারকে ভোটে বদলে আর একটা দলকে আনলেই কি পরিস্থিতি বদলাবে? ২০১৪ সালে কংগ্রেস ঠিক একই ধরনের কাজগুলো করছিল বলেই তো মানুষ বদল চেয়েছিল। তার সুযোগে মসনদ দখল করেছে বিজেপি। একচেটিয়া মালিকদের বিশ্বস্ত সেবাদাস একটা দলের বদলে আর একটা দলকে সরকারে বসালেই যে মূল সমস্যার কোনও সমাধান হয় না তা কংগ্রেস এবং বিজেপির ভূমিকা দেখলেই আজ স্পষ্ট। রাজ্যের ক্ষেত্রেও তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে অন্য আর একটা দলকে ভোটে জেতাও– এ ডাক কোনও সমাধানের পথে নিয়ে যায় না।
সমাধান একটা রাস্তাতেই আছে, তা হল গণআন্দোলনের রাস্তায় চলতে চলতে জনগণের বিকল্প শক্তি গড়ে তোলা। এই রাস্তায় চলতে গিয়ে ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হলে সে সরকারকে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হবে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সে সরকারকে টিকতে না দিলে জনগণই রুখে দাঁড়ায়, তারা এই রাষ্টে্রর স্বরূপ চেনে, সমাজবদলের পথে চলার শক্তি অর্জন করে। শেষ পর্যন্ত এই বুর্জোয়া সমাজটাকে পাল্টানোর পথে এগিয়ে যায় মানুষ। এ কাজ করবে কারা? করতে পারে একমাত্র যথার্থ একটা বামপন্থী শক্তি। বামপন্থার কথা বলব, অথচ ভোটের স্বার্থে কংগ্রেসের মতো জনবিরোধী শক্তি অথবা জাতপাতের কারবারি কোনও দলের সাথে বোঝাপড়া করে ক’টা সিট বাগানো যায় সেই চেষ্টা যারা করে, সেই দলের পক্ষে যথার্থ গণআন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয়। যে কারণে সিপিএম আজ কোনও আন্দোলনেই নেই।
এই শ্বাসরোধকারী পরিস্থিতির বিরুদ্ধে সঠিক বামপন্থী রাজনীতির ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তুলছে এস ইউ সি আই (সি)। সিপিএম সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে এই দল যেমন আন্দোলন করে বহু দাবি আদায় করেছে, তেমনই তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে এই দলের ধারাবাহিক আন্দোলন চলছে। হয় কোনও ফ্রন্ট বা ফোরামের মাধ্যমে, না হলে সরাসরি দলের পতাকা নিয়ে চলছে একের পর এক আন্দোলন। বিদ্যুতের দাবি, শিক্ষার দাবি, চিটফান্ড প্রতারিতদের দাবি, চাষির দাবি, শ্রমিকের দাবি কোনও না কোনও ক্ষেত্রে দাবি আদায়ের আন্দোলন একটা দিনও থেমে নেই। এই আন্দোলন করতে করতেই সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আন্দোলনের এক নতুন স্তর। ২৯ জুন সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে আইন ভেঙে জেল ভরানোর ডাক দিয়েছে এস ইউ সি আই (সি)। গণতন্ত্রপ্রিয় সমস্ত মানুষ বিশেষত বামমনস্ক সকলের কাছে আহ্বান– এই আন্দোলনের বার্তা সর্বত্র পৌঁছে দিন।