রাজ্য সরকারের উদ্যোগে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ১৭–১৮ জানুয়ারির বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট বা শিল্প সম্মেলন রাজ্যবাসীর কাছে কী বার্তা রেখে গেল? এই ধরনের সম্মেলন শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, অন্যান্য রাজ্যেও এমনই ফলাও করে হচ্ছে৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বহু দেশ সফর করেছেন শিল্প আনার নাম করেই৷ তাতে কি শিল্প কিছু হল? এই শিল্প সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সত্যিই কি শিল্পের মরাগাঙে জোয়ার আসবে? নাকি পূর্বের সম্মেলনগুলির মতো এই সম্মেলনেরও বিনিয়োগ প্রস্তাব বাস্তবের মুখ দেখার আগেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে?
সব সরকারের মতোই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ভালভাবেই জানেন, শিল্প করতে পারলে তা ভোটের রাজনীতিতে যথেষ্ট ফলদায়ী হবে৷ ফলে, এ কাজে কারোরই আন্তরিকতার অভাব থাকার কথা নয়৷ এই ভোট–রাজনীতির কথা ভেবেই প্রধানমন্ত্রী ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র আহ্বান নিয়ে বিনিয়োগ ধরতে ইতিমধ্যে কয়েক ডজন দেশ সফর করে ফেলেছেন৷ প্রতিশ্রুতিও বোধহয় কিছু কিছু আদায় করতে পেরেছেন৷ কিন্তু তার দ্বারা শিল্প হয়েছে এমন কোনও সংবাদ নেই৷ কিন্তু সংবাদে এটা প্রকাশিত যে, পূর্বতন সিপিএম ফ্রন্ট সরকারের আমলে এই বাংলায় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে শিল্পপতিরা, তাদের অনেকেই এ দিনের শিল্প সম্মেলনে এসে একই প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি করেছেন৷ এত সম্মেলন, এত বিদেশ সফর সত্ত্বেও কেন শিল্প হচ্ছে না?
এক সময় বলা হল, রাজ্যে শিল্প বান্ধব পরিবেশ নেই৷ বলা হল, বনধ, ধর্মঘট, কর্মবিরতি, আন্দোলন ইত্যাদির ফলে শিল্পে শান্তি বিঘ্নিত হয়৷ এ প্রচারে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়েছিল৷ কিন্তু আজ মুখ্যমন্ত্রী শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকার কেড়ে নিয়েছেন, শিল্প কলকারখানায় কোনও আন্দোলনই করতে দেন না, বেঁচে থাকার মতো ন্যূনতম মজুরি আর শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতির দাবিতে আশা কর্মীরা ক’দিন আগে রাজপথে মিছিল করায় মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের হুমকি দিচ্ছেন৷ সরকার তথ্য দিয়ে বলছে, রাজ্যে ধর্মঘটের জন্য শ্রমদিবস নষ্ট হওয়ার নজির নেই৷ শিল্পপতিদের জন্য শান্তির এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা সত্ত্বেও কেন শিল্প হচ্ছে না? অন্যান্য রাজ্যে দলিতদের উপর আক্রমণ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, জাতি–ধর্ম–বর্ণগত সংঘর্ষ যতটা ঘটে এ রাজ্যে গণ আন্দোলনের দীর্ঘ ঐতিহ্যের কারণে তা অনেকটাই কম৷ তার উপর মুখ্যমন্ত্রী সরকারি টাকায় শিল্পপতিদের অনেক পরিকাঠামোই গড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন– সস্তায় জমি–জল–বিদ্যুৎ–রাস্তা ইত্যাদি৷ তা সত্ত্বেও বিনিয়োগ আসছে না কেন?
তোলা হচ্ছে সিঙ্গুরের কথা৷ বলা হচ্ছে, সিঙ্গুর থেকে টাটার ন্যানো তাড়ানোর ফলেই একটা ‘ব্যাড সিগনাল’ গেছে৷ যার ফলে পুঁজিপতিরা এখানে বিনিয়োগে সাহস পাচ্ছে না৷ ন্যানো গুজরাটে গিয়ে কেন মুখ থুবড়ে পড়ল? গুজরাটের সানন্দে গিয়েও কেন দৈনিক উৎপাদন মাত্র দুটি গাড়ি? কেন উৎপাদন ক্ষমতার সিংহভাগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না? এর প্রধান কারণ গাড়ির বাজার নেই৷ কিনবে কে? দু’চার জনকে বাদ দিলে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের কি ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার মতো যথেষ্ট টাকা আছে? সিঙ্গুরে ন্যানো হলে তার পরিণতি কি অন্য রকম ঘটত?
গুজরাট নাকি শিল্পে মরুদ্যান সেখানে কি বিনিয়োগের বন্যা বইছে? শিল্পপতিরা কি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে শিল্প করার জন্য? তথ্য বলছে, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজ্য গুজরাতে ২০১৫ থেকে ২০১৭ এর নভেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রকে লিখিত লগ্নিপ্রস্তাব জমা পড়েছিল ১,৯৬,২৮৭ কোটি টাকা৷ বাস্তবায়িত হয়েছে ২২,৮২৮ কোটি টাকা৷ অর্থাৎ লিখিত লগ্নি প্রস্তাবের মাত্র ১১.৬২ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯/০১/২০১৭)৷ অর্থাৎ, প্রস্তাবের ৮৮ শতাংশই বিনিয়োগে আগ্রহী নয়৷
এই বিনিয়োগ অনীহার আসল কারণ বিক্রির বাজার নেই৷ পুঁজিপতিরা যদি দেখে উৎপাদিত পণ্য কেনার লোক আছে তা হলে শিল্প করবেই৷ টি জে ড্যানিং–এর এক উদ্ধৃতি উল্লেখ করে মার্কস বলেছিলেন, ‘‘মুনাফার সম্ভাবনা দেখলেই পুঁজি সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ ১০ শতাংশ নিশ্চিত মুনাফা হবে জানলে যেখানেই বলবে পুঁজি সেখানেই খাটতে যাবে, ২০ শতাংশ লাভের নিশ্চিত আশ্বাসে তার চোখ চকচক করবে, ৫০ শতাংশ লাভের লোভে তার ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়াবে, ১০০ শতাংশ লাভ হবে জানলে সে ন্যূনতম মানবতাটুকুর গলায় পা দিয়ে দাঁড়াবে, ৩০০ ভাগ লাভ হবে এই নিশ্চয়তা পেলে হেন অপকর্ম নেই যা সে করবে না, এমন ঝুঁকি নেই যা সে নেবে না, এমনকী পুঁজির মালিকের ফাঁসি হতে পারে জেনেও পুঁজি ছুটবে লাভের অদম্য লালসায়’’ (ক্যাপিটাল)৷
তা হলে মুনাফার লোভে যারা এমন উদ্ধত রূপ ধারণ করতে পারে তারা মিছিলের স্লোগানে আঁতকে উঠে শিল্প করবে না– একথা কি আদৌ বিশ্বাস্য? যারা এভাবে ভাবেন তারা সচেতন বা অবচেতন ভাবে শিল্প সংকটের মূল কারণটিকে জনতার দৃষ্টি থেকে আড়াল করতে চান৷ এই শিল্প সংকট শুধু পুঁজিবাদী ভারতের বৈশিষ্ট্য নয়, আমেরিকা সহ সব অগ্রসর অনগ্রসর নির্বিশেষে পুঁজিবাদী দেশগুলির৷ আমেরিকায় যদি শিল্পের সংকট না থাকত, যদি উত্তরোত্তর শিল্প গড়ে উঠত এবং সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকত তা হলে আমেরিকা থেকে অনাবাসী ভারতীয় সহ সব অভিবাসী বিতাড়নের জন্য ট্রাম্প হুঙ্কার দিচ্ছেন কেন? আসামে বাঙালি খেদাও আন্দোলন বা মহারাষ্টে হিন্দিভাষী শ্রমিকদের উপর আক্রমণ – এসব কিছুর মূলে রয়েছে বেকারত্বের সমস্যা, যা শিল্পের দৈন্যদশাকেই তুলে ধরে৷ ফলে পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের কোনও রাজ্যেই আজ আর শিল্পের বসন্তকাল নেই৷
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এক ধাক্কায় শিল্প কিছুদূর পর্যন্ত বিকশিত হয়েছে৷ সেই সময় পশ্চিমবঙ্গ আন্দোলনে ভারতের পীঠস্থান ছিল৷ জওহরলাল নেহেরু সেদিন কলকাতাকে মিছিল নগরী বলতেন৷ সেদিন হাওড়া শিল্পাঞ্চল, ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল, দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল মাথা তুলেছে৷ তখন কেউ বলেনি যে আন্দোলনের জন্য শিল্প পালায়৷ তখন পশ্চিমবঙ্গ ছিল শিল্প সারণীর সামনের দিকে৷
পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের এই খরা পরিস্থিতি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সব রাজ্যের এবং সব দেশেরই এটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য, যা পুঁজিবাদ জন্ম দিয়েছে৷ একদিকে জনগণের চাহিদা পূরণের পরিবর্তে অতি মুনাফা লোটাকেই একমাত্র লক্ষ্য করে, অপরদিকে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা নিঃশেষ করে দিয়ে তারা শিল্পসংকটের জন্ম দিয়েছে৷ এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটি এসইউসিআই(সি) ছাড়া কোনও দলই জনগণের সামনে স্পষ্ট করে দেখাচ্ছে না৷ বরং সিপিএম কংগ্রেস থেকে শুরু করে বাকি সংসদীয় দলগুলি ‘এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেই শিল্প সম্ভব’– এমন একটা ধারণা সৃষ্টি করে জনগণকে এই সমাজব্যবস্থা পাল্টাবার সংগ্রাম থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে৷ এস ইউ সি আই (সি) আগেও বলেছে, এখনও বলছে, এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় একটা দুটো প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প এখানে সেখানে যেমন গড়ে উঠবে, তেমনই অধিক সংখ্যায় বন্ধ হবে শ্রমিক প্রধান শিল্প– যা বেকার সমস্যাকে মারাত্মক রূপে বাড়িয়ে তা সমাধানের অসাধ্য করে তুলবে৷ একটা যথার্থ কমিউনিস্ট দল ছাড়া এই সহজ সরল সত্য কথাটা কেউ জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারে না৷ ধরছেও না৷ তারা বরং বেকার সমস্যার নানা মিথ্যা কারণ দাঁড় করায়৷ সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে, পুঁজিবাদের বর্তমান অবক্ষয়িত যুগে শিল্পায়ন আর হতে পারে না৷ কারণ পুঁজিপতি শ্রেণিই তার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নিঃশেষ করে দিয়ে৷
এই বিজনেস সামিট থেকে রাজ্য সরকারের ভোট রাজনীতি কতটা সফল হবে সে হিসাব তাদের৷ কিন্তু কর্মসংস্থানের যে সুরাহা হবে না তা একটু ভাবলেই বোঝা যায়৷ ২০১৫ সালে রাজ্যের শিল্প সম্মেলনে ঘোষিত হয়েছিল ২,৪৩,১০০ কোটি টাকার লগ্নি৷ বাস্তবায়িত হয়েছে মাত্র ৯৮৩ কোটি টাকা৷ অর্থাৎ ঘোষণার মাত্র ০.৪ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে৷ ২০১৬ সালে বাস্তবায়িত হয়েছে ১.৩ শতাংশ, ২০১৭ সালে বাস্তবায়িত হয়েছে ১.০৭ শতাংশ (সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯–১–২০১৮)৷ এতে কী কর্মসংস্থান হবে পাঠকই ভাবুন৷ শিল্প গড়ে তুলতে হলে শিল্পায়নের সামনে পুঁজিবাদী বাধা দূর করতে হবে৷