২৪ এপ্রিল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর ৭৫তম প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে দলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, এ যুগের অন্যতম মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের রচনা ‘ভারতবর্ষের গণআন্দোলনের সমস্যাবলি’ থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা হল।
…বিপ্লবের জন্য তিনটি শর্ত দরকার–(১) বিপ্লবের সঠিক রাজনৈতিক লাইন, দৃষ্টিভঙ্গি এবং আদর্শ, (২) সঠিক বিপ্লবী পার্টি, অর্থাৎ যে পার্টি যথার্থই বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে পারে, আর (৩) জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের দৃঢ়বদ্ধ সংগ্রামী ফ্রন্ট। যখন এই তিনটি শর্ত গড়ে ওঠে একসঙ্গে, তখনই বুঝতে হবে বিপ্লবের উপযুক্ত সময় উপস্থিত। অর্থাৎ বিপ্লবের জন্য এই তিনটি শর্ত একই সঙ্গে গড়ে ওঠা প্রয়োজন। শুধু জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে–এইটুকু হলেই হবে না। …
আন্দোলনের রাস্তা ঠিক কি না, আন্দোলনের আদর্শ ঠিক কি না, আন্দোলনের নেতৃত্ব ঠিক কি না–আন্দোলনের মধ্যে এই প্রশ্নগুলো বিচার করা একান্ত দরকার। তা ছাড়া আন্দোলনের মধ্যে আরও অনেক জিনিস লক্ষ রাখতে হয়। লক্ষ রাখতে হয়, আন্দোলনের মধ্যে কোন কোন দল, আন্দোলনের যে শত্রুপক্ষ, তার সাথে তলে তলে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। কারণ, আপনারা মনে রাখবেন, শত্রুপক্ষ বা বুর্জোয়া শ্রেণি গণআন্দোলনের বিরুদ্ধে শুধু যে সরাসরি আঘাত করে তা নয়, তারা আন্দোলনের মধ্যে নিজেদের এজেন্টও রাখে। শত্রুপক্ষের এইসব এজেন্টরা জনগণের নানা দাবিদাওয়া নিয়ে বাইরে লোকদেখানো আন্দোলনের মহড়া দেয়, গণআন্দোলনের মধ্যে কখনও কখনও সত্যিকারের বিপ্লবীদের থেকেও অনেক বেশি জঙ্গি ভাব দেখায়। আবার একই সাথে তারা শত্রুপক্ষের সাথে গোপন যোগাযোগ রক্ষা করে চলে এবং সুযোগমতো জনগণের সংগ্রামী ফ্রন্টে ফাটল ধরায়, বিভেদ সৃষ্টি করে। এইভাবে সত্যিকারের গণআন্দোলনের বিরুদ্ধে শত্রুপক্ষের হয়ে তারা কাজ করে। তা ছাড়া, বর্তমান পুঁজিবাদী শোষণমূলক সমাজব্যবস্থাটাকে পালটে ফেলার জন্য যে কাজটা করা আসল দরকার, গণআন্দোলনগুলোর মধ্য দিয়ে সেই সংযুক্ত মোর্চা রূপে বিপ্লবের উপযোগী জনগণের সংগ্রামের নিজস্ব হাতিয়ার শ্রমিক-চাষির সংগ্রামী গণকমিটিগুলি একেবারে নিচু স্তর থেকে উঁচু স্তর পর্যন্ত কিছুতেই নানা অজুহাতে এইসব দল গড়তে দেয় না। তারা বরং তার পরিবর্তে যে কোনও উপায়ে নিজেদের দলীয় শক্তিবৃদ্ধিকেই এবং জনতার ওপর তাদের প্রভাব বৃদ্ধিকেই জনতার রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দেওয়া বোঝাতে চায় এবং শাসকদলবিরোধী বিভিন্ন পার্টিগুলির মধ্যে ওপরে ওপরে যে বোঝাপড়া গড়ে ওঠে, তাকেই চিরকাল জনগণের সংগ্রামী ফ্রন্ট বলে চালাবার চেষ্টা করে। এইভাবে দেশের অভ্যন্তরে বিপ্লবী প্রস্তুতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এইসব দল কার্যকরী ও প্রত্যক্ষ বাধা সৃষ্টি করে এবং শত্রুর বিরুদ্ধে কখনও কখনও যে মারমুখী লড়াই এরা পরিচালনা করে, তার দ্বারা জনতাকে বিভ্রান্ত করে বিপ্লবী দল থেকে জনগণকে সরিয়ে রাখার চক্রান্ত করে। গণআন্দোলনের মধ্যে এরাই হচ্ছে ধুরন্ধর সোসাল ডেমোক্রেটিক শক্তি, যাদেরই বিপ্লবী শাস্তে্র বলা হয় ‘কম্প্রোমাইজিং ফোর্স বিটুইন লেবার অ্যান্ড ক্যাপিটাল’, অর্থাৎ শ্রম ও পুঁজির মধ্যে আপসকামী শক্তি। বাইরের বুকনি এবং আচরণ দেখে এদের আসল চরিত্র সাধারণ মানুষ ধরতে পারে না। গণআন্দোলনের মধ্যে এদের চতুরতা এবং বিপ্লববিরোধী রাজনীতি উদঘাটিত করে জনগণ থেকে এদের বিচ্ছিন্ন করতে না পারলে জনতার রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দেওয়া যায় না।
… রাষ্ট্রশক্তি বলতে কী বোঝায়, তা আপনাদের ভাল করে জানা দরকার। আপনাদের জানা দরকার, এই রাষ্ট্রশক্তিই আসলে বর্তমানের পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাটাকে রক্ষা করছে। এই রাষ্ট্রশক্তির মূল তিনটি ‘অর্গান’ বা স্তম্ভ, যাদের সাহায্যে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাটাকে সে রক্ষা করে। রাষ্ট্রশক্তির এই মূল তিনটি অর্গান বা স্তম্ভ হচ্ছে– সৈন্যবাহিনী, বিচারবিভাগ এবং পুলিশ সহ আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের এই যে তিনটি অর্গান, নির্বাচনে সরকার বদলের দ্বারা এর চরিত্র পাল্টায় নাকি? আপনারা মনে রাখবেন, নির্বাচনে সরকার বদলের দ্বারা রাষ্ট্রের এই তিনটি অর্গানের চরিত্র পাল্টায় না। নির্বাচনের মধ্য দিয়েই সরকার পাল্টানো হোক, ‘ক্যু’ (ষড়যন্ত্রমূলক সামরিক অভ্যুত্থান) করেই সরকার পাল্টানো হোক, অথবা অন্য কোনও প্রক্রিয়ায় পার্লামেন্টে দলবদল করেই সরকার পাল্টানো হোক– এই যে রাষ্ট্রের তিনটি অর্গান, যা একটা যন্ত্রের মতো একটা বিশেষ ধাঁচায়, একটা বিশেষ রূপে, একটা বিশেষ ঢংয়ে গড়ে উঠেছে, তার পরিবর্তন হয় না। যেমন, একটা মেশিন বিভিন্ন পার্টস নিয়ে একটা বিশেষ ঢংয়ে তৈরি, একটা বিশেষ ধরনের কাজ করবার জন্য। অপারেটর, ইঞ্জিনিয়ার, মিস্ত্রি সেই মেশিনটাকে যেমনভাবেই চালাক–খারাপ ভাবে হোক, ভাল ভাবে হোক–ঐ মেশিন দিয়ে সেই ধরনের কাজই হবে, যে ধরনের কাজের জন্য মেশিনটি তৈরি। তেমনি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের মানসিক ধাঁচা, রীতিনীতি, গঠনপদ্ধতি, তার আইনকানুন সংক্রান্ত ধারণা, গণতন্ত্র সংক্রান্ত ধারণা, দেশ সংক্রান্ত ধারণা, জনতা সংক্রান্ত ধারণা–সমস্ত কিছু পুঁজিবাদকে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে, পুঁজিপতি শ্রেণির শাসনকে রক্ষা করার জন্য একটা ধাঁচে তৈরি। আর, সরকার হচ্ছে এই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের মিস্ত্রি বা অপারেটর মাত্র। ফলে, শুধু সরকার বদলের দ্বারা রাষ্ট্রযন্ত্রের চরিত্র পাল্টায় না। তা হলে, রাষ্ট্রের এই যে মূল তিনটি অর্গানের সাহায্যে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাটা টিকে আছে, গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে একেবারে নিচের স্তর থেকে ওপরের স্তর পর্যন্ত যে গণকমিটিগুলি গড়ে উঠবে, সেই গণকমিটিগুলি যদি রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং উপযুক্ত নৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধারের ওপর এই তিনটি অর্গানের কাজ করার উপযুক্ত করে গড়ে না তোলা যায়, তা হলে বিকল্প রাষ্ট্রশক্তির জন্ম হতে পারে না। আর, এই কাজটি না হলে শুধু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার বদল করে কোনও দিন ক্রান্তি হবে না।