সিপিএমের ২৬তম রাজ্য সম্মেলনের রিপোর্টে রাজ্যে তৃণমূল সরকারের ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’-এর মতো জনমোহিনী প্রকল্পের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ‘সুবিধাভোগী শ্রেণির’ মনোভাব তৈরি হয়েছে। এইসব অনুদানমূলক প্রকল্প যে মানুষের জীবনের সমস্যাগুলির স্থায়ী কোনও সমাধান নয়, বরং রাজ্যে শিক্ষা, শিল্প বা কর্মসংস্থানের প্রশ্নগুলোই যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা তাঁরা মানুষকে বোঝাতে পারছেন না। ফলে তাঁদের লড়াই নাকি কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
খুবই বাস্তব এবং সৎ স্বীকারোক্তি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন উঠে আসে, সিপিএম নেতা-কর্মীরা মানুষের সত্যিকারের ভাল কীসে হবে, বা যা মানুষের ন্যায্য অধিকার তা কেন দয়ার-দান হিসাবে নিতে হবে, সে-কথাগুলি মানুষকে ধরাতে পারছেন না কেন, মানুষই বা তাঁদের কথায় কান দিচ্ছেন না কেন? তবে কি তাঁদের কথায় মানুষ গুরুত্ব দিচ্ছেন না বা বিশ্বাস করছেন না?
আগে দেখা যাক, সিপিএমের ৩৪ বছরের শাসনের লক্ষ্য কী ছিল। ন্যায্য অধিকারগুলি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলা, তাঁদের জীবনের দুরবস্থাগুলি তুলে ধরে তার সঠিক কারণ ব্যাখ্যা করে সংগ্রামী বামপন্থায় তাঁদের উজ্জীবিত ও সচেতন করা কি তার লক্ষ্য ছিল? তাদের ৩৪ বছরের শাসনের ইতিহাস বলছে– না, তৃণমূলের আজ যা লক্ষ্য, সেদিন সিপিএমের লক্ষ্যও তা-ই ছিল। তা হল, যেভাবেই হোক, ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করা। মানুষকে ভুলিয়ে, বাস্তবে কিছু সরকারি অনুদান পাইয়ে দিয়ে দলের অনুগত রাখা এবং এই ভাবে ভোট আদায় করে ক্ষমতার ভোগ-দখল কায়েম রাখা।
তাঁদের ৩৪ বছরের শাসনে সিপিএম নেতারা সাধারণ মানুষকে কখনও এ কথা বোঝাননি যে, তাঁদের জীবনের মৌলিক সমস্যাগুলির জন্য দায়ী আসলে এই শোষণমূলক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা। পরিবর্তে মানুষকে তাঁরা বুঝিয়েছেন, আমাদের সঙ্গে থাকো, তা হলেই সব পাবে এবং একমাত্র আমাদের সঙ্গে থাকলেই পাবে। কী পাবে? চাকরি পাবে? না, সকলের কাজ পাওয়ার কোনও উপায়ই নেই এই ব্যবস্থায়। বেকারত্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অনিবার্য ফল। এর মধ্যেও যে-কটি চাকরির সুযোগ থাকে, তার একটি জুটতে পারে একমাত্র ‘আমাদের’ সঙ্গে থাকলেই। আর কী পাবে? আজ তৃণমূল যে সব প্রকল্প নিয়েছে সিপিএম আমলে সেগুলি এ-ভাবে না থাকলেও যে-সব সরকারি অনুদান প্রকল্প, পঞ্চায়েতি প্রকল্প ছিল সেগুলিও জুটত কেবল ‘আমাদের দলে যোগ দিলেই’। অর্থাৎ শিক্ষা হোক বা কর্মসংস্থান, এগুলি যে প্রতিটি নাগরিকের অধিকার, এটাই তাঁরা মানুষের থেকে আড়াল করে গেছেন। এ কথা মানুষকে বলেননি যে, বেকারত্বের কারণ বিপুল সংখ্যায় কল-কারখানা না হওয়া এবং এই কল-কারখানা না হওয়ার কারণ মানুষের চাহিদা না-থাকা নয়, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না-থাকা। এরই পাশে সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামীণ মানুষ যাঁরা কৃষির সঙ্গে যুক্ত, তাঁরাও জমি হারিয়ে, ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে দারিদ্রসীমার নীচে নেমে গিয়ে ক্রয়ক্ষমতা হারিয়েছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামীণ মানুষ যারা কৃষির সঙ্গে যুক্ত তারাও জমি হারিয়ে, ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে দারিদ্র সীমার নীচে নেমে গিয়ে ক্রয়ক্ষমতা হারিয়েছে। শ্রমিক ও কৃষক–সকলেই বেকার হয়েছে। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না-থাকাটা পুঁজিবাদী শোষণেরই ফল। তাঁরা মানুষকে কখনও যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখাননি যে, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থান-বাসস্থান সংক্রান্ত প্রতিটি সমস্যার জন্য দায়ী এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং এই ব্যবস্থাকে উচ্ছেদের মধ্য দিয়েই একমাত্র এইসব দাবি অর্জিত হতে পারে। একটি যথার্থ বামপন্থী দল মানুষের মধ্যে এই চেতনার সঞ্চারের মধ্য দিয়ে তাঁদের পুঁজিবাদ বিরোধী গণআন্দোলনের মধ্যে টেনে আনে। আর যতই মানুষ গণআন্দোলনে অংশ নেয় ততই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শোষণমূলক এবং দমনমূলক চরিত্র তার কাছে স্পষ্ট হয়। সিপিএম নেতারা ৩৪ বছরের শাসনে মানুষকে এ-সব কোনও কিছুই বোঝাননি।
অন্য দিকে তাঁরা মানুষের জীবনের সমস্যাগুলি সমাধানের দাবি নিয়ে গণআন্দোলন গড়ে তোলেননি শুধু নয়, শোষণ-বঞ্চনাকে কেন্দ্র করে, মূল্যবৃদ্ধি-বেকারত্বকে করে কৃষক, শ্রমিক ও জনগণের যে বিক্ষোভ-আন্দোলন গড়ে উঠেছে, সম্পূর্ণ পুঁজিবাদী কায়দায় লাঠি-গুলি চালিয়ে সেগুলি দমন করেছেন। রাজ্যের শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিক ইউনিয়নের প্রায় সবগুলিই তাদের দখলে ছিল। অথচ শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিগুলিতে শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলন তাঁরা কখনও গড়ে তোলেননি। মালিকদের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি হিসাবে শ্রমিক আন্দোলানকে শুধুমাত্র কিছু অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে নামমাত্র কিছু পাইয়ে দিয়ে শ্রমিকদের ক্ষোভকে স্তিমিত করার চেষ্টা করেছেন। এমনকি কৃষকদের কাছ থেকে কৃষিজমিও তারা কেড়ে নিয়েছেন। এর বিরুদ্ধে যে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাকে লাঠি-গুলি দিয়ে, ক্রিমিনাল বাহিনী নামিয়ে, খুন-ধর্ষণ করে দমন করে মালিকদের সন্তুষ্ট করেছেন। শ্রম এবং পুঁজির মধ্যে, মালিক এবং শ্রমিকদের মধ্যে আপসকামী শক্তি হিসাবে সোসাল ডেমোক্রেটিক ভূমিকা পালন করেছেন এবং বিনিময়ে পুঁজিপতি শ্রেণির কাছ থেকে গদিতে টিকে থাকার গ্যারান্টি আদায় করেছেন, আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন, প্রচার পেয়েছেন। এরই জোরে তারা সেদিন সব নির্বাচনে জিতেছেন, আজকের তৃণমূলের মতো সব কিছু দখল করেছেন। অর্থাৎ তৃণমূল সরকার আজ যা করছে, মুখে বামপন্থার কথা বললেও সিপিএম সরকারও সেদিন একই কাজ করেছে। মানুষকে অধিকার-সচেতন করার পরিবর্তে ‘পাইয়ে দেওয়া’ রাজনীতির মধ্য দিয়ে অনুগত নাগরিক তৈরির চেষ্টা করেছে। সরকারগুলির জনবিরোধী ভূমিকার জন্য এক দল মানুষ ভাবে, কিছুই তো পাওয়া যায় না, তার চেয়ে বরং যা জুটছে তাই লাভ। মানুষের এই মনোভাবের জন্য যেমন তৃণমূল সরকার দায়ী, তেমনই সিপিএম সরকারও সমান দায়। তা হলে আজ সিপিএম নেতাদের কথা মানুষ বিশ্বাস করবে কেন?
তৃণমূলের এই পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি কোনও নতুন মডেল নয়। রাজ্যে রাজ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক এবং জাতীয় দলগুলির দৌলতে এই রাজনীতিরই আজ রমরমা। সিপিএম আগে এ রাজ্যে করেছে, এখন কেরালায় করেছে, তামিলনাড়ুতে জয়ললিতার দল করেছে, দিল্লিতে আপ করছে, উত্তরপ্রদেশে বিজেপি করছে, রাজস্থানে কংগ্রেস করছে। ক্ষুব্ধ জনগণকে সামান্য কিছু ছুঁড়ে দিয়ে ‘সন্তুষ্ট রাখতে’ বুর্জোয়া রাজনীতির এটাই এখন চল। অর্থাৎ স্থায়ী কাজ তৈরির মধ্য দিয়ে স্থায়ী রোজগারের ব্যবস্থার পরিবর্তে হাতে কিছু টাকা দিয়ে দেওয়া। এতে দুটো উদ্দেশ্য পূরণ হয়। এক দিকে ভোটব্যাঙ্ক সংহত হয়, অন্য দিকে তলানিতে চলে যাওয়া মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কিছুটা বাড়ে এবং পুঁজিপতিদের পণ্যের বাজার কিছুটা চাঙ্গা হয়। আর এই পুঁজিবাদী রাজনীতির তলায় চাপা পড়ে যায় মানুষের ন্যায্য অধিকারগুলি।
সিপিএমের জনসমর্থন বিধানসভা ভোটে যে তলানিতে এসে ঠেকেছিল, সে কথা স্বীকার করে সম্মেলনের প্রতিবেদনে আত্মসমীক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই আত্মসমীক্ষাটি যে কী, তার উল্লেখ সম্মেলনের প্রতিবেদনে নেই। প্রতিবেদনে এর উল্লেখ না-ও থাকতে পারে। কিন্তু কোনও রকম ‘আত্মসমীক্ষা’ করতে তাঁদের রাজ্যের মানুষ আজ পর্যন্ত দেখেননি। জনসমর্থন যে তাঁরা হারিয়েছেন তাদের বুর্জোয়া কায়দায় সরকার চালানো, একের পর এক জনবিরোধী নীতি ও পদক্ষেপ নেওয়া, বিরোধী মতকে গায়ের জোরে ও পুলিশ-প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে দমন করা, খুন এবং সন্ত্রাস চালানো, ব্যাপক দলবাজি, নেতাকর্মীদের লাগামছাড়া দুর্নীতির জন্য–তা কি তাঁরা কখনও রাজ্যের মানুষের কাছে স্বীকার করেছেন? করেননি। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন নামিয়ে আনা এবং কৃষকবিরোধী নীতি নিয়েছেন, আজ পর্যন্ত সে সব অন্যায় স্বীকার করেননি। এগুলি যদি স্বীকার না করেন, তবে আত্মসমীক্ষা কথাটির ব্যবহার নিচু তলার কর্মী-সমর্থকদের ভোলানো ছাড়া আর কী কাজে লাগবে?
এ কথা স্পষ্ট, পুঁজিপতি শ্রেণির বিশ্বস্ত সেবক হিসাবে তৃণমূল সরকারের ভূমিকায় সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ক্রমাগত বাড়ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের দাম প্রতিদিন লাফিয়ে বাড়ছে। সবজির দাম আকাশছোঁয়া। ভোজ্য তেল, রান্নার গ্যাস, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। বাসমালিকরা ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে জনগণের পকেট কাটছে। অথচ সাধারণ মানুষের রোজগার নেই। এই অবস্থায় মাসে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের পাঁচশো টাকার অনুদানে যে কোনও সুরাহাই হয় না। কারণ, তার বহুগুণ টাকা তাঁদের মূল্যবৃদ্ধিতে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। এ-সব নিয়ে তৃণমূল সরকার নীরব। উপরন্তু এই সরকার হাসপাতালগুলিতে বরাদ্দ বেশির ভাগ ওষুধই বন্ধ করে দিয়েছে। চিকিৎসা ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ শুরু করে দিয়েছে। ওষুধ ছাঁটাই করে দিয়েছে। স্বাস্থ্যসাথীর নামে মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগটিকে কেড়ে নিয়ে বিমা-নির্ভর করে দিয়েছে। স্কুলগুলিকে বেসরকারি মালিকদের কাছে বেচে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। সঙ্গে রয়েছে তৃণমূল নেতাদের দুর্নীতি, কাটমানির দাপট। খুন সন্ত্রাস বাড়ছে। নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হয়েছে। ফলে ছিটেফোঁটা কোনও অনুদানই মানুষের ক্ষোভের আগুনকে চাপা দিতে পারছে না। তৃণমূল সরকারের লক্ষ্য তাদের বিরুদ্ধে সব ক্ষোভকে অনুদানের প্রলেপে চাপা দেওয়া, যাতে তাদের দুর্নীতি-লুঠ দেখেও মানুষ চুপ করে থাকে। এই একই রাজনীতি সিপিএম করেছে, বিজেপি সহ অন্য দলগুলি যে যেখানে ক্ষমতায় রয়েছে সেখানে করছে। এখন সিপিএম নেতাদের লক্ষ্য, অন্য আর পাঁচটি ভোটবাজ দলের মতোই, মানুষের বেড়ে চলা এই ক্ষোভকে ভোটের বাক্সে নিয়ে গিয়ে আবার যদি গদিতে বসা যায়। কিন্তু সিপিএমের রাজনীতি মানুষের অতি চেনা। তাই মানুষ তাদের কথা বিশ্বাস করছে না।
তা হলে পথ কী? আজ সত্যিই মানুষের জীবনের দুর্গতির স্থায়ী সমাধান করতে চাই বিপ্লবী রাজনীতির চর্চা। চাই সমাজ বদলের রাজনীতির চর্চা। যে রাজনীতি চর্চার ফলে মানুষ ধরতে পারবে তার জীবনের দুরবস্থার আসল কারণগুলো। ধরতে পারবে এই অনুদানের রাজনীতির পিছনে কোন মতলব কাজ করে। বুঝতে পারবে, এসব মানুষের জীবনের প্রকৃত কল্যাণ না করে দুরবস্থাকেই স্থায়ী করে রাখে। তাদেরই দেওয়া বিপুল করের টাকার অতি নগণ্য অংশ ছুঁড়ে দিয়ে মানুষকে ভোটের জন্য দায়বদ্ধ করে বেঁধে রাখে। আজকের দিনে এটাই বিপ্লবী রাজনীতি। এই রাজনীতির চর্চাই মানুষকে তাদের যথার্থ প্রাপ্য এবং অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তুলবে এবং এর ফলে মানুষ ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে ব্যবহৃত না হয়ে সমাজ পরিবর্তনের সঙ্ঘশক্তিতে পরিণত হবে।