Breaking News

মহান নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কমিউনিজমের পতাকা ঊর্ধ্বেতুলে ধরুন গুয়াহাটির জনসভায় কমরেড অসিত ভট্টাচার্য

 

৯ নভেম্বর ২০১৭ গুয়াহাটি জেলা গ্রন্থাগার প্রেক্ষাগৃহে নভেম্বর বিপ্লব শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে মুখ্য বক্তা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর পলিটব্যুরো সদস্য, কমরেড অসিত ভট্টাচার্য৷ সভাপতিত্ব করেন রাজ্য সম্পাদক কমরেড চন্দ্রলেখা দাস৷

কমরেড অসিত ভট্টাচার্য বলেন, মানব জাতির ইতিহাসে নভেম্বর বিপ্লব একটি অনন্যসাধারণ ঘটনা৷ তার আগের সমস্ত বিপ্লবের সাথে নভেম্বর বিপ্লবের একটা সুনির্দিষ্ট পার্থক্য আছে৷ নভেম্বর বিপ্লবের আগে পৃথিবীর বুকে অন্য যে কয়েকটা বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে, মুখ্যত আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসি বিপ্লব এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশের গণতান্ত্রিক বিপ্লব– এই প্রতিটি বিপ্লবই সমাজ বিকাশের, সমাজ অগ্রগতির দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে৷ ফরাসি বিপ্লব রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্রকে ধ্বংস করে বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল৷ ইতিহাসে তার অবস্থান যুগান্তকারী৷ কিন্তু এগুলোর সঙ্গে নভেম্বর বিপ্লবের মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে নভেম্বর বিপ্লবের আগেকার বিপ্লবগুলো তদানীন্তন সমাজের অগ্রগতির ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করলেও মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণের অবসান ঘটাতে পারেনি৷ বিশ্বের বুকে প্রথম এ কাজ করেছে নভেম্বর বিপ্লব৷ সেদিক থেকে নভেম্বর বিপ্লবের তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর৷ দ্বিতীয়ত, ফরাসি বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ বা তার পরের বিপ্লবগুলো চিন্তা–চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে সংগঠিত হলেও এগুলোর মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততা একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে৷ কিন্তু নভেম্বর বিপ্লবই প্রথম বিপ্লব যার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততা থাকলেও তা একটা বিজ্ঞানসম্মত নির্ভুল তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে সংগঠিত হয়েছে৷ কার্ল মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের দর্শন যে বিমূর্ত তত্ত্ব, তাকে মূর্ত করে, বিশেষীকৃত করে, সমস্ত শোষিত মানুষকে সচেতন করে, সংগঠিত করে, শ্রমিক কৃষক তথা জনসাধারণের মধ্যে তাত্ত্বিক জ্ঞানের জন্ম দিয়ে এই বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে৷ মহান মার্কস দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে প্রয়োগ করে, ঐতিহাসিক বস্তুবাদের জন্ম দিয়ে জ্ঞানজগতকে বিকশিত করে সমাজ পরিবর্তনের যে নিয়মগুলো দেখিয়েছেন, পুঁজিপতি শ্রেণির স্তাবক বিশ্বের তাবড় তাবড় বুদ্ধিজীবীরা বহু চেষ্টা করেও মার্কসের সেই তত্ত্বকে খণ্ডন করতে পারেননি৷ শেষ পর্যন্ত এঁদের মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছে৷ নভেম্বর বিপ্লব মার্কসের সেই তত্ত্বকেই বাস্তবে প্রয়োগ ঘটিয়েছে৷ মার্কস দেখিয়েছেন উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্কের যে দ্বন্দ্ব অবিরাম কাজ করে চলেছে সেটাই সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে৷ উৎপাদিকা শক্তির ক্রমবর্ধমান বিকাশের সাথে সঙ্গতি রেখে নতুন উৎপাদন সম্পর্কের জন্ম দেওয়াটাই হচ্ছে সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বিজ্ঞানসম্মত ধারণা৷ মার্কস বললেন, সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার নিতান্তই কম, খুবই নগণ্য সংখ্যক ধনিক সম্প্রদায়ের লোককে বাদ দিয়ে শোষিত মানুষকে সংগঠিত করে শ্রেণি সচেতন করে তুলতে হবে৷ তাদের বোঝাতে হবে যে, ধনিক শ্রেণি, পুঁজিপতি শ্রেণি, শোষক অত্যাচারী শ্রেণি জনসংখ্যার ১০ ভাগেরও কম বিপ্লবের আঘাতে তাঁদের কর্তৃত্বাধীন উৎপাদন ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করে উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদন যন্ত্রের উপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়েই শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি হবে সর্বপ্রকার শোষণ থেকে৷ মার্কসের এই তত্ত্বকে ভিত্তি করেই মহান লেনিন রুশ বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটালেন এবং ১৯১৭ সালে তাঁর নেতৃত্বেই মহান রুশ বিপ্লব সম্পন্ন হয়৷ মহান নভেম্বর বিপ্লব এবং মহান লেনিন এক ও অভিন্ন৷ এই বিপ্লবকে লেনিন বিশ্ববিপ্লবের সূচনা বলে আখ্যায়িত করেছিলেন৷ এই বিপ্লবের রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস৷ রাশিয়ায় লেনিনের নেতৃত্বে সঠিক বিপ্লবী দল গড়ে ওঠার সংগ্রাম, দলের নেতৃত্বে জনসাধারণকে শ্রেণিসচেতন করে তোলা, সংগঠন সৃষ্টি করা এসবের বিশদ আলোচনা আজকের এই সভায় সময়ের অভাবের জন্য সম্ভব নয়৷ কিন্তু অবশ্যই রুশ বিপ্লবের ইতিহাস ভাল করে জানা উচিত৷ রুশ দেশে এই ঐতিহাসিক সর্বহারা বিপ্লব সম্পন্ন করতে গিয়ে মহান লেনিন মার্কসবাদের সঠিক প্রয়োগের মধ্য দিয়ে এক বিশাল জ্ঞানভাণ্ডারের জন্ম দিয়েছেন এবং মার্কসবাদকে আরও উন্নত করেছেন৷ তাঁর ভাষণ, তাঁর লেখার ছত্রে ছত্রে নিহিত রয়েছে এই অসীম জ্ঞানভাণ্ডার৷ প্রতিনিয়ত এই জ্ঞানভাণ্ডার অনুশীলন করা, আয়ত্ত করা পৃথিবীর সকল দেশের বিপ্লবীদেরই অবশ্যকর্তব্য৷ আজকের এই সীমিত সময়ের মধ্যে আমি তাঁরই গুটিকয়েক অমূল্য শিক্ষা আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব৷

কমরেড অসিত ভট্টাচার্য বলেন, সর্বহারার মহান নেতা, মার্কসবাদ তথা কমিউনিস্ট দর্শনের উদগাতা মহান শিক্ষক কার্ল মার্কস মহান কমিউনিজমের quintessence  বা প্রকৃত নির্যাস বা মূল উপলব্ধি কী বোঝাতে গিয়ে তাঁর অপূর্ব সুন্দর ভাষায় এক জায়গায় যা বলেছিলেন তার মর্মার্থ হল– communism is humanism minus private property৷ এই মৌলিক ধারণার অনুসরণে রাশিয়া তথা সমগ্র বিশ্বে কমিউনিস্ট আন্দোলন এবং কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে গিয়ো রুশ বিপ্লবের রূপকার সর্বহারার মহান নেতা লেনিন এই দিকনির্দেশক ধারণার অনুসরণে সকল প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছেন, তিনি declassed হওয়ার– যার মর্মার্থ হচ্ছে ধনিক শ্রেণি, পুঁজিপতি শ্রেণির চিন্তাভাবনা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী চিন্তায় দীক্ষিত হওয়া– তার বৈপ্লবিক তাৎপর্য এবং অপরিহার্যতা প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝিয়েছেন৷ মার্কসের চিন্তার ভিত্তিতে ব্যক্তিগত সম্পত্তিবোধ থেকে মুক্ত হয়ে সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার তত্ত্ব তুলে ধরেছেন, professional revolutionary-র ধারণার জন্ম দিয়েছেন৷ শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী দল গড়ে তোলার প্রশ্নে আরও বলেছেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রতি আপেক্ষিক অর্থে যাদের লালসা নেই, যাদের সম্পত্তিবোধের পিছুটান অতটা নেই তারাই সর্বহারা শ্রেণি৷ এই শ্রেণির ভিতরেই বিপ্লব সম্পন্ন করার potentiality (সম্ভাবনা) নিহিত আছে আপেক্ষিক অর্থে বেশি৷ শোষক শ্রেণির প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী শ্রেণিচিন্তায় দীক্ষিত হওয়া বা ডিক্লাসড হওয়ার মধ্য দিয়ে এই শ্রেণি থেকেই সুনির্দিষ্ট সংগ্রামের পথে উঠে আসবেন শ্রেণিসচেতন ব্যক্তিরা৷ এঁরাই বিপ্লবী দল গড়ে তুলবেন৷ এঁরাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেবেন বা বিপ্লব সম্পন্ন করবেন অন্যান্য শোষিত শ্রেণিকে যুক্ত করে৷ লেনিন বলেছেন, শ্রমিকের ভিতরেও মালিক শ্রেণির চিন্তাভাবনা খাদ হয়ে মিশে থাকে৷ তাই তার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য দল গঠনে উদ্যোগীদের অতি অবশ্যই কঠোর সংগ্রাম করতে হবে৷ বলেছেন শ্রেণিচ্যুত হওয়ার সংগ্রামের পথে ‘বিপ্লবই জীবন’ এই উপলব্ধি যাঁদের মধ্যে দৃঢ়মূল হবে তাঁরাই হবেন বিপ্লবী দলের নেতা৷ বিপ্লবী দলের সদস্যপদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লেনিন বলেছেন, বিপ্লবী দলের সদস্য পদ যাকে তাকে দেওয়া যায় না৷ এই যোগ্যতা অর্জনের জন্য ইচ্ছুক সকলকেই test এবং trial -এর মধ্য দিয়ে এর প্রাথমিক সংগ্রাম সফল করে তুলতে হবে৷ রাশিয়ায় এই প্রশ্নে মার্টভদের সাথে লেনিনের তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয়৷ প্লেখানভ সহ এইসব ব্যক্তিরা নিজেদের মার্কসবাদী বলে ভাবতেন৷ কিন্তু মার্কসবাদের মর্মবস্তু এঁরা উপলব্ধি করতে পারেননি৷ তাঁদের মত ছিল বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, তথাকথিত বিদ্বান ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে একেবারে নিচু তলা থেকে কাজ করে উঠে আসার দরকার নেই৷ তাঁদের সোজাসুজি সদস্য পদ দিয়ে দেওয়া যায়৷ লেনিন তীব্র আপত্তি করলেন৷ বললেন, এ যদি হয় তাহলে দলটা বিপ্লবী দলের পরিবর্তে কিছু windbags অর্থাৎ শ্রেণিচেতনা বর্জিত ফানুসের দলে পর্যবসিত হবে৷ এই বিতর্ককে কেন্দ্র করেই দলের মধ্যে তীব্র বিভাজন দেখা দেয় এবং আর এস ডি এল পি বলশেভিক ও মেনশেভিক এই দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ার পিছনে একটাও ছিল একটা কারণ।

বিপ্লবের সঠিক উপলব্ধি কী– আর এক দিক থেকে তা ধরাতে গিয়ে লেনিন বলেছেন, Main question of revolution is the question of state power,  অর্থাৎ বিপ্লবের মূল বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্র ক্ষমতা সংক্রান্ত ধারণা। এটাকে আরও ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্ট্যালিন বলেছেন, It means which class is in power, therefore which class is to be overthrown by which class in alliance with which classes অর্থাৎ কোন শ্রেণি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন সঠিকভাবে নির্ণয় করা, আবার তারই ভিত্তিতে কোন শ্রেণির দ্বারা কোন শ্রেণিকে উচ্ছেদ করতে হবে কোন কোন শ্রেণির সহায়তা নিয়ে, তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা৷ এজন্যই বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রশ্নে রাষ্ট্র সংক্রান্ত উপলব্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ রাষ্ট্র যন্ত্রটি দাঁড়িয়ে আছে– শেষ বিচারে তার সেনাবাহিনীর উপরে৷ এই সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেই শাসক শ্রেণি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে এবং তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টা প্রতিহত করার কাজে নিযুক্ত থাকে৷ এই সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেই শাসক শোষক শ্রেণি বিপ্লব ধ্বংস করার প্রয়াস করে৷ আবার বিপ্লব যখন সফল হয় তখন শোষক শ্রেণির আজ্ঞাবহ এই সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করেই তা সম্পন্ন হয়৷ এই প্রশ্নে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে– প্রত্যেকটি রাষ্ট্রেরই শ্রেণিচরিত্র থাকে৷ আজকের দিনের বিশেষ অবস্থায় একটা হচ্ছে পুঁজিপতি শ্রেণির রাষ্ট্র এবং আরেকটা হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র৷ তাই কোনও দেশে বিপ্লব সম্পন্ন করতে হলে কোন শ্রেণি রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছে সেটা নির্ভুল ভাবে নির্ধারণ করতে হবে৷ এটাই লেনিনের ঐতিহাসিক পথনির্দেশ৷ রাষ্ট্র সম্পর্কে লেনিন আরও বহু কথা বলেছেন যা উপলব্ধি করতে না পারলে বিপ্লবের শুদ্ধ ধারণাই গড়ে উঠবে না৷ লেনিন বলেছেন, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে রাষ্ট্র হচ্ছে শাসক শ্রেণির দমনের হাতিয়ার৷ একটা পুঁজিবাদী দেশে রাষ্ট্রের কাজই হচ্ছে ৯৫ ভাগ শোষিত মানুষকে নির্যাতন করা, অবদমিত করে রাখা৷ এখানেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের অবস্থান unjust and illegitimata (অন্যায় এবং অন্যায্য)৷ অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ৯০–৯৫ ভাগ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে মোট জনসংখ্যার অতি নগণ্য অংশ ধনিক শ্রেণির প্রতিবিপ্লবী কার্যকলাপ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যই বিদ্যমান থাকে৷ তাই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অবস্থান ন্যায়সঙ্গত এবং ন্যায়ের উপরে প্রতিষ্ঠিত৷

সমস্ত পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশেই জনসংখ্যার ৯৫ ভাগ মানুষ পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণের ফলে পশুর মতো জীবনধারণ করছে৷বেঘোরে মরছে বা মৃত্যুর পথ বেছে নিচ্ছে৷ তাই ধনিক শ্রেণির বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের একটা সহজাত ক্রোধ বিদ্যমান থাকে৷ এই অর্থেই শ্রেণিবিভক্ত সমাজে বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার বাস্তব স্থিতি বর্তমান এবং শ্রেণিবিভক্ত সমাজে বিপ্লব অনিবার্য এবং অবধারিত৷ কিন্তু তৎসত্ত্বেও বিপ্লব এমনি এমনি হবে না৷ তাই লেনিন বার বার বলেছেন, শুধুমাত্র স্বতঃস্ফূর্ততার ভিত্তিতে সর্বহারা বিপ্লব সম্পন্ন করা যাবে না৷ বিপ্লবের জন্য চাই সঠিক বিপ্লবী তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত বিপ্লবী দল৷ সেই দলকে গ্রামে গঞ্জে, শহরে নগরে গরিব মানুষকে অবিরাম বিপ্লবের সঠিক তত্ত্ব বুঝিয়ে, সচেতন করে তাদের উপর দলের বিপ্লবী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে৷ ফলে বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য একটা শর্ত হচ্ছে অবজেকটিভ কন্ডিশন অর্থাৎ বাস্তব অবস্থা এবং অন্যটা সাবজেকটিভ কন্ডিশন অর্থাৎ ভাবগত অবস্থান, চিন্তা–চেতনা সংক্রান্ত দিক৷ বিপ্লব সম্পন্ন করতে হলে এই দুটি শর্তকেই mature করতে হবে অর্থাৎ পরিণত অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে৷ খুবই বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝিয়ে বলেছেন Without revolutionary  theory there can be no revolution (বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া বিপ্লব অসম্ভব) আবার বলেছে Without revolutionary theory there can be no revolutionary party (বিপ্লবী তত্ত্ব ব্যতিরেকে বিপ্লবী দল গড়ে উঠতে পারে না)৷ বিপ্লবের প্রশ্নে আমাদের উপলব্ধি আরও উন্নত করতে গিয়ে অতি চমৎকার ভাবে লেনিন  বলেছেন– socialist consciousness goes from without৷ সহজভাবে যার অর্থ হচ্ছে, সমাজতন্ত্রের তত্ত্বের উপলব্ধি শোষিত শ্রেণির মধ্যে আপনা আপনি জন্ম লাভ করে না৷ এই চেতনাকে তাদের মধ্যে বাইরে থেকে নিয়ে যেতে হয়৷ এখানেই হচ্ছে সঠিক বিপ্লবী তত্ত্বের এবং প্রকৃত বিপ্লবী দলের অপরিহার্যতা৷এই প্রশ্নে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করার সঠিক পথ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লেনিন বলেছেন, go to the people, learn from the people, people are the sole judges অর্থাৎ বিপ্লব করতে হলে প্রতিদিন জনসাধারণের মধ্যে যেতে হবে, তাদের সাথে থাকতে হবে৷ তার মধ্য দিয়ে জনগণ থেকে শিখতেও হবে৷ এই প্রক্রিয়ায় জনসাধারণ ক্রমশ সচেতন হবে, বিপ্লবী দলের বক্তব্য বিচার করবে এবং পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে তা গ্রহণ করবে৷ কোন দেশে বিপ্লব কখন হবে, কোন দিন হবে আগে থেকে বলে দেওয়া যায় না – তা বোঝাতে গিয়ে চমৎকার ভাষায় লেনিন বলেছেন ‘when the ruling class feels they cannot rule and the ruled people feel they cannot be ruled’ অর্থাৎ যখন শাসক শ্রেণি অনুভব করবে যে তারা আর শাসন করতে পারছে না এবং শোষিত শ্রেণি অনুভব করবে যে তারা আর এক মুহূর্তও শোষক শ্রেণির শাসন সইতে পারছে না, সেই মুহূর্তটাই বিপ্লব সম্পন্ন করার সঠিক মুহূর্ত৷ যদিও এক নয় তবুও ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ পর্বে অনেকটা এইরকম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল৷ আজাদ হিন্দ ফৌজের আন্দোলন এবং ’৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে দেশের জনসাধারণের মানসিক অবস্থা এরকম স্তরেই পৌঁছেছিল৷ তাঁরা একটি মুহূর্তও আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণ এবং শাসন মেনে নিতে পারছিলেন না৷ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিবৃতি দিয়ে বলতে হয়েছিল যে, ভারতবর্ষে এমন একটি অবস্থা বিরাজ করছে যে আমরা এখান থেকে আর শাসন চালাতে পারছি না৷ জনসাধারণ তো বটেই এমনকী সেনাবাহিনীতেও বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে৷ ফলে আমরা ১৯৪৮ সালের জুলাই মাসের মধ্যেই ভারত ছাড়ব৷ বস্তুত আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ’৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পর এটাই ছিল পরিস্থিতি৷ কিন্তু আমি যে কথাটা বলতে চাই তা হল এই অবস্থা আপনা আপনি সৃষ্টি হবে না৷ বিপ্লবী দলের নেতৃত্বে জনসাধারণকে সচেতন করার যে কাজ তার ওপরই নির্ভর করবে বিপ্লব কতটা ত্বরান্বিত হবে৷

বিপ্লব সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে লেনিনের আরেকটা শিক্ষা হচ্ছে, কোনও ধরনের হঠকারী কার্যকলাপের দ্বারা বিপ্লব হবে না৷ ব্যক্তিহত্যার রাজনীতি বা হঠকারী কাজের দ্বারা বিপ্লব ভয়ঙ্কর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ আমাদের দেশে নকশালবাদী সশস্ত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যা ঘটেছে এবং আজও তথাকথিত ‘মাওবাদী’ নাম নিয়ে যাঁরা ব্যক্তিহত্যার এবং বিস্ফোরণমূলক  কার্যকলাপ(sporadic activities) করছেন তার দ্বারা এই পুঁজিবাদী শাসন ব্যবস্থাকে উৎখাত করা যাবে না৷ একজন ব্যক্তিকে হত্যা করলে তারই জায়গায় শোষক শ্রেণির আরেকজন চলে আসবে, বাস্তব ক্ষেত্রে হচ্ছেও তাই৷ তাই ক্রমাগত চিন্তাগত, আদর্শগত, ভাবগত সংগ্রাম পরিচালনা করার মধ্য দিয়ে এবং একই সাথে শোষিত জনসাধারণকে সচেতন করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও শ্রেণিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবল শক্তি অর্জন করে শোষণমূলক ব্যবস্থাটার ভিত্তিমূলে আঘাত হানতে না পারলে বিপ্লব সম্পন্ন করা যাবে না৷ অনেকেই হয়ত জানেন যে, বিপ্লবের আগে রাশিয়ায় ‘নারদনিজম’ বলে একটা আন্দোলন সৃষ্টি হয় যার মূল কথা ছিল জার সম্রাট ও তার তাঁবেদারদের হত্যা করতে পারলেই রাশিয়ার জনসাধারণের শোষণমুক্তি ঘটবে৷ লেনিনের একজন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাও এই চিন্তার দ্বারা প্রবল ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন৷ এই আন্দোলনে জড়িত হওয়ার অপরাধে জার তাঁকে ফাঁসি দেয়৷ জানা যায় দেশপ্রেমিক দাদার মৃত্যুতে অল্পবয়স্ক লেনিন গভীর দুঃখ পেয়েছিলেন৷ আবার তাঁদের দেশপ্রেমিক মানসিকতাকে যথোচিত শ্রদ্ধা জানিয়ে এ কথাও বলেছিলেন যে, তাদের পথ সঠিক নয়৷ ব্যক্তিহত্যার দ্বারা বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু উত্তেজনামূলক পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে কিন্তু তার দ্বারা বিপ্লব হবে না৷ এই প্রসঙ্গে কমরেড ভট্টাচার্য উল্লেখ করেন যে, লেনিনের গভীর দার্শনিক চিন্তার ফসল হচ্ছে তাঁর বিখ্যাত বই ‘Left wing communism – an infantile disorder’৷ এই গভীর তত্ত্বসমৃদ্ধ দার্শনিক গ্রন্থটি সকলেরই পড়া এবং বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লেনিনীয় শিক্ষা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কমরেড অসিত ভট্টাচার্য বলেন,proletarian democracy  (সর্বহারা শ্রেণির গণতন্ত্র)–র ভিত্তিতে সুদীর্ঘ সময় গণআন্দোলন এবং শ্রেণিসংগ্রাম পরিচালনা এবং শেষ পর্যায়ে গণভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই বিপ্লব সম্পন্ন হবে৷ কিন্তু তার আগের পর্যায়টি কীরকম? লেনিনের শিক্ষার ভিত্তিতে সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ আমাদের বলেছেন, তার আগের পর্যায়টি হচ্ছে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পর্যায়৷ এই পর্যায়ে বাম গণতান্ত্রিক দল বলে যারা পরিচিত সেই সব দলকে নিয়ে সুনির্দিষ্ট দাবির ভিত্তিতে লাগাতার ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷ এই সমস্ত দলের প্রভাবাধীন জনসাধারণকে এই আন্দোলনে সামিল করতে হবে৷ কাদের নিয়ে এই যুক্ত আন্দোলন করতে হবে–  এই প্রশ্নে অচল, অনড় মনোভাব থাকলে চলবে না৷ আন্দোলনের দাবির প্রতি যাদের সমর্থন আছে, যাদের মধ্যে খানিকটা হলেও আন্দোলনের মানসিকতা আছে, যাদের জনসাধারণের মধ্যে কিছুটা প্রভাব আছে তাদেরই আন্দোলনে সামিল করার চেষ্টা করতে হবে৷ যাদের নিয়ে যত দূর যাওয়া যায়– এই মনোভাব নিয়ে চলতে হবে৷ অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, বিপ্লবীদের এই সময় unity-struggle বা ঐক্য এবং সংগ্রাম এই নীতি এবং মনোভাব নিয়ে চলার পথে কে কী তা পরিষ্কার হয়ে উঠবে৷ যারা অন্যায় আপসের পথে আন্দোলনকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে, জনসাধারণের কাছে অতি সত্বর তাদের চরিত্র ধরা পড়বে৷ এই প্রশ্নে অহেতুক উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই৷ এই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণের মধ্য দিয়েই জনসাধারণের মধ্যে তাদের যতটুকু প্রভাব আছে তা নিঃশেষ করতে হবে৷ এখানেই যুক্ত আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা এবং অপরিহার্যতা৷ শ্রেণিসংগ্রাম আরও তীব্রতর হবে এবং ক্লাস ফ্রন্ট গড়ে তোলার অবস্থা সৃষ্টি হবে৷ শ্রেণিসংগ্রামের তীব্রতা বৃদ্ধি করার মধ্য দিয়েই চূড়ান্ত আঘাত হানবার অবস্থা সৃষ্টি হবে৷ এইভাবেই শোষণমূলক ব্যবস্থা একদিন ভেঙে পড়বে৷

চলার পথ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেনিন আরও বলেছেন, বিপ্লবী দলকে প্রজ্ঞার ভিত্তিতে নানা ভাবে কাজ করার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে৷Open, underground, legal-illegal, parliamentary – extra parliamentary অর্থাৎ  প্রকাশ্যে, গোপনে, আইনি এবং আইন বহির্ভূত পথে, পরিষদীয় এবং পরিষদ বহির্ভূত– সবরকম পদ্ধতিতেই সংগ্রাম পরিচালনার দক্ষতা অর্জন করতে হবে৷ রাশিয়ায় বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে লেনিন খুঁটিনাটি কত বিষয়ের মধ্যে ঢুকেছেন, কত গভীরে গিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই৷ তিনি বললেন সমগ্র বিপ্লবী আন্দোলন এক আপসহীন সংগ্রাম– সর্বহারা শ্রেণির দ্বারা শোষক পুঁজিপতি শ্রেণিকে উৎখাত করার সংগ্রাম৷ এই প্রশ্নে কোনও আপস নেই৷ কিন্তু কৌশলগত দিক থেকে প্রয়োজন হলে অতি অবশ্যই two steps back one step forward দু’ পা পিছিয়ে এক পা এগোনোর নীতি অনুসরণ করতে হবে৷ এই ধরনের প্রয়োজন দেখা দিলে তাকে অনৈতিকতা, দুর্বলতা ভাবা ঠিক হবে না৷ এই প্রসঙ্গে একটা সুন্দর দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে৷ রাশিয়ার বিপ্লবের পর লেনিন বললেন যে, কৃষক শ্রেণি রাশিয়ার জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ৷ শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে পরিচালিত বিপ্লবে তারা শ্রমিক শ্রেণির সাথে মৈত্রীর সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে৷ কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী চিন্তা চেতনার দিক থেকে তারা এখনও খানিকটা অনগ্রসর৷ এই পরিস্থিতিতেই বিপ্লবের আগে তাদের আশ্বস্ত করতে হয়েছে যে, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর চাষির হাতে জমি এই নীতি বাস্তবায়িত হবে৷ বিপ্লবের পর তাই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের overall বা সামগ্রিক মালিকানা অক্ষুণ্ণ রেখেই জমি কৃষকদের হাতে বন্টনও করা হয়েছে৷ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে কৃষকদের উৎপাদিত দ্রব্য সীমিত আকারে বিক্রি করার সুযোগও দেওয়া হয়েছে৷ আবার এরই পাশাপাশি ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তিবোধ থেকে উদ্ভূত মানসিকতা দূর করার জন্য কৃষক জনসাধারণ সহ সকল অংশের জনগণের মধ্যেই চিন্তাগত, আদর্শগত সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে৷ পার্টি এবং বিপ্লবী সরকারকে মনে রাখতে হয়েছে যে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে জনসাধারণের সকল অংশের অবস্থান এক নয়৷ দরিদ্র, নিপীড়িত, জমিহীন কৃষকদের মধ্যে জমির প্রতি একটি টান কাজ করে৷ জারের অকথ্য অত্যাচার ও জমি ফিরে পাওয়ার সুনির্দিষ্ট আশ্বাসের ভিত্তিতেই তারা শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে মৈত্রী এবং ঐক্য গড়ে তুলেছে এবং বিপ্লবে সামিল হয়েছে৷ এই অবস্থায় কৃষক শ্রেণির নিম্নতম প্রয়োজনীয় দ্রব্য, ভোগ্যদ্রব্য সরবরাহ করতে না পারলে পরাজিত পুঁজিপতি শ্রেণি জল ঘোলা করে সদ্য জন্মগ্রহণ করা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর আঘাত হানতে পারে– এই প্রশ্নে লেনিন সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন৷ অপরদিকে লেনিন এই সম্পর্কেও সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন যে, সেই বিশেষ সময়ে শুধুমাত্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শিল্পোদ্যোগের মাধ্যমে কৃষক জনসাধারণের এই প্রয়োজন পূরণ সম্ভব নয়৷ এই পরিস্থিতিতে তাই তিনি ‘নিউ ইকনমিক পলিসি’ বা নয়া অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করার পথনির্দেশ করেন৷ এই নীতি অনুসারে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে বৃহত্তর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীনে ক্ষমতাচ্যুত পুঁজিপতি শ্রেণিকে শিল্পজাত বস্তু উৎপাদন করার একটা সীমিত সুযোগ দেওয়া হয়৷ এটাকে একটা retreat– সাময়িক পশ্চাৎ অপসরণ বলে অভিহিত করেও লেনিন বললেন, এছাড়া কোনও উপায় ছিল না৷ বলেছিলেন, উদ্বেগের কোনও কারণ নেই, অল্প দিনের মধ্যেই আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া যাবে৷ হয়েছিলও তাই৷ ৩–৪ বছর পরই এই ব্যবস্থা প্রত্যাহূত হয়েছিল৷ অতি কঠিন এই সমস্যা মোকাবিলা করতে গিয়ে অবিশ্বাস্য ভাবে বাস্তববাদী লেনিন আরও গভীরে গিয়ে আমাদের শিক্ষিত করেছেন, সচেতন করেছেন৷ তাঁর এই সংক্রান্ত লেখায় ছত্রে ছত্রে এই সঠিক উপলব্ধিগুলি উল্লেখিত রয়েছে৷ সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেও যে বিশেষ ধরনের state controlled business principles রয়েছে, accountancy (রাষ্ট্রীয় ব্যবসা সংক্রান্ত নীতি এবং হিসাব বিজ্ঞান) রয়েছে যেগুলো প্রকৃত অর্থে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির নীতি নিয়ম, তার প্রতি তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং সেগুলি সঠিকভাবে উপলব্ধি করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন৷

পুঁজিবাদী দেশগুলিতে সময়ে সময়ে যে সীমিত আকারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তার চরিত্র ব্যাখ্যা করে লেনিন বললেন যে, এই নির্বাচনগুলি হচ্ছে সেই সব দেশের শোষিত জনসাধারণকে ধোঁকা দিয়ে, বিভ্রান্ত করে সেই সব দেশের পুঁজিপতি শ্রেণিকে টিকিয়ে রাখার একটি ফন্দি বা হাতিয়ার৷ আরও বললেন প্রতি চার কিংবা পাঁচ বছর অন্তর সেই সব দেশে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেটি আসলে আগামী দিনে পুঁজিপতি শ্রেণির কারা জনসাধারণকে শোষণ করবে তারই নির্বাচন৷ যে সময় লেনিন বুর্জোয়া নির্বাচনের লোকঠকানো এই চরিত্র তুলে ধরে ছিলেন, সেদিন এই নির্বাচন অতটা সার্বজনীন হয়ে না উঠলেও, ভণ্ডামি এবং ব্যাভিচার আজকের পর্যায়ে যায়নি৷ আজ তো এই নির্বাচন একটি ন্যক্কারজনক প্রহসন৷ তৎসত্বেও লেনিন কিন্তু সেদিনই বুর্জোয়া নির্বাচনের আসল শ্রেণিচরিত্র পরিষ্কার করে তুলে ধরেছিলেন এবং শোষিত জনসাধারণকে বুর্জোয়া নির্বাচনের মোহ থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন৷ এই প্রসঙ্গে নির্বাচন প্রশ্নে লেনিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথনির্দেশের কথা উল্লেখ করতে চাই৷ বিপ্লবের আগে রাশিয়ায় ‘ডুমা’ বলে একটা সদন ছিল সেটা ঠিক পার্লামেন্ট নয়, কোনও কার্যকরী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এর ছিল না, এটা ছিল কেবল আলাপ–আলোচনা করার deliberative একটা আসর বা হাউস৷ সেখানে শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব ছিল অতি নগণ্য এবং বেশিরভাগ সদস্য ছিল জারের স্বার্থরক্ষাকারী দলের লোক৷ সেই ডুমার নির্বাচনেও লেনিনের পথনির্দেশ অনুসারে বিপ্লবীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে এবং কিছু আসন জিতেছেও৷ এই অবস্থায় ১৯০৫ সালে যখন বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার একটি ভাল সম্ভাবনা দেখা দিল সেই সময় লেনিন ডুমা বয়কট করার আহ্বান জানান৷ আবার এই বিপ্লব যখন সফল হল না লেনিন তারপর আবার বিপ্লবীদের ডুমায় এবং অন্যত্র যেখানে নির্বাচনের কিছুটা সুযোগ সুবিধা রয়েছে সর্বত্রই অংশগ্রহণ করার পথনির্দেশ দেন৷ কেন এই নির্দেশ? লেনিন বললেন, সেই বিপ্লব সফল না হওয়ার ফলে জনসাধারণের মধ্যে একটা হতাশা কাজ করছে৷ সেই অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য সমস্ত ক্ষেত্রে জারতন্ত্রের অত্যাচারী স্বরূপ তুলে ধরা, জনগণকে আবার বিপ্লবের পথে নিয়ে আসার জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে কাজে লাগাতে হবে, এগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে৷ কেন এই নীতি, কী তার তাৎপর্য এটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করে অনবদ্য ভাষায় লেনিন বললেন– Our decision to boycott Duma at the growing tide of revolution and our decision to enter into Duma during the receding tide of revolution both were correct অর্থাৎ ১৯০৫ সালে যখন বিপ্লবের একটা ঢেউ এল, জনসাধারণ বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য আকুল হয়ে উঠল তখন ডুমা বয়কট করার, আবার এই বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর জনসাধারণ যখন হতাশায় ভুগছে তখন ডুমার ভিতরে বাইরে আন্দোলন সৃষ্টি করে জনসাধারণকে হতাশা থেকে মুক্ত করে আবার বিপ্লবের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য ডুমার ভিতরে প্রবেশের সিদ্ধান্ত– দুটিই ছিল সঠিক৷

তত্ত্বগত ক্ষেত্রে লেনিনের আরও একটা অনন্য অবদান হচ্ছে জাতি সমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার(Right of the nations for self determination) সংক্রান্ত বিষয়৷ এর প্রকৃত তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে দৃঢ়তার সাথে তিনি বললেন, এর অর্থ বিচ্ছিন্নতাবাদ বা পৃথকতাবাদ নয়৷ প্রকৃত তাৎপর্য হচ্ছে একটা বৃহৎ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে oppressor nation (শোষক জাতি)থেকে আরেকটি oppressed nation (শোষিত জাতি)–র মুক্তি সংক্রান্ত বিষয়৷ এই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু কঠিন বিষয়টিকে প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যাখ্যা করে তিনি বললেন যদি দেখা যায় কোনও একটি দেশে কোনও একটি জনগোষ্ঠী আরেকটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দ্বারা শোষিত হচ্ছে, অত্যাচারিত হচ্ছে একমাত্র সেই অবস্থাতেই অত্যাচারিত জনগোষ্ঠীর বৃহৎ জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার থাকবে এবং সেটা হবে ন্যায়সঙ্গত৷ এছাড়া অন্য কোথাও সর্বহারা শ্রেণি বিচ্ছিন্নতাবাদ, পৃথকতাবাদ সমর্থন করে না৷ শোষণ জর্জরিত হলেও একটি বৃহৎ রাষ্ট্রের উপকারী দিকও রয়েছে– তাও লেনিন দেখিয়েছেন৷

পুঁজিবাদের এই ক্ষয়িষু যুগে জাতীয়তাবাদ বুর্জোয়াদের হাতে প্রতিক্রিয়াশীল হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে৷ এই যুগে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদকে ভিত্তি করেই সমস্ত দেশে বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে৷ লেনিন ঠিকই লক্ষ করেছিলেন গণতন্ত্রের বুলি আওড়ে বিশ্বের সব দেশেই পুঁজিপতি শ্রেণি এবং তাদের তাঁবেদাররা শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী আন্দোলনকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে৷ কমিউনিস্টরা গণতন্ত্রবিরোধী বলে কুৎসা ছড়াচ্ছে৷ এদের স্বরূপ উদঘাটন করে গণতন্ত্রের প্রকৃত ধারণা ব্যাখ্যা করে লেনিন বললেন– একটা শ্রেণিবিভক্ত সমাজে গণতন্ত্র বললে বলতে হবে, তা কোন শ্রেণির গণতন্ত্র৷ সমাজ যখন শোষক–শোষিতে বিভক্ত তখন সমাজে পরস্পরবিরোধী দুই শ্রেণিচিন্তা বিদ্যমান থাকে, সমস্ত চিন্তা–ভাবনারই শ্রেণিচরিত্র থাকে৷ এই অবস্থায় শোষক শ্রেণি চায় শোষিত শ্রেণিকে যেমন ইচ্ছা শোষণ করতে, শোষিত শ্রেণি চায় শোষক শ্রেণিকে উৎখাত করতে৷ তাই এই অবস্থায় গণতন্ত্রের ধারণাটা উভয় শ্রেণির জন্য এক হতে পারে না৷ কারণ গণতন্ত্রের অন্যতম কথা হচ্ছে গণতান্ত্রিক অধিকার৷ তাই গণতন্ত্র বললে বলতে হবে এই গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক অধিকার কোন শ্রেণির পক্ষে এবং কোন শ্রেণির বিপক্ষে৷ দৃঢ়তার সাথে লেনিন বললেন এইভাবে স্পষ্ট করে না বলে ‘গণতন্ত্র’ ‘গণতন্ত্র’ বলে যারা চিৎকার করে তারা হয় ধুরন্ধর আর না হয় মূর্খ৷

বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে লেনিনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে, Social Democratic  বলে যারা পরিচিত তাদের আসল রূপ উদঘাটন৷ মার্কস এঙ্গেলসের দিন থেকেই ন্যায়সঙ্গত দাবির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা শ্রমিক আন্দোলনগুলিতে পরস্পরবিরোধী দুই চিন্তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়৷একটা ভাগ জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে মুখে আন্দোলন, সংগ্রাম ইত্যাদির কথা বলেও শেষপর্যন্ত মালিক শ্রেণির সঙ্গে আপস করতে চায়, অন্য ভাগ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আপসহীনভাবে আন্দোলন চালিয়ে যেতে চায়৷ এই দুই ভাগ শ্রমিক আন্দোলনে লেনিনের দিনেও দেখা যায়৷ শ্রম এবং পুঁজির মধ্যে যে বিরোধাত্মক দ্বন্দ্ব, একটা অন্যটাকে উৎখাত করতে চায় তা বুঝেই একজন ব্যক্তিকে তার নিজের অবস্থান নির্ণয় করতে হয়৷ কিন্তু তার পরিবর্তে আপসকামী শক্তি মুখে বিপ্লবের কথা, কোথাও কোথাও মার্কসবাদের কথা বললেও তাদের চিন্তা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা শেষ পর্যন্ত বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থকেই রক্ষা করে৷ এরাই হচ্ছে সেই Social Democratic Force যারা গণভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিপ্লব হবে এই কথা মানতে অনিচ্ছুক এবং এর ঘোরতর বিরোধী৷ এদের মতে ভোটের মধ্য দিয়েই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব৷ এই চিন্তার বিরুদ্ধে মার্কসকেও কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছে৷ প্রথম আন্তর্জাতিক গড়ে তোলার পর যখন এই ধরনের মতবাদিক বিভ্রান্তি দেখা দিল, মার্কস তখন প্রথম আন্তর্জাতিক ভেঙে দিলেন৷ পরবর্তীতে এঙ্গেলসের নেতৃত্বে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক গড়ে ওঠে৷ তাঁর মৃত্যুর পর লেনিনই একে সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্য সচেষ্ট হন৷সেখানেও কাউটস্কিরা এসে একই তত্ত্বের আমদানি করল যে, গণভ্যুত্থানের দরকার নেই, ভোটের মধ্য দিয়েই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব৷ লেনিন এর বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বললেন৷ লেনিন বললেন,  acceptance of class struggle is not enough, acceptance of class struggle must end in the acceptance of the dictatorship of the proletariat  অর্থাৎ কেবল শ্রেণিসংগ্রামের কথা বললেই হবে না৷ শ্রেণিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার অপরিহার্যতা উপলব্ধি করতে হবে৷ শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যেও শ্রম ও পুঁজির মধ্যে আপসকামী এই শক্তির বিশ্বাসঘাতক ভূমিকা উদঘাটন করে লেনিন বলেছিলেন প্রকৃত শ্রমিক আন্দোলন(trade union movement) অর্থনীতিবাদ বা যে কোনও উপায়ে কিছু পাইয়ে দেওয়ার আন্দোলন নয়–  বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন হচ্ছে school of communism ৷ যার অর্থ হচ্ছে ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনের সাথে সাথে কমিউনিস্ট চরিত্র অর্জনেরও একটি আন্দোলন৷

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের অপূর্ব প্রয়োগ ঘটিয়ে বিপ্লবী সংগঠন ও সাংগঠনিক কার্যকলাপ পরিচালনা করার ক্ষেত্রে লেনিন যেসব অসামান্য অবদান রেখে গেছেন তার আরও কয়েকটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার কথা উল্লেখ করতে চাই৷ তিনি বলেছেন, Do not lag behind the people also do not go too much ahead of the people (বিপ্লবীরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে জনগণের পিছনে থাকবে না, আবার তাদের থেকে বেশি এগিয়েও যাবে না)৷ আবার বললেন better fewer but better অর্থাৎ কম হয় হোক তবু অতি অবশ্যই তা যেন ভাল হয়৷ বললেন We communist are the descendants of all national heroes (আমরা কমিউনিস্টরা সকল জাতীয় বীরের উত্তরাধিকারী)৷ তাঁর পথনির্দেশ হচ্ছে concrete analysis of the concrete situation  (বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণ)৷ তিনি বললেন, ভুললে চলবে না যে পুঁজিবাদ ক্ষয়িষু যুগে পৌঁছে গেলেও তার striking capacity অর্থাৎ তার আঘাত হানার ক্ষমতা অটুট রয়েছে৷ জাতি ধর্ম ভাষা প্রভৃতি পৃথকতাবাদকে বর্জন করে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরার যে আহ্বান মহান মার্কস জানিয়েছিলেন, মহান লেনিন সেই চিন্তাকে ভিত্তি করেই তাঁর বিপ্লবী কার্যকলাপ পরিচালনা করেছেন৷ পৃথকতাবাদ, সংকীর্ণতাবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদের চিন্তাধারাকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছেন রুশ আধিপত্যবাদকেও তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছেন৷ সমস্ত নেতা–কর্মীদের এই ধরনের চিন্তাভাবনা থেকে মুক্ত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন৷ কমিউনিস্ট সংগ্রামীদের উদ্দেশ্য করে তিনি এ–ও বলেছেন, ভুললে চলবে না যে, ক্ষয়িষ্ণু যুগে পৌঁছলেও পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে একটা অতি শক্তিশালী প্রচারযন্ত্র রয়েছে৷ তাই তাকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে৷ তাই এ–ও বললেন, a communist must be a good propagandist৷ এর অর্থ হচ্ছে কমিউনিস্টদের সত্য উদঘাটনের ক্ষেত্রে, সত্য প্রচারের ক্ষেত্রে খুবই দক্ষ হতে হবে৷ লেনিনের এই বিষয়ে আরও অসংখ্য শিক্ষা এবং পথনির্দেশ রয়েছে যেগুলি আপনাদের সামনে তুলে ধরার প্রয়োজন থাকলেও এক জায়গায় থামতে হবে৷ আমি আশা করব মহান নভেম্বর বিপ্লবের শতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আপনারা এই অমূল্য শিক্ষাগুলি আয়ত্ত করার দৃঢ় সংকল্প নেবেন৷

সোভিয়েত সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আরও দু’চারটি কথা উল্লেখ করতে গিয়ে কমরেড ভট্টাচার্য বলেন,  ১৯১৭ সালে বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পর সমগ্র বিশ্বেই তার শক্তিশালী প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে৷ শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে সেই আনন্দে সমগ্র বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণি উল্লসিত হয়ে ওঠে৷ রাশিয়ায় মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণের অবসান হয়েছে এই বার্তা বিশ্বের দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে৷ বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠতে থাকে এবং শ্রমিক আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি হয়৷ বিভিন্ন ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন একটা নতুন মাত্রা পায়৷ লেনিনের জীবদ্দশাতেই সোভিয়েত সমাজতন্ত্র সমগ্র বিশ্বকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করে৷ কিন্তু বিপ্লবের মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ১৯২৪ সালে লেনিনের জীবনাবসান হয়৷ তারপর তাঁরই সুযোগ্য ছাত্র, অন্যতম সহযোদ্ধা কমরেড স্ট্যালিন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসেন৷ মার্কসবাদের অতি উন্নত উপলব্ধির ভিত্তিতে এই শিশু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পুনর্নির্মাণের যে কাজ মহান লেনিনের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল, যথাযথভাবে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কঠিন দায়িত্ব তাঁর উপরই অর্পিত হয়৷ স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সারা বিশ্বকে চমকিত করে, অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে যেতে থাকে৷ শুধু সোভিয়েট ইউনিয়নে নয় সারা বিশ্বের জনসাধারণকে তা বিস্ময়াভিভূত করে৷ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সকল জনগণের জীবিকা এবং right to work  বা কাজের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করে৷ বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে অন্ন–বস্ত্র–গৃহ–শিক্ষা-স্বাস্থ্য ইত্যাদি জরুরি প্রয়োজনগুলি পূরণ করার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়৷ সমাজতন্ত্রের এই আকাশছোঁয়া অগ্রগতি অব্যাহত থাকা অবস্থাতেই এক নতুন বিপদ দেখা দিল৷ সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি ফ্যাসিবাদী হিটলারকে পিছন থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করার জন্য মদত দিতে থাকল এবং শেষ পর্যন্ত হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করল৷ স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সেদিন রাশিয়ার দেশপ্রেমিক জনসাধারণ ফ্যাসিবাদী আক্রমণকে যেভাবে পরাস্ত করল, সে এক শিহরণ সৃষ্টিকারী কাহিনি৷ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এই যে বিজয় সেটা সমগ্র বিশ্বকে স্তম্ভিত করল৷ সারা বিশ্বের জনসাধারণের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর উপচে পড়ল৷ সমাজতন্ত্রের আবেদন গগনস্পর্শী হল৷ এই অবস্থায় যুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়৷ পার্টি কংগ্রেসে স্ট্যালিন যে রিপোর্ট পেশ করলেন তাতে দেখা গেল যে, বিপ্লবের পরবর্তী ৩৫ বছরে সোভিয়েত ইউনিয়নে যে পার্থিব উন্নয়ন হয়েছে, উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে উন্নতি ঘটেছে তা উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ দেশ আমেরিকাকেও বহু ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে গেছে৷ এই সবের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেতরে এবং বাইরে জনগণের মধ্যে এমন একটা ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে সাম্যবাদ বেশি দূরে নয়৷ কিন্তু পার্থিব এই অভূতপূর্ব উন্নয়নের রিপোর্টের পাশাপাশি স্ট্যালিন অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে এটাও দেখালেন যে, আদর্শগত ক্ষেত্রে, তত্ত্বগত ক্ষেত্রে, সংস্কৃতিগত ক্ষেত্রে, সোভিয়েত ইউনিয়নের জনসাধারণকে জড়িত করে পার্টির ভিতরে এবং বাইরে যতটা তীব্র এবং ব্যাপক সংগ্রাম পরিচালনা করা দরকার ছিল সেটা হয়ে ওঠেনি৷ যার ফলে কিছু ক্ষেত্রে অত্যন্ত ক্ষতিকারক চিন্তা, পুঁজিবাদী ভাবনা–চিন্তা, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, ব্যক্তিসম্পত্তিবোধ মাথাচাড়া দিয়েছে৷ দৃঢ়তার সাথে স্ট্যালিন বললেন, সংস্কৃতিগত ক্ষেত্রে সর্বহারা সংস্কৃতির চর্চা তীব্রতর করে পার্টির ভেতরে এবং বাইরে পুঁজিবাদী ভাবনা চিন্তার বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে, ভাবগত উপলব্ধিকে সময়োপযোগী করে সমৃদ্ধ করতে হবে৷ স্ট্যালিনের এই সতর্কবাণী থেকে এটা পরিষ্কার– গগনচুম্বী এই অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করার জয়জয়কারের মধ্যেও এই মারাত্মক সমস্যাগুলি তিনি ঠিকই চিহ্ণিত করেছিলেন৷ পরিষ্কার বোঝা যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সমস্যার প্রকৃতি ঠিক ভাবে অনুধাবন করে এবং গভীরে গিয়ে এগুলি মোকাবিলা করার জরুরি প্রয়োজন তিনি অনুভব করেছিলেন৷ পার্টির ১৯তম কংগ্রেসের সেই রিপোর্ট পড়লে একটা ধারণা হয় যেন স্ট্যালিন একটা সর্বাত্মক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূচনা করার কথা চিন্তা করছিলেন৷ কিন্তু ঠিক তার পরেই ১৯৫৩ সালে হঠাৎ স্ট্যালিনের জীবনাবসান হয়৷ ফলে সেটা আর হয়ে উঠল না৷ মহান স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে আধুনিক শোধনবাদীরা পার্টি এবং রাষ্ট্র পরিচালনার কর্তৃত্বে চলে আসে৷ ক্ষমতায় এসেই রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে, অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে, শিক্ষা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রের নাম আওড়ে আওড়েই খুবই পরিকল্পিত ভাবে পুঁজিবাদী চিন্তা ভাবনা, ব্যক্তিগত লাভ, ব্যক্তিগত আয় বৃদ্ধির মানসিকতাকে উৎসাহিত করতে থাকে৷ সমষ্টিগত স্বার্থ চিন্তার বিপরীতে ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তাকে, ব্যক্তিগত লাভালাভের মানসিকতাকে উৎসাহিত করতে থাকে৷ কমিউনিজমের মর্মবস্তুকে অনুধাবন করা এবং সেগুলোকে সঠিক ভাবে অনুসরণ করে ব্যক্তিস্বার্থকে সমাজস্বার্থের সঙ্গে একীভূত করে দেওয়ার চিন্তাকে গভীরে নিয়ে যাওয়াই ছিল যখন জরুরি প্রয়োজন, তখন দেখা গেল ঘটছে তার বিপরীতটাই৷ আমি আরও বেশি টাকা পেতে চাই, আরও বেশি বেতন চাই, আরও আরামে থাকতে চাই এই সমস্ত অতি সংকীর্ণ ব্যক্তি স্বার্থকেন্দ্রিক চিন্তা নগ্নভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল৷ এই জঘন্য ষড়যন্ত্রকারীরা সমাজতন্ত্রের লেবেল লাগিয়ে নিকৃষ্ট পুঁজিবাদী চিন্তা ভাবনাকেই উস্কে দিতে থাকল৷ এদের চক্রান্তে নীতি, আদর্শ, কর্তব্যবোধ সব শিকেয় উঠল৷ সমাজজীবনে ভোগবাদ স্পষ্ট হয়ে উঠল৷ অতি জঘন্য পুঁজিবাদী সংস্কৃতি, সমস্ত প্রকার অপসংস্কৃতি এবং অশ্লীল যৌনতা গোটা সমাজকে আচ্ছন্ন করতে থাকল৷ এরই চূড়ান্ত পরিণামে সমাজতন্ত্র– যা ছিল সারা বিশ্বের মানুষের কাছে এক চরম বিস্ময়– তাকে আর রক্ষা করা গেল না৷ পুঁজিবাদী প্রতিবিপ্লব তাকে গ্রাস করল৷  

সঠিক বৈজ্ঞানিক পথে সর্বাত্মক উন্নয়ন ঘটিয়ে সমাজ ও সভ্যতাকে এতটা উপরে নিয়ে যাওয়া এবং সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের আকাশছোঁয়া উন্নতি সমগ্র বিশ্বকে স্তম্ভিত করার পরও সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের এই পতন, এই করুণ পরিণতি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিতরে ও বাইরে সকল মানুষের কাছে একটা বিরাট আঘাত হিসাবেই এসেছে৷ কিন্তু কারণ ছাড়া কোনও কিছুই ঘটে না– এটাই বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত৷ এটা লক্ষ করা গিয়েছে যে আধুনিক শোধনবাদের পথ বেয়েই প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়ন তারপর চীন এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়েছে এবং পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ ১৯৫৬ সালে ক্রুশ্চেভপন্থী আধুনিক শোধনবাদীরা পার্টি এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকেই আমাদের প্রিয় নেতা, শিক্ষক এই যুগের অন্যতম অগ্রগণ্য মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ এই কথাটি বারবার বলেছেন, আধুনিক শোধনবাদ সমাজতন্ত্রের মোড়কে পুঁজিবাদী চিন্তারই সমাহার, তারই ধারক বাহক৷ বলেছেন, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আপেক্ষিক অর্থে চিন্তা–চেতনার নিম্নমানের সুযোগ নিয়েই আধুনিক শোধনবাদ জন্ম নেয়৷ কমরেড ভট্টাচার্য বলেন, টানা ৩৫ বছর এই আধুনিক শোধনবাদ সমাজতন্ত্রের নাম করে সমাজতন্ত্রের নবীকরণের কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পুঁজিবাদকে ফিরিয়ে আনার পরিপূরক সকল কাজই করেছে৷ এদের এই ধরনের শোধনবাদী কার্যকলাপ শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নেই আবদ্ধ থাকেনি, চীনেও আধুনিক শোধনবাদ প্রবল আকারে দেখা দিল৷ এই ভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও তা ছড়িয়ে পড়ল৷ এরই বিষময় পরিণামে সারা বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে পড়ল৷ মাও সে–তুং তখনও জীবিত৷ সোভিয়েত ইউনিয়নের এই অবনমন লক্ষ করে চীনকে তা থেকে মুক্ত রাখতে তিনি ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা করলেন৷ দেশের সমস্ত জনসাধারণকে যুক্ত করে ভাবগত ক্ষেত্রে, চিন্তাগত ক্ষেত্রে এই শোধনবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে মাও সে–তুঙের নেতৃত্বে পরিচালিত মহান সাংস্কৃতিক আন্দোলন সমগ্র বিশ্বকে প্রভাবিত করল৷ আধুনিক শোধনবাদ কী, কী তার স্বরূপ তা ধরতে এবং বুঝতে চীনের এই সাংস্কৃতিক বিপ্লব সারা বিশ্বের জনসাধারণকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে৷ ছয় বছর ধরে এই আন্দোলন পরিচালিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শোধনবাদী, পুঁজিবাদী রাস্তার প্রবক্তা লিউ শাও চি এবং তেঙ শিয়াও পিঙ এবং তাদের সহচররা পরাজিত হয় এবং সমস্ত রকম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে তাদের অপসারণ করা হয়৷

চীনের এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে কমরেড শিবদাস ঘোষ অভিনন্দন জানিয়ে বললেন যে, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুঁজিবাদী চিন্তা–ভাবনার বিরুদ্ধে চীনের এই সংগ্রাম অসাধারণ, অতি মহান৷ কিন্তু একই সাথে তার দুর্বলতার দিকটিও তিনি তুলে ধরলেন৷ কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখালেন এই মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বহু অভিনব দিক রয়েছে এবং এই মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লব চীনের আধুনিক শোধনবাদীদের ক্ষমতাচ্যুত করতেও সক্ষম হয়েছে৷ কিন্তু তৎসত্ত্বেও তাকে নির্মূল করার জন্য, সব দিক থেকে তার শিকড় উৎপাটন করার জন্য যে তত্ত্বের উদ্ভাবন করা প্রয়োজন ছিল তাকে উদ্ভাবন করার প্রশ্নে বহু দূর গিয়েও শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি৷ সমাজতান্ত্রিক দেশে অর্থনৈতিক দিক থেকে আপেক্ষিক অর্থে যখন খানিকটা ‘স্টেবিলিটি’ (স্থিতিশীলতা, নিশ্চয়তা) আসে তখনই তার ভিতর একটা নতুন ধরনের সুবিধাবাদের জন্ম নেওয়ার বিপদ দেখা দেয়৷ তীব্র আদর্শগত, সংস্কৃতিগত আন্দোলন বহমান না থাকলে শ্রমিক আন্দোলনে নতুন ধরনের ‘ইকনমিজমের’ বা অর্থনীতিবাদের জন্ম হয় এবং তারই সাথে জন্ম নেয় এক নতুন ধরনের বুর্জোয়া ব্যক্তিবাদ যাকে তিনি socialist individualism বা ‘সমাজতান্ত্রিক ব্যক্তিবাদ’ বলে অভিহিত করেছেন৷ ইউরোপের শ্রমিক আন্দোলনে যখন অর্থনৈতিক সুবিধাবাদ দেখা দেয় তখন লেনিন তার তীব্র নিন্দা করে বলেছিলেন, শ্রমিক আন্দোলন সুবিধাবাদ চর্চা করার আসর নয়৷ শ্রমিক আন্দোলন হবে স্কুল অফ কমিউনিজম অর্থাৎ কমিউনিজম চর্চা করার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷ এই চিন্তার আরও বিকাশ ঘটিয়ে কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখালেন যে, বুর্জোয়া মানবতাবাদ নিঃশেষিত হওয়ার পর আজকের দিনে কমিউনিস্ট চেতনার মান এমন স্তরে নিয়ে যেতে হবে যার থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, ব্যক্তিস্বার্থ ও সমাজস্বার্থ এক ও অভিন্ন৷ এই উপলব্ধি পার্টির অভ্যন্তরে এবং সমাজ জীবনে জন্ম দিতে হবে যে, ব্যক্তিস্বার্থ ও সমাজস্বার্থের মধ্যে কোনও বিরোধাত্মক দ্বন্দ্ব নেই৷ ব্যক্তিগত ভাবে কিছু পাওয়ার আকাঙক্ষা নয়, ব্যক্তিকে উপলব্ধি করতে হবে সমগ্র সমাজকে সমস্ত দিক থেকে সমৃদ্ধিশালী করার মধ্য দিয়েই সুনিশ্চিত হবে একজন ব্যক্তির সর্বাত্মক বিকাশ৷ দৃঢ়তার সাথে কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছেন, এই তত্ত্বটা সারা বিশ্বের বিপ্লবী আন্দোলনে যদি শক্তিশালী দার্শনিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়, যতটা গভীরে যাওয়া যায় ততটা গভীরে যায় একমাত্র তখনই আধুনিক শোধনবাদকে পরাস্ত করা সম্ভব হবে৷ কমরেড শিবদাস ঘোষ উল্লেখ করেছেন, এই প্রশ্নে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব বহু দূর পর্যন্ত গিয়েও তত্ত্বের আকারে তা তুলে ধরতে পারেনি৷ গভীর ভাবে উদ্বিগ্ণ হয়ে তিনি বলেছেন এই পরিস্থিতিতে সাময়িকভাবে শোধনবাদকে প্রতিহত করা গেলেও ভবিষ্যতে তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে৷ আর সর্বহারার মহান নেতা মাও সে–তুঙের মৃত্যুর পর ঠিক তাই ঘটল৷ তেঙ সিয়াও পিং–এর নেতৃত্বে আধুনিক শোধনবাদ চীনে ফিরে এল এবং এর পথ বেয়েই ২০০৪ সালে চীনে পুঁজিবাদী প্রতিবিপ্লব সংঘটিত হল৷ এই অভাবনীয় দুর্ঘটনা সারা বিশ্বের আপামর জনসাধারণকে শোকস্তব্ধ করেছে৷

স্পষ্টতই পুঁজিবাদ–সাম্রাজ্যবাদ মার্কসবাদ–লেনিনবাদের তথা বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনের এই সাময়িক বিপর্যয়ের সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে৷ মার্কসবাদ–লেনিনবাদকে যত প্রকারে পারা যায় কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু আমি মনে করি যত আঘাতই আসুক না কেন কারওরই ভেঙে পড়ার কোনও কারণ নেই৷ পৃথিবী তথা এই বিশ্ব–ব্রহ্মাণ্ডে ঘটনা যেমন ঘটে, তেমনি দুর্ঘটনাও ঘটে– দুটোই কোনও না কোনও কারণের ফলে ঘটে, কারণবহির্ভূত ভাবে কোনও ঘটনাই ঘটে না৷ বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠা করেছে, গোটা বিশ্বই হচ্ছে law governed, নিয়ম মেনেই তার অবস্থান৷ এ কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, বিজ্ঞানে এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরীক্ষা–নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার তত্ত্বই রয়েছে, কেবল সাফল্য বা কেবল ব্যর্থতা– এই ধরনের কোনও ধারণাই বিজ্ঞানে নেই৷ যা এই মুহূর্তে জানা দরকার বা যা হওয়া দরকার তাকে জানা বা পাওয়ার ক্ষেত্রে আপাত ব্যর্থতা বা অসম্পূর্ণতা দেখা দিলে, আরও উন্নততর পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে তাকে অতিক্রম করে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য নিরলস সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার তত্ত্বই বিজ্ঞানে রয়েছে৷ আমাদের এই বিশ্বাসে অবিচল থাকতে হবে৷ রাশিয়া চীন সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলিতে সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়ার ঘটনাকেও এই বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গিতে মার্কসীয় বিজ্ঞান দর্শনের সঠিক উপলব্ধির ভিত্তিতে বিচার করতে হবে৷ রাশিয়ায় ১৯১৭ সালের পৃথিবী কাঁপানো এই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব কোনও একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর একটা manoeuver ছিল না, একটা কারসাজি ছিল না, হঠাৎ হয়ে যাওয়া একটা ঘটনাও ছিল না৷ নির্ভুলভাবে বিজ্ঞান অনুসরণ করে, সমাজ বিকাশের নিয়ম কঠোর ভাবে অনুসরণ করেই এটা সম্ভবপর হয়েছিল৷ বিজ্ঞান এবং দর্শনের সঠিক উপলব্ধির ভিত্তিতে সমাজের মুষ্টিমেয় শোষক এবং তাদের তাঁবেদারদের বাদ দিয়ে, সকল মানুষকে সত্যের উপর দাঁড় করিয়ে, সম্পূর্ণ সচেতন করে সংগঠিত একটি অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান ছিল এটি৷ তাই যত ভাবেই চেষ্টা হোক না কেন– এ মহা সত্যকে, এই সূর্যোদয়কে ম্লান করা যাবে না, ঢাকা যাবে না৷ উল্টো দিক থেকে সমাজতন্ত্রের ভেঙে পড়ার ঘটনাও একটা বাস্তব ঘটনা৷Law of causality বা কার্য–কারণবাদ অনুসারেই সংগঠিত একটি ঘটনা৷ তাই বিজ্ঞানকে অনুসরণ করে এর মূল কারণ, প্রকৃত কারণ নির্ণয় করে তার থেকে বেরিয়ে আসার নির্ভুল পথ নির্ধারণ করে, তার ভিত্তিতেই এই প্রতিবিপ্লবী চিন্তা–ভাবনাকে দার্শনিক স্তরে demolish (ধূলিসাৎ) করতে হবে৷ নতুন চিন্তার ভিত্তিতে, নতুন মানুষের জন্ম দিয়ে প্রতিবিপ্লবের এই অধ্যায়কে অতিক্রম করে মার্কসের চিন্তার ভিত্তিতে Scientific Socialism বা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের জয়পতকাকে উড্ডীন করতে হবে৷ লেনিনের অপূর্ব উক্তি– Turn your disadvantage into advantage, turn your grief into determination ই হবে আমাদের পাথেয়৷ সন্দেহজাত মানসিকতা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার কোনও স্থান জ্ঞানচর্চায় নেই৷মার্কসবাদের বৈজ্ঞানিক সত্যতা unchallengeable (যাকে চ্যালেঞ্জ করা অসম্ভব) এবং এই অর্থেই এই বিজ্ঞান অপ্রতিরোধ্য, কোনও বাধাই শেষ পর্যন্ত এই জয়যাত্রাকে আটকাতে পারবে না৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রম এবং পুঁজির মধ্যে যে বিরোধাত্মক দ্বন্দ্ব বা ধ্বংসাত্মক দ্বন্দ্ব অহর্নিশ কাজ করে চলেছে, তার হাত থেকে এই ব্যবস্থা রেহাই পেতে পারে না, কিছুতেই নিজেকে বাঁচাতে পারে না৷ এই দ্বন্দ্বই ব্যক্ত হবে ভাবগত ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের জন্মের মধ্য দিয়ে৷ এর নিরসন হবে পুঁজিবাদকে উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে৷ নতুন উপলব্ধির ভিত্তিতে মার্কসবাদ আরও আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠবে৷ নিত্য নতুন উপলব্ধি ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মার্কস যে অতি উন্নত ধরনের মানুষ বা man–এর ধারণা আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন তা সার্থক হবে, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, মার্কসবাদের ধারণা অনুসারে সাম্যবাদের দিকে পা বাড়াবে৷ বাস্তব পরিস্থিতিতে রাশিয়া, চীন সহ গোটা বিশ্বের বিপ্লবী আন্দোলন পুনরুজ্জীবিত করার জন্য যে নতুন অভিমুখ সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ তুলে ধরেছেন, ব্যক্তিস্বার্থ এবং সমাজস্বার্থকে একীভূত করার যে অভ্রান্ত তত্ত্বের অবতারণা করেছেন– তাকে ভিত্তি করেই, একমাত্র তাকে ভিত্তি করেই উত্তরণের দিকে দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে৷মহান নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষে এটাই আহ্বান৷

 

ইনকিলাব জিন্দাবাদ

ঐতিহাসিক মহান নভেম্বর বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক

সর্বহারার মহান নেতা লেনিন লাল সেলাম

সর্বহারার মহান নেতা স্ট্যালিন লাল সেলাম

সর্বহারার মহান নেতা শিবদাস ঘোষ লাল সেলাম