Breaking News

আগে পুনর্বাসন, পরে খনিপ্রকল্প দাবি এস ইউ সি আই (সি)-র

বীরভূমের ডেউচা-পাঁচামিতে প্রস্তাবিত খনি প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে পূর্ণ সহমতের ভিত্তিতে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে কোনওমতেই খনির কাজ শুরু করা যাবে না–এই দাবিতে ১৫ ফেব্রুয়ারি শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে এস ইউ সি আই (সি)-র রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। ছয় জনের একটি প্রতিনিধিদল এই বিষয়ে মন্ত্রীর সাথে বিস্তৃত আলোচনা করেন। রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে এই প্রতিনিধিদলে ছিলেন ভূ-বিজ্ঞানী, প্রেসিডেন্সি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ডঃ ধ্রুবজ্যোতি মুখোপাধ্যায়, প্রাক্তন সাংসদ ডাঃ তরুণ মণ্ডল, প্রাক্তন বিধায়ক তরুণ নস্কর, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কমরেড অমল মাইতি ও দলের বীরভূম জেলা সম্পাদক কমরেড মদন ঘটক।

এ দিন পৃথক ভাবে মুখ্যমন্ত্রীকে একটি স্মারকলিপি দেন রাজ্য সম্পাদক। তাতে তিনি বলেন, প্রাকৃতিক সম্পদ দেশের জনগণের সম্পদ। এই সম্পদ জনগণের স্বার্থে ব্যবহার করতে হবে এবং এর সুফল যাতে এলাকাবাসীর কর্মসংস্থান সহ সকল প্রকার উন্নয়নের কাজে লাগে তা সুনিশ্চিত করা সরকারের কর্তব্য। তিনি স্পষ্টভাবে দাবি করেন, খোলামুখ খনি নয়, আন্ডারগ্রাউন্ড খনি করতে হবে।

শিল্পমন্ত্রীর কাছে প্রতিনিধিরা খনি প্রকল্পে উচ্ছেদের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা পরিবারগুলি ও সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্তদের জীবন-জীবিকার গুরুতর সমস্যার দিকগুলি তুলে ধরেন। শুরুতেই গত ২৩ ডিসেম্বর’২১ দেওয়ানগঞ্জ গ্রামে আদিবাসী মহিলাদের উপর পুলিশ এবং সমাজবিরোধীদের নির্মম অত্যাচারের ঘটনা উল্লেখ করে অপরাধীদের গ্রেফতার, এমনকি কোনও আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভ জানিয়ে অবিলম্বে তাদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি জানানো হয়। আলোচনায় দাবি জানানো হয়–১) সরকারি প্যাকেজে জমির যে দাম ধার্য হয়েছে তা অত্যন্ত কম, যদিও সরকার বলছে জমিদাতাদের তিনগুণ হারে জমির দাম দেওয়া হচ্ছে, অথচ ওখানে যে দামে এখন জমি কেনাবেচা হচ্ছে তা ঘোষিত প্যাকেজের তুলনায় দ্বিগুণ। স্বাভাবিক ভাবেই জমির ক্ষতিপূরণ মূল্য দ্বিগুণ করতে হবে। ২) চাকরির প্রশ্নে শুধু জুনিয়র পুলিশ বা কনস্টেবলের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ওখানে অনেক উচ্চশিক্ষিত এমনকি বি-টেক পাশ আদিবাসী বেকার যুবকও আছে। ফলে যোগ্যতা অনুযায়ী প্রতি পরিবারে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সক্ষমদের স্থায়ী চাকরি দিতে হবে। ৩) রেকর্ড সংশোধন করে প্রকৃত জমির মালিককে আইনি সহায়তা দিতে হবে। ভূমিহীন এবং খাস জমিতে বসবাসরত সকলকে পাট্টা দিতে হবে এবং তাদেরও রায়তদের ন্যায় ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। খেতমজুর এবং খাদান, ক্র্যাশারে কর্মরত শ্রমিকদের বিকল্প আয়ের মতো ব্যবস্থা ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ৪) পাড়া ও পুরো গ্রাম থেকে যারা উচ্ছেদ হবেন তাদের এবং বিশেষ করে আদিবাসীদের পরম্পরাগত জীবনযাত্রার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিবেশবান্ধব জায়গা সহ বাড়ি তৈরি করে দিতে হবে। ৫) মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। ৬) মুখ্যমন্ত্রী বারবার জবরদস্তি উচ্ছেদ না করে সহমতের ভিত্তিতে কাজ শুরুর কথা বললেও, বর্তমানে এলাকার মানুষকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে একতরফা ভাবেই সরকারি জমিতে কাজ শুরুর ঘোষণা করেছেন। সেক্ষেত্রে সরকারি জায়গাতেও খনির কাজ শুরু হলে তার ধাক্কায় আশেপাশে ঘর বাড়ি এবং জমি-ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হবে। ফলে তারা এই ধাক্কাতেই উচ্ছেদ হয়ে যাবেন। এই ঘোষণা এলাকাবাসীর পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর শুধু নয়, অনেকেই এই পরিকল্পনাকে দুরভিসন্ধিমূলক মনে করেন, ফলে এই কাজ থেকে সরকারকে বিরত থাকতে হবে।

মন্ত্রীমহোদয় সমস্ত বক্তব্যগুলিকেই যুক্তিসঙ্গত এবং ন্যায়সঙ্গত বলে স্বীকার করেন। নেতৃবৃন্দ দাবি করেন, বর্তমান সময়ে পরিবেশবিদ, স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা খোলামুখ খনির পরিবর্তে আন্ডারগ্রাউন্ড খনির প্রস্তাব করেছেন। তার ফলে দূষণ, প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা এবং উচ্ছেদের ক্ষেত্রেও কম ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। মন্ত্রীমহোদয় এই প্রশ্নে আন্ডারগ্রাউন্ড খনির ক্ষেত্রে অসুবিধার কথা বললে প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে বলা হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এবং আমাদের দেশে আন্ডারগ্রাউণ্ড খনি চলছে, এখানেও এটা করা অসম্ভব নয়। মন্ত্রী তা স্বীকার করেন। প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে সমগ্র প্রকল্পের ডিপিআর অর্থাৎ ডিটেইলড প্রোজেক্ট রিপোর্ট প্রকাশের দাবি করা হয়। সর্বোপরি এলাকার ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে দূষণ ইত্যাদি রোধে কার্যকরী আধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভূ-বিজ্ঞানী, খনি বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্য বিশেজ্ঞ, কৃষি বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদদের মতামত নিয়ে এবং তা গ্রহণ করে কার্যকর করার দাবি জানানো হয়।

মন্ত্রীমহোদয় জানান তিনি সমস্ত বিষয়গুলি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁর মতামত সহ জানাবেন। তিনি বলেন জেলায় এই বিষয়গুলি নিয়ে প্রশাসন কী ব্যবস্থা নিয়েছে এবং নেবে সে বিষয়ে আলোচনায় বসা দরকার। এজন্য তিনি তৎক্ষণাৎ বীরভূম জেলাশাসককে নির্দেশ দেন। প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে বলা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না এই সমস্যাগুলি পুরোপুরি সম্মতির ভিত্তিতে মীমাংসিত হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত কোনওভাবেই প্রকল্পের কাজে হাত দেওয়া চলবে না। তা না হলে এলাকার মানুষ শুধুমাত্র সরকারি প্রতিশ্রুতির উপর নির্ভর করে থাকবে, তা মোটেও হতে পারে না।

অভিজ্ঞতা বলে, বলপ্রয়োগের প্রশ্ন এলে এলাকা অশান্ত হয়ে উঠতে পারে। এ কথা স্মরণে রাখতে হবে, শান্তি-শৃঙ্খলা, সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখার দায়িত্ব শুধু ওখানকার মানুষের নয়, মূলগত ভাবে তা অবশ্যই সরকারের।

 

খনি-আন্দোলন ভাঙতে শাসক দলের হামলা প্রতিবাদ এসইউসিআই(সি)-র

খনির বিরুদ্ধে এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) নয়। দলের দাবি, আন্ডারগ্রাউন্ড খনি করতে হবে এবং তা করার আগে ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন দিতে হবে। এই দাবিতে ১৯ ফেব্রুয়ারি মহম্মদ বাজারে হ্যান্ডবিল বিলি করার সময় দলীয় কর্মীদের উপর হামলা করে তৃণমূল দুষ্কৃতীরা। দলের বীরভূম জেলা সম্পাদক কমরেড মদন ঘটক ওই দিন এক বিবৃতিতে এই হামলার নিন্দা করেন। তিনি বলেন, ডেউচা-পাঁচামি এলাকায় কয়লা খনি প্রকল্পে সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে সহমতের ভিত্তিতে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন না দিয়ে খনির কাজ শুরু করা চলবে না–এই দাবি এসইউসিআই (সি) প্রথম থেকে করে আসছে। ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত ৯ দফা দাবির ভিত্তিতে ইতিমধ্যে একাধিকবার জেলাশাসক দপ্তরে বিক্ষোভ এবং স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে দেওয়া স্মারকলিপি নিয়ে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সাথে এসইউসিআই (সি) রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ছয় জনের প্রতিনিধি দল ১৫ ফেব্রুয়ারি দেখা করে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

১৯ ফেব্রুয়ারি মহম্মদ বাজারে দাবি-হ্যান্ডবিল নিয়ে প্রচারের সময় তৃণমূলের ২০-২২ জনের বাইকবাহিনী অতর্কিতে হামলা করে। জেলা কমিটির প্রবীণ সদস্য কমরেড স্বাধীন দলুই সহ অন্যান্য কর্মী, এমনকি মহিলা কর্মীর্দেরও ধাক্কাধাক্কি করে ও ঘুষি মারে। পুলিশের উপস্থিতিতেই দুষ্কৃতীরাপ্রচারপত্র সহ অন্যান্য কাগজপত্র, ফ্লেক্স কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে দেয় এবং এলাকা থেকে প্রচারকর্মীদের চলে যাওয়ার হুমকি দেয়। এইভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে শান্তিপূর্ণভাবে মতামত প্রকাশের পরিবেশ ধ্বংস করে সন্ত্রাসের বাতাবরণের দ্বারা বিরোধী কণ্ঠস্বরকে দমন করার বিরুদ্ধে জনগণকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ২৮ সংখ্যা ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২