‘‘প্রধানমন্ত্রী, আমার আত্মহত্যার জন্য আপনিই দায়ী”–ফেসবুক লাইভে এসে বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হওয়ার আগে দেশের মানুষের উদ্দেশে এ কথা বলে গেছেন উত্তরপ্রদেশের রাজীব তোমর। জুতোর ছোট ব্যবসা ছিল তাঁর। বিজেপি সরকারের নির্লজ্জ একচেটিয়া পুঁজিপতি তোষণকারী নীতির পরিণামে যে অসংখ্য ছোট ব্যবসায়ী, ছোট কারখানার মালিক, সাধারণ চাকরিজীবী কিংবা শ্রমিক-দিনমজুর দিনে দিনে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে চলেছেন, তোমর ছিলেন তাঁদের একজন। শুধু তিনিই নন, গত কয়েক বছরে দিল্লি সীমান্তে কৃষক আন্দোলনের ময়দান ছাড়াও অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রের আরও বহু মানুষ আত্মঘাতী হওয়ার জন্য সরাসরি দায়ী করে গেছেন প্রধানমন্ত্রীকে। বিজেপি সরকারের জনস্বার্থবিরোধী যে জঘন্য পদক্ষেপগুলি এঁদের প্রাণ কেড়ে নিল, সরকারের প্রধান হিসাবে তার দায়িত্ব তো প্রধানমন্ত্রীর ওপরেই বর্তায়!
দেশে প্রতিদিন আত্মঘাতী হন গড়ে ২৩ জন। তোমর যেদিন আত্মঘাতী হন, সেই ৯ ফেব্রুয়ারিই রাজ্যসভায় খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এ কথা জানিয়েছে। তথ্য দিয়ে তারা জানিয়েছে, ২০১৮ থেকে ২০২০– এই তিন বছরে দেশের ২৫ হাজার ২৩১ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। এঁদের কেউ বেকারত্বের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে, কেউ বা দেনায় ডুবে কিংবা দেউলিয়া হয়ে এমন মর্মান্তিক ভাবে জীবনের অবসান ঘটিয়েছেন।
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পার হওয়ার পরেও, পৃথিবীর অন্যতম শক্তিধর দেশের তকমাধারী ভারতে কারা সেই মানুষ, জীবনের ভার বইতে না পেরে এ ভাবে যাদের হাল ছেড়ে দিতে হচ্ছে? রিপোর্ট বলছে, সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় আত্মঘাতী হয়েছেন ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষই। লকডাউনের বছরটিতে বিরাট সংখ্যায় ছাত্রছাত্রীও আত্মহত্যা করেছেন। বিজেপি সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা এর দায় কোভিড পরিস্থিতির উপর চাপিয়ে দেওয়ার যত চেষ্টাই করুন, তা যে সত্য নয়, একটু তলিয়ে দেখলে ধরা পড়ে। এনসিআরবি-র তথ্য থেকেই দেখা যাচ্ছে, মোদি সরকার যখন প্রথমবার সরকারে বসে, সেই ২০১৪ সালে দেশে মোট আত্মঘাতীর ১২ শতাংশ ছিলেন দিনমজুর। কেন্দে্র বিজেপি সরকারের আমলে প্রতি বছর বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৯-এ এই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। পাশাপাশি, কোভিড আসার আগেই ২০১৯ সালে বেকারত্বের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে আত্মঘাতী হয়েছিলেন ২ হাজার ৮৫১ জন। ২০২০-তে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৫৪৮ জনে।
অর্থাৎ শুধু অতিমারির সময়টুকুতেই নয়, দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের দুই পর্বের শাসনকাল জুড়ে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের আর্তনাদ আর দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে আছে দেশের বাতাস। অথচ এই সময়েই দেশে বিলিয়ন ডলারের অধিকারী একচেটিয়া বৃহৎ পুঁজির মালিকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪২-এ। এঁরা প্রত্যেকেই কমপক্ষে ৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকার সম্পদের অধিকারী। বাস্তবে মোদিজির ব্যাপক ঢাক-ঢোল পেটানো ‘আচ্ছে দিন’ এসেছে শুধু আদানি, আম্বানিদের মতো এইসব একচেটিয়া বৃহৎ পুঁজির মালিকদের জন্যই। কোভিড অতিমারি আর লকডাউনের কারণে একচেটিয়া কারবারিদের লোকসান মেটানোর নাম করে বিপুল টাকা উৎসাহ ভাতা হিসাবে তাদের পায়ে ঢেলে দিয়েছে মোদি সরকার। মকুব করে দিয়েছে বিরাট অঙ্কের ব্যাঙ্কঋণ। রেহাই দিয়েছে করের বোঝা থেকে। শ্রম আইন দু-পায়ে দলে আরও বেশি করে শ্রমিকদের ঘাম-রক্ত নিংড়ে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে পুঁজিমালিকদের। অথচ এই মোদি সরকারই অতিমারির কারণে কাজ খোয়ানো, অর্ধেক কিংবা এক-তৃতীয়াংশ বেতনে খেটে চলা দুর্দশাগ্রস্ত সাধারণ মানুষের জন্য বিনামূল্যে রেশনটুকুও দিয়ে যেতে রাজি হয়নি। আচমকা লকডাউনে কাজ চলে যাওয়া লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক কী খেয়ে বাঁচবে, সন্তান-পরিজন নিয়ে কোথায় মাথা গুঁজবে, সে কথা ভাবার দায়িত্ব তো ছিল মোদি সরকারেরই! সে দায়িত্বের ছিটেফোঁটাও কি পালন করেছেন মোদিজি? বরং হাজার হাজার মাইল পায়ে হেঁটে ঘরের পথে পাড়ি দেওয়া মানুষগুলির কতজন রাস্তায় চূড়ান্ত দুর্ভোগে পড়ে, অবর্ণনীয় কষ্টে কিংবা দুর্ঘটনায় মারা গেলেন, সেই সংখ্যাটুকুর হিসাব রাখাও দরকার মনে করেনি তাঁর সরকার। অতিমারির কারণে যখন অসংখ্য কল-কারখানা, ছোট ব্যবসা বন্ধ, কর্মহীন মানুষের সংখ্যা যখন আকাশ ছুঁয়েছে, ঠিক তখনই সংসদে প্রধানমন্ত্রী নিজের মুখে জানিয়ে দিয়েছেন, চাকরি দেওয়া সরকারের দায়িত্ব নয়। বছর খানেক আগে এই প্রধানমন্ত্রীই চরম নির্লজ্জতার সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর সরকারের প্রধান কাজ শিল্পপতিদের পাশে দাঁড়ানো, সরকারি কর্তাদের অবহেলা ও ষড়যন্ত্রে রুগ্ন হয়ে পড়া সরকারি সংস্থাগুলিকে সাহায্য করা নয়। খেটে-খাওয়া মানুষের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে হাতে গোনা কয়েকজন ধনপতির স্বার্থ দেখাই যে মোদি সরকারের একমাত্র লক্ষ্য– এর পরেও কি তা আর গোপন থাকে?
অথচ ভোটে জিতে সরকারে বসার আগে এই নরেন্দ্র মোদিই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন না, বছরে ২ কোটি বেকারকে চাকরি দেবেন? বলেছিলেন না, অর্থনীতির শ্রীবৃদ্ধি ঘটাবেন? প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন না যে, দুর্নীতি, কালো টাকা দূর করে সুশাসন কায়েম করবেন দেশে? অথচ নতুন চাকরি তো দূরের কথা, গত এক বছরে ২.৫ কোটি মানুষের চাকরি গেছে। কাদের মুনাফার ভাণ্ডার ভরিয়ে তোলার স্বার্থে সে সব প্রতিশ্রুতি জলাঞ্জলি দিলেন মোদিজিরা, এ প্রশ্নের জবাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি করছেন রাজীব তোমরের পরিজনরা। যে পরিযায়ী শ্রমিকরা মোদি সরকারের নির্মম উদাসীনতা ও চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার বলি হলেন, মৃত্যুর আগের মুহূর্তে তাঁরাও তো অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন এই প্রধানমন্ত্রীর দিকেই। দুর্দশার অন্ধকারে আচ্ছন্ন এই দেশে ধুঁকে ধুঁকে কোনও ক্রমে জীবন কাটাচ্ছেন যে কোটি কোটি খেটে-খাওয়া মানুষ, বিজেপি সরকারের কাছে তাঁদেরও প্রশ্ন–‘আচ্ছে দিন’-এর স্বপ্ন ফেরি করে ক্ষমতায় বসে মৃত্যুর ফেরিওয়ালা সাজলেন কেন তাঁরা? শিক্ষা নিয়ে কাদের ব্যবসা বাড়িয়ে তোলার স্বার্থে আজ দেশ জুড়ে দলে দলে ছাত্রছাত্রীকে পড়াশোনার আঙিনা থেকে দূর হয়ে যেতে হচ্ছে? বিপুল পুঁজির একচেটিয়া মালিকদের জন্য যে মোদি সরকার সর্বদা দরাজ-হস্ত, সেই সরকারই কেন লকডাউনে কাজ হারানো লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-দিনমজুর, সংসারের বোঝা টানতে টানতে কুঁজো হয়ে যাওয়া অসংখ্য মানুষকে আজ রেশনের চাল-গমটুকু থেকেও বঞ্চিত করছে? এই যদি হয়, তাহলে পাঁচ বছর অন্তর হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে নির্বাচনের এই নাটকের প্রয়োজন কী মানুষের? যে সংসদীয় ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের নামে মানুষকে নিজেকেই নিজের অত্যাচারী শোষককে বেছে নিতে হয়, মানুষ কেন মুখ বুজে মেনে নেবে সেই অন্যায় ব্যবস্থা?
এ সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে মোদি সাহেবকে। আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ তুলে আত্মঘাতী কোনও মানুষ যদি কারও নাম মৃত্যুকালীন নথিতে লিখে যান, পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। প্ররোচনাদায়ীর বিচার হয় আদালতে। মোদিজি মনে রাখলে ভালো করবেন যে, একচেটিয়া পুঁজিপতিদের মুনাফার স্বার্থে নির্লজ্জ ভাবে নিজেদের যতই বিকিয়ে দিন, রেহাই মিলবে না। আইনের আদালতে না হোক, দেশের যারা আসল মালিক, সেই জনতার আদালতে একদিন এই সব অভিযোগের জবাব দিতে কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে তাঁদের।