স্কুলের শিশুদের খাদ্য হিসাবে বরাদ্দ মিড ডে মিল। তা নিয়েও চলছে সরকারের চরম অবহেলা। স্কুলছুট রুখতে এবং শিশুদের পুষ্টি ঠিক রাখবার জন্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ২০০৪ থেকে স্কুলে মিড ডে মিল চালু হয়েছিল। তাতে ১৪ বছর পর্যন্ত সমস্ত শিশু অর্থাৎ প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিকের শিশুদের খাবার পাওয়ার কথা। প্রাথমিকের ১১ বছর বয়সী শিশুদের ৪৫০ ক্যালরি এবং উচ্চ প্রাথমিকের শিশু-কিশোরদের ৭০০ ক্যালরি পুষ্টিমাত্রা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ওই পুষ্টিমাত্রা অধরাই থেকে গেছে। করোনাকালীন পরিস্থিতিতেও যা শুধু আশ্চর্যের নয়, লজ্জারও বিষয়।
পুষ্টিকর খাদ্য শিশুদের করোনা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। অথচ সরকারি বরাদ্দে তার কোনও বালাই নেই। কেবল চাল আর আলু। এখন তার সঙ্গে মাত্র ২৫০ গ্রাম করে মুসুর ডাল ও চিনি দেওয়া হচ্ছে। মাঝে ১০ মাস ১ কেজি করে ছোলা পেয়েছিল শিশুরা। ছোলার বেশিরভাগ অংশই এত নিম্নমানের ছিল যে তা গরুকে খাওয়াতেও সাহস করেননি অভিভাবকেরা। বিধানসভা নির্বাচনের ৩ মাস সময় অবশ্য সয়াবিন যুক্ত হয়েছিল। মে মাসে ২০০ গ্রাম, পরের ২ মাস কমে ১০০ গ্রাম হয়েছিল। বর্তমানে তাও উধাও। আবার ওই সময় ডাল ও চিনি ৫০০ গ্রাম করে দেওয়া হত। বর্তমানে তা কমিয়ে ২৫০ গ্রাম করে দেওয়া হয়েছে।
স্কুলে যখন মিড ডে মিলের রান্না করা খাবার পরিবেশিত হত তখন শিশুরা সপ্তাহে অন্তত ১টি ডিম (কলকাতায় ২টি করে) পেত। কিন্তু করোনা অতিমারির জন্য রান্না বন্ধ। তাই মাসে একবার করে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা চলছে। কিন্তু প্রায় ২ বছরের করোনাকালে শিশুরা ১টিও ডিম পেল না।
সরকারি নিয়ম, যে ক’দিন স্কুল চলবে সে ক’দিনের জন্য শিশুরা মিড ডে মিল পাবে। অর্থাৎ মাসে গড়ে ২০ দিনের। অথচ এখন শিশুরা বাড়িতে থাকলেও ৩০ দিনের জন্য খাবার দেওয়া হল না। তার ওপর চলেছে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নিয়েও বঞ্চনা। মিড ডে মিল রান্নার সময় উচ্চ প্রাথমিক ছাত্রদের জন্য মাথাপিছু ১৫০ গ্রাম করে চাল বরাদ্দ করা হত। মাসে ২০ দিনের জন্য ৩ কেজি করে বরাদ্দ করা হত। কিন্তু এখন পাচ্ছে ২ কেজি করে। অর্থাৎ মাসে ১ কেজি করে কম চাল দেওয়া হচ্ছে। রাজ্যের অভিযোগ, কেন্দ্র কম পরিমাণ চাল দিচ্ছে। শিশুদের খাদ্য নিয়েও চলছে কেন্দ্র-রাজ্য দড়ি টানাটানি। শিশুরা থাকছে বঞ্চিতই।
মিড ডে মিলে মাথাপিছু বরাদ্দও কম। প্রাথমিকে মাত্র ৪.৯৭ টাকা এবং উচ্চ প্রাথমিকে ৭.৪৫ টাকা। যখন রান্না চলত তখন এই সামান্য টাকায় চাল ও রাঁধুনির খরচ বাদে জ্বালানি, সবজি, তেল-মশলা, ডাল, ডিম ইত্যাদি কেনা হত। কিন্তু এখন তো রান্না হয় না। ফলে সমস্তটাই ছাত্রদের খাদ্যসামগ্রীর জন্য ব্যয় করা উচিত। আশ্চর্যের বিষয়, দীর্ঘ ২ বছরের করোনাকালে বরাদ্দকৃত অর্থের পুরোটা ব্যয় করাই হয়নি। জানুয়ারি মাসের হিসেব দিলেই তা পরিষ্কার হবে। মাসে মাথাপিছু বরাদ্দ প্রাথমিকে ৪.৯৭X২০=৯৯.৪০ টাকা এবং উচ্চ প্রাথমিকে ৭.৪৫X২০=১৪৯ টাকা। খাদ্যসামগ্রীর জন্য ব্যয় ২ কেজি আলুর জন্য ৪০ টাকা, ২৫০ গ্রাম করে মুসুর ডাল ও চিনির জন্য যথাক্রমে যথাক্রমে ২৫ টাকা ও ১১ টাকা। অর্থাৎ মোট ৪০+২৫+১১=৭৬ টাকা। অর্থাৎ যতটুকু বরাদ্দ তা-ও ব্যয় করা হল না, বঞ্চনা করা হল প্রাথমিকে ২৩.৪০ টাকা এবং উচ্চ প্রাথমিকে ৭৩ টাকা করে। এই টাকা কোথায় গেল? রাজ্যের এই স্তরের সব ছাত্রদের হিসাবে ধরলে এই বঞ্চনার পরিমাণ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে মূলত আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া পরিবারের শিশুরা আসে। করোনা পরিস্থিতিতে তাদের বহু পরিবারের কাজ নেই। বিশ্ব ক্ষুধাসূচকে ভারতের স্থান একেবারে তলানিতে। সমীক্ষায় প্রকাশিত, দেশের প্রায় ৮ কোটি মানুষ না খেয়েই রাতে ঘুমোতে যান। অন্য এক সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতের প্রতি ৩টি শিশুর মধ্যে ১টি অপুষ্টিতে ভুগছে। এর ওপর রয়েছে করোনার তৃতীয় ঢেউ যেখানে শিশুরা বেশি করে আক্রান্ত হবে বলে বিজ্ঞানীদের মত। সেই সমস্ত শিশুকে যদি পরিকল্পিতভাবে অপুষ্টিতে রাখা হয় তবে তারা সংক্রমণ প্রতিহত করবে কী ভাবে? মিড ডে মিল চালু করবার অন্যতম কারণ ছিল স্কুলছুট কমানো। বর্তমানে স্কুলছুট কমা তো দূরের কথা বাড়ছে ব্যাপক হারে। অভাবের তাড়নায় স্কুলছাত্র শিশু কিশোররা নানা কাজে লেগে অর্থ রোজগারের চেষ্টা করছে। নাবালিকাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কখনও তারা নিজেরাই বিয়ে করে নিচ্ছে। ব্যাপক স্কুলছুট হয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজন ছাত্রের দু’বেলার হিসেবে পুষ্টিকর খাদ্যের পুরোপুরি দায়িত্ব সরকারিভাবে নেওয়া। নচেৎ সমস্ত আয়োজনই বিফলে যাবে। ছাত্রাভাবে স্কুল তুলে দেওয়ার তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে।
মিড ডে মিলের মতো মিড ডে মিল ওয়ার্কারদের জীবনেও দুর্দশার অন্ত নেই। মূলত দরিদ্র পরিবারের মায়েরা এ কাজে আসেন। তাদের ভাতা হিসাবে মাথাপিছু মাসে মাত্র ১৫০০ টাকা দেওয়া হয়। তাও ২৫ জন ছাত্রের জন্য ১ জন হলেও ১০০ জনে মাত্র ২ জন রাঁধুনি। এরপর প্রতি ১০০ জন ছাত্র পিছু ১ জন করে রাঁধুনি রয়েছে। যা দিয়ে এতজনের রান্না কোনও মতেই সম্ভব নয়। তাও তাঁদের সারা বছর ভাতা দেওয়া হয় না। পুজো এবং গরমের ছুটিতে রান্না বন্ধ, তাই ভাতাও বন্ধ। সংসারের কাজ ফেলে এঁরা সকালবেলায় বিদ্যালয়ে আসেন। তারপর নানা আয়োজনের পর রান্না করে শিশুদের যত্ন করে খাওয়ান। সমস্ত কিছু পরিষ্কার করে প্রায় বিকেলবেলায় বাড়ি ফেরেন। এটাই তাঁদের রোজনামচা। এত খাটুনির পরও তাদের নিজেদের উদরপূর্তির। বঞ্চনার শিকার শিশু থেকে রাঁধুনি সকলেই।