Breaking News

দেড় লক্ষ শিশু বাবা বা মাকে হারিয়েছে, বন্ধ ৫৭ লক্ষ ক্ষুদ্র-মাঝারি সংস্থা–‘দায়িত্বশীল’ সরকার কোথায়?

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি বলেছেন, এতদিন নাগরিকরা অনেক অধিকারের কথা বলেছে, দায়িত্বপালন কেউ করেনি। কথাটি অস্বীকার করতে পারবে না তাঁর ঘোরতর শত্রুরাও। এমন বক্তব্যের ওপর যে কাররই মনে হতে পারে যিনি এমন কথা বলছেন তিনি নিজে অন্তত দায়িত্ব সচেতন, বিশেষ করে দেশের শীর্ষস্থানীয় নাগরিক হিসাবে দায়িত্ব পালনও করেন। কিন্তু বাস্তবটা কী?

২০২০-২২’ গত তিন বছরে দেশে করোনায় মৃত্যু হয়েছে অসংখ্য মানুষের। বহু পরিবারে একমাত্র জীবিত রয়েছে হতভাগ্য শিশু, কোনও পরিবারে কিশোর-কিশোরী। এই সময়ে অনাথ হয়েছে ১০ হাজার শিশু। প্রায় দেড় লক্ষ শিশু বাবা অথবা মা কিংবা উভয়কে হারিয়েছে। এই পরিস্থিতি যে কোনও সংবেদনশীল মানুষের মনেই ধাক্কা দেবে, এই অসহায় শিশুদের পাশে দাঁড়ানোর কথা ভাবাবে। এই শিশুদের পাশে দাঁড়াবে এটাই তো দেশের সরকারের ন্যূনতম দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু কী কেন্দ্র কী রাজ্য কোনও সরকারেরই এদের নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। তা হলে কোন দায়িত্ব পালনের কথা প্রধানমন্ত্রী বললেন?

অর্থনৈতিক মন্দা ও করোনার ধাক্কায় দেশে প্রায় ৫৭ লক্ষ ক্ষুদ্র-মাঝারি সংস্থা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রুটি-রুজি চলে গেছে কোটি কোটি মানুষের। পরিণতিতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের আত্মহত্যা বেড়েছে। সরকার এদের প্রতি কী দায়িত্ব পালন করেছে? ঋণ নিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়া ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ীদের ঋণ মকুব কি করেছে? এই সংস্থাগুলি ঋণ শোধ করতে না পারায় বাজারে টিকে থাকতে পারছে না, বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দক্ষ ও অদক্ষ উভয় শ্রমিকেরই কাজ গেছে (নির্মাণশিল্প, উৎপাদনশিল্প, কৃষিক্ষেত্র, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি)। বিশেষ করে অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মী ও পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবন হয়েছে দুর্বিষহ। আন্তর্জাতিক সামাজিক সমীক্ষা সংস্থা অ’ফ্যামের রিপোর্টে প্রকাশ, এই সময়ে বিশ্বের ৯৯ শতাংশ মানুষেরই রোজগার কমেছে। নতুন করে ১৬ কোটি মানুষ ঢুকেছেন দারিদ্রসীমার মধ্যে। এর মধ্যে রয়েছে ভারতেরও বিশাল সংখ্যক মানুষ। এদের বাঁচাতে তো সরকার এগিয়ে আসেনি। তা হলে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোরা কী দায়িত্ব পালন করলেন!

অবশ্য কোনও দায়িত্বই তারা পালন করেননি, এ কথা বলা যাবে না। ‘গরিব’ ধনকুবেরদের প্রতি সরকার দায়িত্ব পালন করে চলেছে। এই ধনকুবেররা কেমন ‘গরিব’? গত দু’বছরে ভারতে বিলিয়ন ডলারের মালিকের সংখ্যা (অন্তত ৭৪০০ কোটি টাকার সম্পদ যাদের) ৩৯ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৪২ জন। করোনা অতিমারির গত দু’বছরে এদের সম্পদ আকাশ ছুঁয়েছে। বিজেপি সরকার এই ধনকুবেরদের জন্য নানা আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, বকেয়া ঋণ মকুব করে ধারাবাহিক ভাবে এদের প্রতি দায়িত্ব পালন করে চলেছে!

অথচ করোনায় মৃতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বহীনতা চূড়ান্তভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। সরকারি ‘নিয়মের ফাঁসে’ বহু মৃত্যুর ঘটনা নথিভুক্তই হয়নি। যেগুলি হয়েছে, সেই পরিবারগুলিও ক্ষতিপূরণ পায়নি। সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার প্রত্যেক পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা জানিয়েছিল। রাজ্য সরকারগুলির তা দেওয়ার কথা, কিন্তু ক্ষতিপূরণ পায়নি মৃতদের পরিবার। অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এম আর শাহ এবং বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার বেঞ্চ অত্যন্ত ভৎর্সনা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। সরকারের দায়িত্ববোধের উপর তীব্র অনাস্থাই ব্যক্ত হয়, যখন সুপ্রিম কোর্টকে বলতে হয়– ‘ক্ষতিপূরণের টাকা যাতে সকলের কাছে পৌঁছয়, তার ব্যবস্থাপনায় আমরা নিজেরাই এগিয়ে আসব’।

নানা রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা দলগুলি এবং কেন্দে্র ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার পুঁজিপতিদের প্রতি দায়িত্ব পালন করেই চলেছে। তাদের রাজনৈতিক ম্যানেজার এ সমস্ত দলগুলি গদি টিকিয়ে রাখার জন্য পুঁজিমালিকদের স্বার্থেই কাজ করে চলেছে। পাঁচ রাজ্যে ভোটের সামনে প্রধানমন্ত্রী দায়িত্বের প্রসঙ্গ তুললেন কী উদ্দেশ্যে? সরকারের দায়িত্বহীনতার জন্য যে বিক্ষোভ তৈরি হয়েছে তাতে সাধারণভাবে সরকারি প্রশাসনের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে, অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে প্রবল অনাস্থা রয়েছে, মানুষের সেই ক্ষোভ প্রশমিত করতে মলম লাগানো ছাড়া আর কী উদ্দেশ্য এর থাকতে পারে!

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ২৬ সংখ্যা ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২