২৬ নভেম্বর ইউজিসি একটি চিঠিতে দেশের ৪৫টি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তির জন্য অভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বলেছে। চিঠিতে উপাচার্যদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-তে ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি (এনটিএ)-র মাধ্যমে অভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থার নির্দেশ আছে। ওই চিঠিতে দাবি করা হয়েছে যে, এনটিএ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য বিজ্ঞান, মানবীবিদ্যা, ভাষা, কলা এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি প্রধান, সুদক্ষ ও স্বশাসিত পরীক্ষা গ্রহণের সংস্থা হিসাবে কাজ করবে। চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, দেশের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এমন পরীক্ষা ব্যবস্থার কথা জাতীয় শিক্ষানীতিতে থাকলেও এ বছর তারা কেবল কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এই সুযোগ দেবে, যদিও ইচ্ছুক রাজ্য বেসরকারি ডিমড বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তা গ্রহণ করতে পারবে। স্নাতক-স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি নেওয়া সম্পূর্ণভাবে একটি শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়।
ফলে কেমনভাবে ভর্তির সেই পরীক্ষা নেওয়া হবে, প্রশ্নপত্র কেমন হবে, মূল্যায়নের পদ্ধতি কী হবে এবং পরীক্ষান্তে মেধা তালিকা, যার ভিত্তিতে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে, তা প্রস্তুত কেমনভাবে হবে এই সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিবদ্ধ শিক্ষা সংক্রান্ত সংস্থাগুলির উপর অর্পিত।
এনটিএ-র মতো বাইরের কোনও সংস্থা যদি সেই অধিকারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাহলে তা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারের উপর নগ্ন হস্তক্ষেপ। উপরন্তু, পঠন-পাঠনের বিষয়, শিক্ষণের গুণমান, শিক্ষার্থীদের মান– এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্ন ভিন্ন। এ সম্পর্কে যাঁদের সামান্যতম ধারণা আছে তাঁরা জানেন এগুলি রাজ্য ও স্থানীয় প্রয়োজনের দ্বারা নির্ধারিত হয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই শহর এবং শিল্পাঞ্চলের একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনের সঙ্গে মফঃস্বল বা জনজাতি অধ্যুষিত এলাকার প্রতিষ্ঠানের তারতম্য অনেক। ছাত্ররা যে অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে উঠে আসে তার মধ্যে যে বিস্তর ফারাক আছে তার কথা বাদই থাকল। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়-ভিত্তিক এই সমস্ত বৈচিত্র ও তারতম্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ এবং অনভিজ্ঞ এনটিএ-র মতো কোন প্রতিষ্ঠান যদি সবার জন্য একই প্রবেশিকা পরীক্ষা গ্রহণের দায়িত্ব নেয় তাহলে তার সীমাবদ্ধতা কতটা পর্বতপ্রমাণ হবে তা সহজেই অনুমেয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে এনটিএ চালু হলে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর, বিশেষ করে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের ছাত্ররা যাঁরা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তরে পড়া ও গবেষণা করার স্বপ্ন দেখছেন তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে কোনও একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে যে প্রবেশিকা পরীক্ষা হয় তার তুলনায় সর্বভারতীয় পরীক্ষা স্বাভাবিকভাবে অনেক প্রতিযোগিতামূলক হবে এবং তাতে ভালো ফল করা দুষ্কর হবে। উপরন্তু, এই তীব্র প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও যাঁরা মেধা তালিকায় নাম তুলতে পারবেন তাঁরা নিজেদের জেলায় বা রাজ্যের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে সুযোগ পাবেন তার কোন নিশ্চয়তা থাকবে না। কারণ মেধা তালিকা হবে দেশজুড়ে যত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে তাদের সবার জন্য। ফলে তাঁকে হয়ত ভর্তির জন্য এক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর এক জায়গায় বা অন্য রাজ্যে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে।
অন্যদিকে যিনি সে সুযোগ পাবেন না তিনি ভাববেন, যোগ্যতা নেই বলেই পারেননি, হয়ত বা ভাগ্যের দোহাই দিয়ে নিরস্ত হবেন। অন্যদিকে সরকারকেও ভর্তি করানোর দায়িত্ব নিতে হবে না। মেডিকেলে ভর্তির জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে যে ‘নিট’ পরীক্ষা চালু হয়েছে তার ফলে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ কীভাবে মূলত খুবই অল্প সংখ্যক বিত্তশালী পরিবারের সন্তান-সন্ততিদের হাতে গিয়ে জমা হয়েছে তা সকলেরই জানা। এবার সব বিষয়ে অভিন্ন পরীক্ষা চালু করে কি কেন্দ্রীয় সরকার এই পরিস্থিতি তৈরি করতে চায়?
আসলে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার উপর কঠোর প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের লক্ষ্য। এরই ফলে তাদের ‘এক জাতি, এক প্রবেশিকা পরীক্ষা’ চালু করা সহজ হবে। কেবল শিক্ষা কেন, জীবনের সব ক্ষেত্রে বহু ভাষা-ভাষী, বহু জাতি, বহু সংস্কৃতি বিশিষ্ট এই দেশে কোনও বৈচিত্র্য থাকুক তা বিজেপির না-পসন্দ। সবাইকে এক ছাঁচে তারা ঢালতে চাইছে। এটাই তাদের মূল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ তে তারা এই দৃষ্টিভঙ্গি এনেছে। এই নীতি রচিত হয়েছে আরএসএস ও সংঘ পরিবারের কর্তাব্যক্তিদের নির্দেশে, পরিকল্পনায় ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। দেশের শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-ছাত্রী অভিভাবক সহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কোনও অংশের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন তারাবোধ করেননি। এমনকী ‘শিক্ষা যুগ্ম তালিকাভুক্ত’ হওয়া সত্ত্বও রাজ্যগুলির কোনও মতামত নেওয়া হয়নি। গত ২৯ জুলাই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে এই নীতি ঘোষণা হয়েছে, সংসদে পেশ না করেই। দেশজুড়ে প্রথম সারির শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী সমেত সর্বস্তরের শিক্ষানুরাগী মানুষের সমস্ত প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক পথে ফ্যাসিস্ট কায়দায় তারা এই নীতি কার্যকর করতে চাইছেন। এর জন্য প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে গোটা কেন্দ্রীয় সরকার এবং সংঘ-পরিবারের সমস্ত শাখা-প্রশাখাকে ময়দানে নামানো হয়েছে। এটা করতে গিয়ে বিধিবদ্ধ স্বশাসিত সংস্থাগুলির স্বশাসনে নগ্নভাবে তারা হস্তক্ষেপ করছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে স্বাধিকারের ধারণা হল গণতন্ত্রের ধারণা, শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনায় সর্বজনস্বীকৃত গণতান্ত্রিক রীতি। তাকে তারা পদদলিত করে এমনকী ইউজিসি-র মতো ঐতিহ্যসম্পন্ন বিধিবদ্ধ স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানকে সরকার ও শাসকদলের দাসে পরিণত করে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ চালু করতে চলেছে। একে প্রতিরোধ করতে না পারলে শিক্ষাক্ষেত্রে নেমে আসবে আরও ঘোরতর দুর্দিন। আশার কথা, শিক্ষক-অধ্যাপকরা এর বিরুদ্ধে সুর চড়াচ্ছেন। প্রতিবাদে নেমেছে সেভ এডুকেশন কমিটিও।