মানবমুক্তির দর্শন হিসাবে মার্কসবাদকে জানতে ও বুঝতে দলের মধ্যে আদর্শগত চর্চার যে ধারাবাহিক প্রক্রিয়া চলছে তার সহায়ক হিসাবে আমরা কার্ল মার্কসের জীবন ও মার্কসবাদ সম্পর্কিত লেনিনের লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছি। এবার তৃতীয় কিস্তি।
(৩)
ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণা
পুরনো বস্তুবাদের অসঙ্গতি, অসম্পূর্ণতা ও একদেশদর্শিতা দেখে মার্কস নিশ্চিত ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, ‘বস্তুবাদের ভিত্তির সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা এবং সেই অনুসারে তাকে পুনর্গঠন করা প্রয়োজন’। বস্তুবাদ সব সময়ই চেতনাকে ব্যাখ্যা করে বাস্তব বস্তুসত্তার ফলাফল হিসাবে, এবং দেখায় এর বিপরীতটা সত্য নয়। তাই মানুষের সামাজিক জীবনে বস্তুবাদ প্রয়োগ করা হলে সামাজিক চেতনাকে সামাজিক বাস্তবের ফলাফল হিসাবেই ব্যাখ্যা করতে হবে। মার্কস লিখেছেন (পুঁজি, খণ্ড ১): ‘উৎপাদনের হাতিয়ার এবং তার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয় প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আদানপ্রদানের ধরন। উৎপাদনের প্রত্যক্ষ ক্রিয়ার সাহায্যে মানুষ তার জীবন বাঁচিয়ে রাখে। এর মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় সামাজিক সম্পর্কগুলি, তার থেকেই গড়ে ওঠে মানসিক ধারণার ধাঁচাটি। মানবসমাজ ও মানব ইতিহাসের ওপর প্রয়োগ করা বস্তুবাদের মূলনীতিগুলির পূর্ণাঙ্গ সূত্র মার্কস তাঁর ‘অর্থশাস্ত্রের সমালোচনায় অবদান প্রসঙ্গে’ রচনার ভূমিকায় এইভাবে দিয়েছেনঃ বেঁচে থাকার উপকরণগুলি সামাজিক ভাবে উৎপাদন করতে গিয়ে মানুষ এক অপরিহার্য এবং তার ইচ্ছা নিরপেক্ষ নির্দিষ্ট সম্পর্কে প্রবেশ করল– তা হল উৎপাদন সম্পর্ক। এই সম্পর্ক মানুষের বস্তুগত উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সেই নির্দিষ্ট স্তরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এই সব উৎপাদন-সম্পর্কগুলির সমষ্টি থেকেই গড়ে ওঠে সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো, যা হল বাস্তব ভিত্তি। এর উপর ভর করে একটি আইনি ও রাজনৈতিক উপরিকাঠামো গড়ে ওঠে এবং যা সমাজচেতনার একটি নির্দিষ্ট রূপের সঙ্গে খাপ খায়। জীবনধারণের বস্তুগত উপাদানগুলির উৎপাদনের পদ্ধতিটি সাধারণ ভাবে মানবজীবনের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিগত পদ্ধতিটিকে স্থির করে দেয়। মানুষের চেতনা তার অস্তিত্ব নির্ধারণ করে না, বরং বিপরীত ভাবে, মানুষের সামাজিক অস্তিত্বই তার চেতনা নির্ধারণ করে। বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে এসে, সমাজের বস্তুগত উৎপাদিকা শক্তিগুলির সংঘাত বাধে বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে। অথবা ওই একই কথা আইনের ভাষায় বলতে গেলে, যে সম্পত্তি-সম্পর্কের মধ্যে উৎপাদিকা শক্তিগুলি এতদিন ক্রিয়াশীল ছিল, সংঘাত বাধে তার সঙ্গে। উৎপাদিকা-শক্তির বিকাশের একটা রূপ থেকে এই সম্পর্ক পরিণত হয়ে যায় তার শৃঙ্খলে। তখনই শুরু হয়ে যায় সামাজিক বিপ্লবের যুগ। অর্থনৈতিক ভিত্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিপুলাকার উপরিকাঠামোর পুরোটাই কম-বেশি দ্রুত গতিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এই রূপান্তরগুলি বিচার করার সময় আমাদের সর্বদাই পার্থক্য করতে হবে– উৎপাদনের অর্থনৈতিক অবস্থার বস্তুগত পরিবর্তন– প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নির্ভুলতায় যা নির্ণয় করা যায় এবং আইনগত, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, নান্দনিক বা দার্শনিক, সংক্ষেপে মতাদর্শগত রূপগুলি, যার মধ্য দিয়ে মানুষ এই সংঘর্ষ সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তার নিষ্পত্তি ঘটায়– এই উভয়ের মধ্যে ।
একজন মানুষ নিজের সম্পর্কে যা ভাবে, তার ওপর ভিত্তি করে যেমন আমরা তার সম্পর্কে মতামত গড়ে তুলি না, তেমনই রূপান্তরের এমন একটি সময়কালকে তার নিজস্ব চেতনা দিয়ে আমরা বিচার করতে পারি না। বরং, এই চেতনার ব্যাখ্যা হওয়া উচিত বরং বস্তুগত জীবনের দ্বন্দ্বগুলি দিয়ে, সামাজিক উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে চলতে থাকা দ্বন্দ্ব দিয়ে। …’
‘মোটামুটিভাবে এশীয়, প্রাচীন, সামন্ততান্ত্রিক ও আধুনিক বুর্জোয়া উৎপাদনপদ্ধতিগুলিকে সমাজের অর্থনৈতিক নির্মাণের ধারাবাহিক পর্যায় হিসেবে ধরা চলে।’ (১৮৬৬ সালের ৭ জুলাই এঙ্গেলসের কাছে লেখা চিঠিতে মার্কসের সংক্ষিপ্ত বিবরণের সঙ্গে তুলনীয়ঃ ‘উৎপাদনের উপায়গুলির নিরিখেই সংগঠিত হয় শ্রম নিয়োগের ক্ষেত্রগুলি– এই আমাদের তত্ত্ব।’)
ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণার আবিষ্কার, কিংবা আরও সঠিক ভাবে বললে, সামাজিক ঘটনাবলির ক্ষেত্রে বস্তুবাদের সুসঙ্গত ধারাবাহিকতা ও প্রসার আগেকার ঐতিহাসিক তত্ত্বগুলির দুটি প্রধান ত্রুটি দূর করেছিল। প্রথমটি হল, খুব বেশি হলে এইসব তত্ত্ব মানুষের ঐতিহাসিক কার্যকলাপের পিছনে মতাদর্শগত প্রেরণাগুলি কী, তা অনুসন্ধান করেছে, এইসব প্রেরণার উৎস কী– তা অনুসন্ধান করেনি। সামাজিক সম্পর্কের ব্যবস্থাটির বিকাশ নিয়ন্ত্রণ করে যে বাস্তব নিয়মগুলি– তা নির্ধারণ করেনি। বস্তুগত উৎপাদনের মাধ্যমে বিকাশের মাত্রায় পৌঁছনো এই সম্পর্কগুলির উৎসের দিকে চোখ রাখেনি।
দ্বিতীয়ত, আগেকার তত্ত্বগুলি অধিকাংশ জনগণের কার্যকলাপকে বিচারের মধ্যে আনেনি। সেখানে, ঐতিহাসিক বস্তুবাদই প্রথম জনজীবনের সামাজিক অবস্থা ও তার পরিবর্তনগুলি বিজ্ঞানসম্মত নির্ভুলতার সঙ্গে চর্চা করছে। প্রাক-মার্কসবাদী ‘সমাজবিদ্যা’ ও ইতিহাস-রচনা বড় জোর সামনে এনেছিল যথেচ্ছভাবে সংগ্রহ করা কাঁচা তথ্যের রাশি এবং ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার আলাদা আলাদা দিকগুলি। মার্কসবাদ পরস্পরবিরোধী সমস্ত প্রবণতার সামগ্রিকতা বিচার করল, সেগুলিকে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির জীবনযাত্রা ও উৎপাদনের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যাযোগ্য অবস্থায় দাঁড় করালো। কোনও একটি ধারণা কেন বিশেষ ভাবে প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে তার বিচার করল এবং শেষ পর্যন্ত এ সত্য দেখাল যে কোনও ব্যতিক্রম ছাড়াই সকল ধারণা ও প্রবণতার উৎস হচ্ছে বস্তুগত বিষয়গুলির উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে। একটি সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশ ও বিনাশের সামগ্রিক প্রক্রিয়াকে কীভাবে বিচার করতে হয় তা মার্কসবাদ দেখিয়েছে। জনগণ নিজের ইতিহাস নিজেরাই সৃষ্টি করে। কিন্তু জনগণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কিসের দ্বারা নির্ধারিত হয়? অর্থাৎ, কিসের থেকে বিবাদমান ধ্যানধারণার সংঘর্ষের উদয় হয়? মানব সমাজের বিপুল অংশে এই সমস্ত সংঘাতের সামগ্রিক ফলটি কী? বস্তুগত জীবনের উৎপাদন, যা মানুষের সমস্ত ঐতিহাসিক কার্যকলাপের ভিত্তি গঠন করে, তার বাস্তব শর্তগুলি কী কী? এইসব শর্তের বিকাশের নিয়ম কী? এই সবগুলি বিষয়ের ওপর মার্কস মনোযোগ দেন এবং ইতিহাসের বিজ্ঞানসম্মত চর্চার পথনির্দেশ করেন, যা তার বিপুল বৈচিত্র্য ও পরস্পরবিরোধিতা সত্তে্বও একটি একক পদ্ধতি হিসাবে নির্দিষ্ট নিয়মের দ্বারা পরিচালিত হয়।
শ্রেণিসংগ্রাম
এ কথা সকলেরই জানা যে, একটা নির্দিষ্ট সমাজের একদল সদস্যের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে লড়াই বাধে অন্য আরেক দল সদস্যের লক্ষ্য উদ্দেশ্যের। সামাজিক জীবন সংঘর্ষে ভরা, ইতিহাসে দেখা যায় জাতিতে জাতিতে ও সমাজে সমাজে এবং জাতি ও সমাজগুলির নিজেদের ভিতরে সংগ্রাম। সেখানে পালা করে দেখা দেয় বিপ্লব ও প্রতিক্রিয়া, শান্তি ও যুদ্ধ, অচলাবস্থা ও দ্রুতবেগ প্রগতি অথবা অবক্ষয়ের পর্ব। এই আপাতদৃষ্ট গোলকধাঁধা ও বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মগুলি আবিষ্কার করার ক্ষেত্রে মার্কসবাদ দিল পথনির্দেশ– শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্ব। কোনও একটি সমাজ বা কয়েকটি সমাজ-গোষ্ঠীর সকল সদস্যের সমগ্র প্রচেষ্টা অধ্যয়ন করলেই তবে এই প্রচেষ্টাগুলির ফলাফলের বিজ্ঞানসম্মত সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব। এখন, এই পরস্পর সংঘর্ষরত প্রচেষ্টাগুলি উদ্ভূত হয়, প্রতিটি সমাজ যে সব শ্রেণিতে বিভক্ত, সেগুলির অবস্থান ও জীবনযাত্রার ধরনের পার্থক্য থেকে। কমিউনিস্ট ইশতেহার-এ মার্কস লিখেছেনঃ এখনও পর্যন্ত যতগুলি সমাজ এসেছে, তাদের সকলের ইতিহাস হল শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। (এঙ্গেলস পরে যোগ করেছেন, আদিম গোষ্ঠীগুলির ইতিহাস এর মধ্যে পড়ে না।) স্বাধীন মানুষ ও দাস, প্যাট্রিসিয়ান ও প্লিবিয়ান, জমিদার ও ভূমিদাস, গিল্ডকর্তা ও কারিগর, এক কথায় নিপীড়ক ও নিপীড়িত– সর্বদাই একে অপরের বিরোধী হিসাবে থেকেছে, কখনও গোপনে, কখনও প্রকাশ্যে অবিরাম লড়াই চালিয়ে গেছে। প্রত্যেক বারই এ লড়াই শেষ হয়েছে, হয় গোটা সমাজের বৈপ্লবিক পুনর্গঠনে, অথবা সংঘর্ষরত শ্রেণিগুলির সব ক’টিরই ধ্বংসে। … সামন্তী সমাজের ধ্বংসস্তূপ থেকে তৈরি হওয়া আধুনিক বুর্জোয়া সমাজে শ্রেণিবিরোধের অবসান ঘটেনি। এই ব্যবস্থা শুধু পুরনোগুলির জায়গায় পত্তন করেছে নতুন নতুন শ্রেণি, নিপীড়নের নতুন পরিস্থিতি, সংগ্রামের নতুন ধরনগুলিকে। আমাদের যুগ, এই বুর্জোয়া যুগের কিন্তু একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। সেটি হল, এই যুগ শ্রেণি-বিরোধকে এখন অনেক সরল করে দিয়েছে। সমাজ সামগ্রিক ভাবে আরও বেশি করে দুটি বৃহৎ শত্রুশিবিরে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে, সরাসরি একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা দুটি বৃহৎ শ্রেণি– পুঁজিপতি ও সর্বহারা শ্রেণিতে।” মহান ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে ইউরোপীয় ইতিহাস অনেকগুলি দেশে অতি পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছে যে, ঘটনাস্রোতের মূলে রয়েছে আসলে শ্রেণিগুলির ভিতরে সংগ্রাম। ফ্রান্সে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর্বে (১৭৯২ সালে ফরাসি বিপ্লবের ফলে সিংহাসনচ্যুত বুরবোঁ রাজবংশ ১৮১৪ সালে ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করে। এখানে ‘পুনঃপ্রতিষ্ঠা’ বলতে ১৮১৪-১৮৩০– এই সময়কালকে বোঝানো হয়েছে যখন ফ্রান্সের সিংহাসনে ছিল বুরবোঁ বংশ।) দেখা দিয়েছিলেন একাধিক ঐতিহাসিক (তিয়েরি, গিজো, মিনিয়ে, তিয়ের), যাঁরা তৎকালীন ঘটনাবলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতে গিয়ে স্বীকার না করে পারেননি যে, গোটা ফরাসি ইতিহাস বোঝার চাবিকাঠি হল শ্রেণিসংগ্রাম। আধুনিক যুগ হল পুঁজিপতি শ্রেণির সম্পূর্ণ বিজয়, প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থা, ব্যাপক (সর্বজনীন যদি না-ও হয়) ভোটাধিকার, জনগণের মধ্যে ব্যাপক ভাবে প্রচারিত সস্তা দৈনিক সংবাদপত্র ইত্যাদির যুগ। এই সময়কাল হল শক্তিশালী ও সর্বদা বাড়তে থাকা শ্রমিক ও কর্মচারীদের সংগঠন ইত্যাদিরও যুগ। – এসব আরও বেশি লক্ষণীয় ভাবে (যদিও কখনও কখনও ভীষণ একপেশে, ‘শান্তিপূর্ণ’ এবং ‘নিয়মতান্ত্রিক’ চেহারায়) দেখিয়েছে যে, ঘটনাবলির মূল চালিকাশক্তি হল শ্রেণিসংগ্রাম। মার্কস রচিত ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’-এর নিচে উদ্ধৃত অংশটি থেকে আমরা দেখতে পাবো, আধুনিক সমাজে প্রতিটি শ্রেণির অবস্থানের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে প্রতিটি শ্রেণির বিকাশের শর্তাবলি বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে মার্কস সমাজবিজ্ঞানের কাছে কী দাবি করেছিলেন ঃ ‘‘বর্তমানে যে সব শ্রেণি বুর্জোয়া শ্রেণির মোকাবিলা করছে, সেগুলির মধ্যে সর্বহারা শ্রেণিই হল একমাত্র প্রকৃত বিপ্লবী শ্রেণি। আধুনিক শিল্প-কলকারখানার সামনে পড়ে অন্য শ্রেণিগুলির ক্ষয় হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সেগুলি বিলুপ্ত হয়ে যায়। সর্বহারা শ্রেণি হল আধুনিক শিল্প-কলকারখানার বিশেষ এবং অপরিহার্য সৃষ্টি। মধ্যবিত্ত শ্রেণির অংশ হিসাবে নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি, ক্ষুদ্র উৎপাদক, দোকানদার, মিস্ত্রি, চাষি– এরা সবাই নিজেদের অস্তিত্বকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পুঁজিপতি শ্রেণির বিরুদ্ধে লড়াই করে। তাই তারা বিপ্লবী নয়, তারা রক্ষণশীল। শুধু তাই নয়, তারা প্রতিক্রিয়াশীল। কারণ ইতিহাসের চাকা তারা পিছন দিকে ঘোরাতে চায়। দৈবাৎ যদি তারা বিপ্লবী হয়, সেটাও তারা হয় নিজেদের আসন্ন সর্বহারা শ্রেণিভুক্তির কথা বিবেচনা করে। এই ভাবে তারা বর্তমান নয়, নিজেদের ভবিষ্যৎ স্বার্থ রক্ষা করে। সর্বহারা শ্রেণির দৃষ্টিকোণে নিজেদের স্থাপন করতে তারা নিজস্ব দৃষ্টিকোণ পরিত্যাগ করে।” একাধিক ঐতিহাসিক রচনায় মার্কস বস্তুবাদী ইতিহাসবিদ্যার চমৎকার ও সুগভীর নিদর্শন রেখে গেছেন, আলাদা আলাদা ভাবে প্রত্যেকটি শ্রেণির এবং কখনও কখনও শ্রেণির ভেতর বিভিন্ন গোষ্ঠী বা স্তরের অবস্থান বিশ্লেষণ করেছেন, এবং স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন কেন এবং কী ভাবে প্রতিটি শ্রেণিসংগ্রামই হল একটি রাজনৈতিক সংগ্রাম। ঐতিহাসিক বিকাশের পরিণতি নির্ধারণ করতে গিয়ে মার্কস, সামাজিক সম্পর্ক এবং এক শ্রেণি থেকে অন্য শ্রেণিতে, অতীত থেকে ভবিষ্যতে উত্তরণের অন্তর্বর্তী স্তরগুলির কী জটিল জাল বিশ্লেষণ করেছেন, উপরে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদটি তার একটি উদাহরণ।
মার্কসের তত্ত্বের সবচেয়ে সুগভীর, পূর্ণাঙ্গ এবং বিশদ প্রমাণ তথা প্রয়োগ হল তাঁর অর্থনৈতিক মতবাদ।
মার্কসের অর্থনৈতিক মতবাদ
‘পুঁজি’ বইয়ের ভূমিকায় মার্কস লিখেছেন ‘আধুনিক সমাজের’, অর্থাৎ পুঁজিবাদী, বুর্জোয়া সমাজের, ‘বিকাশের অর্থনৈতিক নিয়মটিকে প্রকাশ করে দেওয়াই আমার এ রচনার আসল লক্ষ্য।’ ঐতিহাসিকভাবে নির্দিষ্ট একটি বিশেষ সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যেকার সম্পর্কগুলির উদ্ভব, বিকাশ ও বিনাশের প্রক্রিয়ার অনুসন্ধানই মার্কসের অর্থনৈতিক মতবাদের বিষয়বস্তু। পুঁজিবাদী সমাজে পণ্যই উৎপাদনের কেন্দ্রবিন্দু। মার্কসের বিশ্লেষণও তাই শুরু হয়েছে পণ্যের বিশ্লেষণ দিয়ে।
মূল্য
পণ্য হল, প্রথমত, এমন একটি জিনিস যা দিয়ে মানুষের কোনও একটি চাহিদা মেটে। দ্বিতীয়ত, এ হল এমন একটা জিনিস যার সঙ্গে অন্য কোনও জিনিসের বিনিময় চলে। বস্তুর উপযোগিতা থেকে তার ব্যবহার-মূল্য তৈরি হয়। বিনিময় মূল্য (কিংবা সহজ ভাষায় মূল্য) সর্বাগ্রে হল একটি সম্পর্ক, নির্দিষ্ট পরিমাণের এক ধরনের ব্যবহার-মূল্যের সঙ্গে নির্দিষ্ট পরিমাণ অন্য ধরনের ব্যবহার-মূল্যের বিনিময়ের অনুপাত। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এই ধরনের কোটি কোটি বিনিময় প্রতিনিয়ত সমান সংখ্যক ব্যবহার মূল্যের মধ্যে, এমনকি একেবারে যাদের মিল নেই, একেবারে ভিন্ন জাতীয় ব্যবহার-মূল্যগুলি পরস্পরের মধ্যে সমতা রক্ষা করে যাচ্ছে। এখন, এই ধরনের বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে, সামাজিক সম্পর্কের একটা নির্দিষ্ট ব্যবস্থার ভেতর যেসব বস্তু প্রতিনিয়ত পরস্পর সমতা রক্ষা করে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে সাধারণ মিলটা কী? এদের মধ্যে সাধারণ মিল হল, এসবই শ্রমের ফসল। বস্তুর বিনিময় করতে গিয়ে মানুষ বহু ধরনের শ্রমের মধ্যে সমতা বিধান করে। পণ্য-উৎপাদন হল সামাজিক সম্পর্কের এমন একটা ব্যবস্থা যাতে ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদক ভিন্ন ভিন্ন বস্তু তৈরি করছে (সামাজিক শ্রমবিভাগের মধ্য দিয়ে), এবং বিনিময়ের সময় সেই সব বস্তুর পারস্পরিক সমতা রক্ষা করে যাচ্ছে। সুতরাং, সমস্ত পণ্যের মধ্যেই যে সাধারণ জিনিসটা রয়েছে সেটা উৎপাদনের কোনও শাখা বিশেষের প্রত্যক্ষ শ্রম নয়, নির্দিষ্ট একধরনের শ্রমও নয়, সেটা হল বিমূর্ত মনুষ্যশ্রম, সাধারণভাবে মনুষ্যশ্রম। কোনও নির্দিষ্ট সমাজের সমস্ত শ্রমশক্তি– যা সমস্ত পণ্যের মোট মূল্যে নিহিত থাকে, তা হল সেই একই মনুষ্য শ্রমশক্তি– কোটি কোটি বিনিময়ের ঘটনায় তার প্রমাণ মিলবে। সুতরাং, একটা নির্দিষ্ট পণ্যের দ্বারা সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমসময়ের একটা নির্দিষ্ট অংশকেই বোঝায় মাত্র। মূল্যের পরিমাণ নির্ধারিত হয় সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমের পরিমাণ দিয়ে, অর্থাৎ নির্দিষ্ট পণ্যটির নির্দিষ্ট ব্যবহার-মূল্যটি উৎপাদনে যেটুকু শ্রমসময় সামাজিকভাবে আবশ্যক, সেই শ্রমসময় দিয়ে। ‘‘বিনিময় মারফত আমরা যখনই আমাদের ভিন্ন ভিন্ন উৎপন্ন দ্রব্যের সঙ্গে মূল্যের সমানীকরণ করি, তখনই আমরা মনুষ্যশ্রম, যা সেগুলির মধ্যে নিহিত থাকে, তারও সমানীকরণ করি। এ সম্পর্কে আমরা সচেতন নই বটে, কিন্তু করি এইটেই” (পুঁজি, ১ম খণ্ড)। অতীতের একজন অর্থনীতিবিদের কথা অনুসারে, মূল্য হল দুই ব্যক্তির মধ্যে একটা সম্পর্ক। ভাল হত যদি তিনি এর সাথে শুধু যোগ করতেন, সামগ্রীর মোড়কে ঢাকা সম্পর্ক। মূল্য কী, তা বোঝা যায় শুধু একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ধরনের সমাজে উৎপাদনকে সামাজিক সম্পর্কের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে। যেখানে এই উৎপাদন-সম্পর্কগুলি আবার আত্মপ্রকাশ করছে কোটি কোটি বার পুনরাবর্তিত ব্যাপক বিনিময় ঘটনার মধ্যে। ‘‘মূল্য হিসেবে দেখলে সমস্ত পণ্যই হল কেবল নির্দিষ্ট পরিমাণের একটা ‘ঘনীভূত শ্রমসময়”’ (কার্ল মার্কস, এ কনট্রিবিউশন টু দি ক্রিটিক অফ পলিটিক্যাল ইকনমি)। পণ্যে রূপায়িত শ্রমের দুই ধরনের চরিত্রের সবিস্তার বিশ্লেষণের পর মার্কস মূল্য ও মুদ্রার রূপ বিশ্লেষণ করেছেন। এ গবেষণায় তাঁর প্রধান কাজ মূল্য থেকে টাকাপয়সার উদ্ভব পর্যালোচনা, বিনিময় ব্যবস্থার বিকাশের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার পর্যালোচনা, বিনিময়ের ব্যক্তিগত এবং ঘটনাক্রমিক শুরুর প্রক্রিয়া, (‘মূল্যের প্রাথমিক, ঘটনাক্রমিক রূপ,’ যেখানে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ কোনও পণ্যের বিনিময় হচ্ছে আর একটি পণ্যের নির্দিষ্ট পরিমাণের সঙ্গে) যা পৌঁছচ্ছে মূল্যের সর্বজনীন রূপে, যখন নির্দিষ্ট সংখ্যক নানা জাতীয় পণ্যকে বিনিময় করা হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট পণ্যের সঙ্গে এবং যা মূল্যের মুদ্রারূপে গিয়ে শেষ হচ্ছে– সোনা হল সেই নির্দিষ্ট পণ্য, যা সর্বজনীন তুল্যমূল্য। বিনিময় ও পণ্য-উৎপাদনের বিকাশে উচ্চতম পরিণতি হিসেবে মুদ্রা সমস্ত ব্যক্তিগত শ্রমের সামাজিক চরিত্র ও বাজারের মারফত সংযুক্ত ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদকের সামাজিক সম্পর্ককে ঢেকে দেয় এবং আড়াল করে। মুদ্রা কী কী ভূমিকা পালন করে, সে বিষয়ে সবিস্তারে মার্কস বিশ্লেষণ করেছেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা বিশেষ জরুরি যে, এখানেও (‘পুঁজি’ গ্রন্থের প্রথমদিককার পরিচ্ছেদগুলির মতো) বিমূর্ত এবং আপাতদৃষ্টিতে মাঝে মাঝে নিছক অবরোহমূলক (ডিডাকটিভ) উপস্থাপন আসলে বিনিময় ও পণ্য-উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিকাশের ইতিহাস থেকে সংগৃহীত বিপুল পরিমাণ তথ্যের উপর নির্ভর করেই রচিত। যদি আমরা মুদ্রার বিষয়টি বিচার করি, তবে এটির অস্তিত্ব পণ্য বিনিময় ব্যবস্থার একটি নির্দিষ্ট স্তরকেই নির্দেশ করে। মুদ্রা নির্দিষ্ট করে যে যে ভূমিকাগুলি পালন করে, যেমন, শুধুমাত্র পণ্যের সমমূল্য হিসাবে, বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে, সঞ্চয় অথবা বিশ্বজনীন মুদ্রা হিসাবে– এর কোনটার কখন প্রাধান্য ঘটছে, তা সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার ভিন্ন ভিন্ন স্তরকেই নির্দেশ করে (‘পুঁজি’, খণ্ড ১)। (চলবে)