‘‘ভারতবর্ষের কেবল হিন্দুচিত্তকে স্বীকার করলে চলবে না। ভারতবর্ষের সাহিত্য, শিল্পকলা, স্থাপত্য, বিজ্ঞান প্রভৃতি হিন্দু মুসলমানের সংমিশ্রণে বিচিত্র সৃষ্টি জেগে উঠেছে। তারই পরিচয় ভারতবর্ষীয়দের পূর্ণপরিচয়।” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী)।
হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রবক্তা স্বামী বিবেকানন্দের প্রিয় শিষ্যা নিবেদিতা লিখেছেন, ‘‘মোগলগণের গরিমা স্বামীজি শতমুখে বর্ণনা করিতেন।… আগ্রার সন্নিকটে সেকেন্দ্রার সেই গম্বুজবিহীন অনাচ্ছাদিত সমাধির পাশে বসিয়া আকবরের কথা বলিতে বলিতে স্বামীজির কণ্ঠ যেন অশ্রু গদগদ হইয়া আসিত।” নিবেদিতা আরও লিখেছেন, শাহজাহান যেহেতু মুসলমান, সে জন্য এক শিষ্য তাঁকে বিদেশি বলায় বিবেকানন্দ তীব্র ভৎর্সনা করেছিলেন। বিবেকানন্দ এমনকী একথাও বলেছেন– ‘‘এটা খুবই স্বাভাবিক যে একই সময়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে এবং নির্বিরোধে আমার ছেলে বৌদ্ধ, আমার স্ত্রী খ্রিস্টান ও আমি নিজে মুসলমান হতে পারি”। (‘স্বামীজিকে যেমন দেখেছি’– ভগিনী নিবেদিতা)
আজকের ভারতে এসে দাঁড়ালে কী বলতেন বিশ্বকবি? কী বলতেন বিবেকানন্দ? যখন দেখতেন আজ ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের মসনদে আসীন দলের ঘনিষ্ঠ হিন্দুত্ববাদের ধ্বজাধারীরা ‘হিন্দুধর্ম’ রক্ষার অজুহাতে ভারতের সংখ্যালঘু মানুষের উপর গণহত্যা চালানোর ডাক দিচ্ছেন! অথচ কেন্দ্রীয় কিংবা রাজ্য সরকারের মন্ত্রী-নেতা থেকে শুরু করে পুলিশ পর্যন্ত ঠুঁটো হয়ে দেখছে! এরাই নাকি হিন্দু ধর্মের তথা দেশের ত্রাতা? কোনও ধর্ম বিশ্বাসী সাধারণ মানুষ কি এ জিনিস মানতে পারেন? কোনও সভ্য দেশের সরকার এই হত্যার কারবারিদের মুক্ত অবস্থায় সমাজে ঘুরে বেড়াতে দিতে পারে?
উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বারে ধর্ম-সংসদের নামে এমনই ডাক দিয়েছেন স্বঘোষিত কিছু ধর্মগুরু। তাঁরা বলেছেন, তাঁদের প্রেরণায় ট্রেনিং নিয়ে ১০০ জন সেনা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করার জন্য তৈরি। বলেছেন, ভারতের আদর্শ নাথুরাম গডসে। এমনকি এক তথাকথিত সাধু মহারাজ বলে দিয়েছেন, সংখ্যালঘুদেরও দেশের সম্পদে অধিকার আছে– এ কথা বলার অপরাধে তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বুকে ৬টি বুলেট ভরে দিতে চান। আর এক মহারাজ বলেছেন, প্রভাকরণ কিংবা ভিন্দ্রানওয়ালের মতো সন্ত্রাসবাদী চাই, নির্বিচারে হত্যা করতে যাদের হাত কাঁপবে না। শুধু হরিদ্বারে নয়, ১৯ ডিসেম্বর খোদ দিল্লিতে ভারতকে ‘হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর ডাক দিয়ে ‘লড়ো এবং মারো’ এই স্লোগান তোলা হয়েছে। এক হিন্দি চ্যানেলের সম্পাদক উপস্থিত থেকে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর কায়দায় যুবকদের এই হত্যার শপথ গ্রহণ করিয়েছেন। ১৭ থেকে ১৯ ডিসেম্বর তিনদিন ধরে এই সমস্ত অমৃতবাণী বর্ষিত হলেও উত্তরাখণ্ডের বিজেপি সরকারের পুলিশ কিংবা সরাসরি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পরিচালনাধীন দিল্লি পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেওয়ারই প্রয়োজন বোধ করেনি। দেশের এবং বিদেশেরও লক্ষ লক্ষ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির কাছে চিঠি লিখে ব্যবস্থা দাবি করেছেন। অথচ মাত্র দুজনের বিরুদ্ধে এফআইআর ছাড়া পুলিশ কিছুই করেনি। এমনকি মূল উদ্যোক্তার বিরুদ্ধেও অভিযোগটুকুও করেনি। হরিদ্বারের পুলিশ জানিয়ে দিয়েছে, তারা কোনও ব্যবস্থা নেবে না।
যদিও তথাকথিত হিন্দুত্বের রক্ষকরা বসে থাকেনি। ইতিমধ্যেই ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বিজেপি শাসিত হরিয়ানার গুরুগ্রামের পতৌদিতে এক গির্জায় প্রার্থনারত মানুষদের উপর হামলা চালিয়েছে বিজেপির মদতপুষ্ট বাহিনী। বিজেপিরই শাসনে থাকা কর্ণাটকে একাধিক গির্জায় হামলা হয়েছে। একইভাবে হামলা হয়েছে বিজেপি শাসিত আসামে শিলচরের গির্জায়। হরিদ্বারের ঘটনার অন্যতম আয়োজক স্বঘোষিত ধর্মগুরু নরসিংহানন্দ আগামী জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই উত্তরপ্রদেশে একই ধরনের ধর্মসংসদ ডাকার কথা ঘোষণা করেছেন। উদ্দেশ্য সে রাজ্যের আসন্ন ভোটে বিজেপির পক্ষে ভোটব্যাঙ্কের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করা। স্মরণ করা দরকার ২০২০-র ১২-১৩ জানুয়ারি এই নরসিংহানন্দই দিল্লি বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে সেখানে ধর্মসংসদের আয়োজন করে উস্কানিমূলক বত্তৃতা দিয়েছিলেন। তার দেড়মাসের মধ্যে ঘটে দিল্লি গণহত্যা। একই কায়দায় গণহত্যা শুরুর ঠিক আগে বিজেপি নেতারা এমনকি একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ‘গোলি মারা’-র, সংখ্যালঘুদের নিধনের দাওয়াই বাতলেছিলেন। তার বিষময় ফল কী হয়েছিল আজ সকলের জানা। কয়েকশত মানুষের জীবন গেছে, শত শত পরিবার তাদের শেষ কপর্দকটুকু হারিয়ে পথের ভিখারিতে পরিণত হয়েছে। এতবড় অপরাধের জন্য এদের কারও কোনও শাস্তি হয়নি। বরং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অধীনে থাকা দিল্লি পুলিশ মামলা দায়ের করেছে নিরপরাধদের বিরুদ্ধেই।
অবশ্য আজকের ভারতে এটাই হওয়ার কথা। খোদ প্রধানমন্ত্রী যেখানে উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যে আসন্ন বিধানসভা ভোটের কথা ভেবে পরিবেশন করে চলেছেন উগ্র হিন্দুত্ববাদী জিগির। তিনি এবং তাঁর যোগ্য দোসর মুখ্যমন্ত্রী এখন যে কোনও ভাবে টেনে আনছেন আফগানিস্তানের তালিবানের কথা। আর শোনাচ্ছেন মুঘল শাসকদের সম্বন্ধে বিকৃত ইতিহাসের গল্প। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিলান্যাস করতে গিয়ে শোনাচ্ছেন রাম মন্দিরের কথা। নিজেদের কোন কীর্তিটি ফলাও করে বলবেন তাঁরা? অনেক বছর চলেছে রাম মন্দিরের জিগির তুলে। এখন বুঝছেন এটা আর আগের মতো কাজ করছে না। এদিকে সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি, পেট্রল ডিজেল-কেরোসিন-গ্যাসের আকাশছোঁয়া দাম মানুষকে খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ভয়াবহ বেকারি, ছাঁটাই, স্থায়ী চাকরির আকাল, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, নারী নির্যাতন-ধর্ষণ-খুনের ভয়াবহ বৃদ্ধি। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ফেটে পড়ছে। করোনা মহামারি প্রতিরোধে কেন্দ্র এবং উত্তরপ্রদেশে বিজেপি সরকারের চরম অপদার্থতায় শত শত মানুষের মৃতদেহ গঙ্গায় ভেসেছে। আরও বহু মানুষের দেহ পুঁতে দিতে হয়েছে হয়েছে নদীর চরে।
বিজেপির আরও আশঙ্কার কারণ, কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের বিরুদ্ধে উত্তর ভারতের রাজ্যে রাজ্যে কৃষক আন্দোলনে মানুষের ঢল নামা। আন্দোলনের তীব্রতার সামনে একচেটিয়া পুঁজির মালিক-প্রভুদের গোঁসা সত্ত্বেও সরকারকে আপাতত কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে হয়েছে। দেশ জোড়া প্রতিবাদের মুখে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ বিল, বিদ্যুৎক্ষেত্রকে পুরোপুরি বেসরকারি হাতে বেচে দেওয়ার বিল ইত্যাদি আপাতত সংসদে আনারই সাহস করেনি সরকার। তাই উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড সহ বিভিন্ন রাজ্যে আসন্ন ভোটে বিজেপির একমাত্র হাতিয়ার ‘হিন্দু-বিপন্ন’ এই ভুয়ো সাম্প্রদায়িক জিগির তুলে ভোট পাওয়ার চেষ্টা করা। তার জন্য যদি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে নরহত্যা করতে হয়, অসংখ্য মানুষের সর্বনাশ করতে হয় তাতেও তাদের আপত্তি নেই।
বিজেপি হিন্দুরাজের ধ্বনি তুলছে। একই সাথে আবার প্রধানমন্ত্রী আজাদ হিন্দ বাহিনীর পতাকা তুলে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে স্মরণের ভড়ং করছেন। অথচ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বলেছেন, ‘‘… হিন্দুরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে ‘হিন্দুরাজের’ ধ্বনি শোনা যায়। এগুলি সর্বৈব অলস চিন্তা। …শ্রমসিক্ত জনসাধারণ যে সব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন, সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি তার কোনওটির সমাধান করিতে পারিবে কি? কী ভাবে বেকারত্ব, নিরক্ষরতা, দারিদ্র্য, প্রভৃতি সমস্যার সমাধান হইবে সে সম্বন্ধে তাহারা কোনও পথ নির্দেশ করিয়াছে কি?”(১৪ জুন ১৯৩৮, কুমিল্লায় ভাষণ) এই মহান বিপ্লবী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘‘…আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের শত্রু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং যারা সেই সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন করে তারা আমাদের শত্রু এবং ভারতের জাতীয়তার শত্রু। আজকে হিন্দু মহাসভা মোসলেম বিদ্বেষের দ্বারা প্রণোদিত হয়ে অবলীলাক্রমে ইংরাজের সাথে মিলতে পারে, মুসলমানকে জব্দ করতে যেনতেন প্রকারেণ। …মনে রাখতে হবে আমাদের শত্রু হল বিদেশি সাম্রাজ্যবাদ এবং যে সমস্ত ভারতবাসী এবং ভারতীয় প্রতিষ্ঠান তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করে তারাও।” (১৫ মে ১৯৪০, ২৪ পরগণার যুব সমাবেশে ভাষণ, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ এই সময় পত্রিকা থেকে গৃহীত)। নেতাজিকে হাতে পেলে তাঁর বুকেও বুলেট ভরে দেওয়ার কথা নিশ্চয়ই আরএসএস-বিজেপির মদতপুষ্ট গুরুরা বলত!
পুঁজিবাদী বাজারের তীব্র সংকটকে সামাল দিতে পুঁজিপতি শ্রেণি চাইছে তার শোষণের মাত্রাকে চরম সীমায় নিয়ে যেতে। এর বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে যে তীব্র বিক্ষোভের জন্ম হচ্ছে তা তাদের মাথাব্যথার কারণ। এই বিক্ষোভ সঠিক পথ, সঠিক রাজনীতি পেলে সমাজবদলের বিপ্লবের পথে চলে যাবে। সেই আশঙ্কায় শাসক শ্রেণি চায় মানুষকে বিপথগামী করতে, দাঙ্গা হানাহানির মধ্যে তাদের ফাঁসিয়ে দিয়ে মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে। পুঁজিপতিরা যাতে অবাধে লুঠ চালাতে পারে তার ব্যবস্থা করে দিতে। সেজন্য তারা চায় ফ্যাসিবাদ কায়েম করে মানুষ গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটাকেই মেরে দিতে। সাম্প্রদায়িকতা এই কাজে তাদের বড় হাতিয়ার। বিজেপি একচেটিয়া মালিকদের সেবাদাস হিসাবে সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। তাদের সুবিধা করে দিয়েছে কংগ্রেস সহ অন্যান্য বুর্জোয়া রাজনীতির কারবারিদের একই ধরনের নরম কিংবা গরম সাম্প্রদায়িকতা ও জাতপাতের রাজনীতি।
এই সর্বনাশা রাজনীতির বিরুদ্ধে একমাত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার উপায় খেটে খাওয়া মানুষের ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন। যে পথ দেখিয়েছে সদ্য বিজয়ী কৃষক আন্দোলন। এই পথেই মোকাবিলা করতে হবে বিজেপি সহ সমস্ত ফ্যাসিবাদী রাজনীতির।