Breaking News

অনলাইন শিক্ষা শিক্ষা গৌণ, মুখ্য মুনাফাই

 

জনজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে মতো শিক্ষাক্ষেত্রেও গুরুতর আঘাত হেনেছে করোনা অতিমারি। প্রায় দেড় বছর পর স্কুল-কলেজ খুলেছে। অভিজ্ঞতা বলছে, ইতিমধ্যে স্কুল ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে। বহু শিশুরই পড়ার এবং লেখার অভ্যাস হারিয়ে গেছে। স্কুলছুট হয়ে গেছে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে।

এই সময়টাতে যে অনলাইন শিক্ষাকে পদ্ধতিগত শিক্ষার বিকল্প হিসাবে তুলে ধরার জন্য কেন্দ্রের বিজেপি সরকার উঠেপড়ে লেগেছিল, তার ফলাফল কী হয়েছে? একটি সর্বভারতীয় সমীক্ষা দেখিয়েছে, শহরে অনলাইন ক্লাস নিয়মিত করতে পেরেছে ২৪ শতাংশ ছাত্র আর গ্রামে এই সংখ্যা হল মাত্র ৮ শতাংশ। শহরে ১৯ শতাংশ ও গ্রামে ৩৭ শতাংশ ছাত্র স্থায়ীভাবে পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

ক্লাসরুম ভিত্তিক শিক্ষা চালুর দাবিতে এআইডিএসও রাজ্য জুড়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। আন্দোলন ভাঙতে রাজ্য সরকার আন্দোলনকারীদের উপর বর্বরোচিত পুলিশি নির্যাতন নামিয়ে এনেছিল শুধু কেন্দ্রীয়় সরকার নয়, এ রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারও শিক্ষাব্যবস্থাটিকে অনলাইন নির্ভর করতে উদ্যোগী। অথচ এর জন্য শিক্ষকদের কোনও প্রশিক্ষণ, ছাত্র এবং শিক্ষকের কাছে বিনামূল্যে অবিচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক সরবরাহ ইত্যাদি পরিকাঠামোগত কোনও ব্যবস্থা কোনও সরকারই করেনি। ফলে ইন্টারনেটের টাকা জোগাড় করতে না পারা, দীর্ঘক্ষণ ক্লাসে শিক্ষকদের অনুপস্থিতি, বারেবারে ডিভাইসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, অনলাইন কন্টেন্ট তৈরি করতে না পারা প্রভৃতি সমস্যাগুলি সামনে এসেছে। ছাত্রদের ক্ষেত্রে গ্রামীণ এলাকায় নেটওয়ার্কের সমস্যা, ছাত্রদের হাতে স্মার্টফোনের মতো কোনও ডিজিটাল যন্ত্র না থাকা, ঘরে ক্লাসের পরিবেশ না থাকায় মনোযোগ দিতে না পারা বা অন্য কাজে যুক্ত থাকা, পরীক্ষার উত্তরপত্র ও হোমওয়ার্ক ঠিকমতো জমা দিতে না পারা প্রভৃতি সমস্যাগুলি লক্ষ করা যাচ্ছে। পরিণতিতে শিক্ষকরা যেমন তাদের রুটিন ক্লাস করাতে পারেননি, তেমনি ছাত্ররাও ক্রমাগত পঠন-পাঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এ দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই অনলাইন শিক্ষার জন্য অবশ্যপ্রয়োজনীয় স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, হাইস্পিড ইন্টারনেট কানেকশন নেই। ক্লাস করার মতো নির্জন ঘরও বেশিরভাগ পরিবারের নেই তা জানা সত্তে্বও সরকার অনলাইন ক্লাসের উপর নির্ভর করেছিল। এতেই স্পষ্ট যে, সরকার সমাজের সব স্তরের ছাত্রছাত্রীদের কাছে শিক্ষার সুযোগ পৌঁছে দেওয়া নিয়ে আদৌ চিন্তিত নয়। সমীক্ষাতে দেখা যাচ্ছে, যতটুকু অনলাইন শিক্ষা চালু হয়েছে, তার সুযোগ নিতে পেরেছে শুধু আর্থিকভাবে সচ্ছল ছাত্ররা। আর অসচ্ছলরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়েছে যা আমাদের দেশ তথা শিক্ষাক্ষেত্রে থাকা বৈষম্যকে আরও প্রকট করেছে। ‘ডিজিটাল ডিসক্রিমিনেশন’ শব্দটি এখন ভালো মতোই চালু হয়ে গেছে।

দু’বছরের করোনা অতিমারি ও লকডাউনের সময়ে অস্বাভাবিক দ্রুততায় কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ নিয়ে এসেছে। এ জন্য সাধারণ মানুষ, শিক্ষাবিদ, অভিভাবক, শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠনগুলির মতামত সরকার শোনেইনি। কেবল বিজেপির তাঁবেদার শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠনের মতামত নিয়ে এবং আরএসএস-এর নির্দেশিকা ও দাবি মেনে, সংসদে তর্ক-বিতর্কের কোনও সুযোগ না দিয়ে তারা এই নীতি দেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। এই নীতিতে অন্যান্য বিষয়ের সাথে অত্যন্ত জোর দিয়ে ‘অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা’র কথা বলা হয়েছে যা লকডাউনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ থাকার সুযোগে দ্রুত কার্যকর করতে সরকার সক্রিয়। বাস্তবে অতিমারির প্রকোপ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই অনলাইন শিক্ষা চালু করা সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল। অতিমারি ও লকডাউন এ কাজে তাদের সুবিধা করে দিয়েছে।

সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অন্যান্য পরিষেবা ক্ষেত্রগুলির মতোই শিক্ষাও একটি ব্যবসায়িক পণ্য, যার একমাত্র লক্ষ্য মুনাফা লুঠ। ফলে, নূ্যনতম পরিকাঠামো, কম শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ প্রভৃতির মাধ্যমে কম বিনিয়োগে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনে পুঁজিপতিদের সুযোগ করে দেওয়াই জাতীয় শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য। অনলাইন শিক্ষা চালু করে ল্যাপটপ, স্মার্টফোন বিক্রি সহ ইন্টারনেট কানেকশন, বিভিন্ন অ্যাপ বিক্রি প্রভৃতির মধ্য দিয়ে একদল শিল্পমালিককে বিপুল মুনাফা অর্জনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এদেরই কয়েকজন লকডাউনের মধ্যেই শত-কোটিপতির তালিকায় নাম তুলে ফেলেছেন।

অনলাইন ক্লাস ছাড়াও টেলিভিশন, রেডিও ও ফোনে ক্লাস চালু করা হয়েছিল। এ সবে যে শিক্ষার প্রহসনই শুধু হয়, সেটা অভিভাবকরা অভিজ্ঞতায় বুঝেছেন। ফলে পরিবারের শত অভাবের মধ্যেও গ্রাম-শহরে ছাত্রছাত্রীদের টিউশন নিতে ছুটতে হয়েছে। খরচের নতুন বোঝা চেপেছে অভিভাবকদের কাঁধে। তাছাড়া, দীর্ঘ অতিমারিতে কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন, পরিবারগুলির আয় প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা খেয়েছে। এই অবস্থায় যখন মানুষ দু’বেলা দু’মুঠো অন্নসংস্থান করতেই হিমসিম খাচ্ছে, তখন তাদের পক্ষে স্মার্টফোন, হাইস্পিড ইন্টারনেট প্রভৃতির ব্যবস্থা করাটা কতখানি অসম্ভব, তা কি সরকারগুলি জানে না! সমীক্ষা দেখাচ্ছে, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিন চতুর্থাংশ গ্রামীণ এলাকায় অবস্থিত। এই বিদ্যালয়গুলির ছাত্ররা প্রায় পুরোপুরি শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

অনলাইন শিক্ষায় আরেকটি সমস্যাও উঠে এসেছে। দেখা যাচ্ছে, কারিগরি শিক্ষার মতো ল্যাবরেটরি, ওয়ার্কশপ, প্রজেক্ট ও প্র্যাকটিক্যাল নির্ভর বিষয়গুলির পঠন-পাঠন কোনও মতেই অনলাইনে সম্ভব নয়। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষা অনলাইনে পরিচালিত হওয়ায় ল্যাবরেটরি বা ওয়ার্কশপের সাথে যে আপস করা হচ্ছে, তা ডেকে আনছে ওই ক্ষেত্রগুলিতে শিক্ষার নিম্ন মান। অনলাইন কারিগরি শিক্ষার বেহাল চিত্র আজ বিশ্ব জুড়েই।

আরও একটি আশঙ্কা সামনে এসেছে। তা হল, অনলাইন শিক্ষায় এত গুরুত্ব দিলে ভবিষ্যতে শিক্ষক নিয়োগ গুরুত্বহীন হয়ে যাবে না তো!

অনলাইন শিক্ষা যে প্রথাগত ক্লাসরুম শিক্ষার বিকল্প হতে পারে না, সেই বিষয়টিও সামনে এসেছে। এই পদ্ধতিতে ছাত্রদের সামগ্রিক বিকাশ ও পড়াশোনার অভ্যাস যে ব্যাহত হচ্ছে, তা কয়েকটি গবেষণায় ও সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমতে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইনে সরাসরি পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা না থাকায় ক্লাসরুম শিক্ষার যে গভীরতা ও কার্যকারিতা থাকে তা এখানে অনুপস্থিত। সরাসরি ছাত্রদের সংস্পর্শে না আসার ফলে শিক্ষক বুঝতেই পারছেন না একজন ছাত্র কী বুঝছে বা আদৌ সে বুঝতে পারছে কি না। ক্লাসরুম শিক্ষার যৌথ পরিবেশ, সহপাঠীদের সাথে সম্পর্ক ও আবেগ, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, মতবিনিময়, একত্রে খেলাধূলা করা, কমন রুম, সেমিনার হল প্রভৃতি যে বিষয়গুলি একজন ছাত্র পায় এবং যা তার সার্বিক বৌদ্ধিক ও মানসিক বিকাশে এবং সামাজিক মনন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা অনলাইনে আদৌ সম্ভব নয়। কিছুদিন আগে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এক পর্যবেক্ষণে জানিয়েছেন যে, অনলাইন শিক্ষা দেশের মধ্যে সুবিধাভোগী ও সুবিধাবঞ্চিত– এই দুই ভাগে ছাত্রসমাজকে ভাগ করে দিয়েছে। তিনি সকলের হাতে মোবাইল ও ট্যাব তুলে দেওয়ার ও প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর বন্দোবস্ত করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আমাদের দেশে কোনও সরকারই যে এই নির্দেশ কার্যকর করবে না, তা এতদিনের অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট। যুক্তির খাতিরে যদি ধরে নেওয়াও হয়, সরকার মোবাইল ও ট্যাব ছাত্রদের দেবে তা হলেও যে অনলাইন শিক্ষা ক্লাসরুম শিক্ষার বিকল্প হতে পারে না, শুধুমাত্র কিছুটা সহায়তা করতে পারে, তা পূর্বেই প্রমাণিত। ফলে এটা স্পষ্ট, এসব কিছু সত্তে্বও যে সরকারগুলি অনলাইন শিক্ষায় এত গুরুত্ব দিচ্ছে, তার কারণ যে পুঁজিপতিদের সমর্থন এবং আর্থিক সহায়তায় তারা সরকারে বসেছে, অনলাইন সামগ্রীর ব্যবসায় তাদের মুনাফার ব্যবস্থা করে দেওয়া। শিক্ষার মান যতই নামুক, শিক্ষা বেচে কর্পোরেট কোম্পানির মুনাফার বন্দোবস্ত করা। জনশিক্ষার লক্ষ্য সেখানে গৌণ।

ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক সহ সকল মানুষের ঐক্যবদ্ধ সোচ্চার দাবিই পারে অবিলম্বে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিয়ে শিক্ষার স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে চালু করতে।