মিলিটারির বন্দুকের মুখে দাঁড়িয়ে লড়ছেন সুদানের সাধারণ মানুষ। গত ২৫ অক্টোবর সেনাবাহিনির এক কর্তা জেনারেল আবদেল ফাতাহ আল-বুরহান কর্তৃক ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে সেদেশের মানুষ পথে নেমে দিনের পর দিন বিক্ষোভ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, সোনা সহ মূল্যবান নানা প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ উত্তর আফ্রিকার দেশ সুদান। লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত এই দেশের অবস্থানটিও ভূ-রাজনৈতিক ভাবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ফলে সাম্রাজ্যবাদী নানা দেশ, বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের লোলুপ দৃষ্টি বহুদিন থেকেই রয়েছে সুদানের ওপর। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি ছিল জেনারেল ওমর আল বশিরের স্বৈরাচারী শাসনের অধীন। আর্থিক অভাব-অনটন, ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি, প্রশাসনিক দুর্নীতি ইত্যাদি কারণে এক সময় প্রেসিডেন্ট বশিরের বিরুদ্ধে জনরোষ ফুঁসে ওঠে।
২০১৮-র ডিসেম্বরে সুদানের শ্রমিক, চাষি, ছোট ব্যবসায়ী এবং দেশের রাজনৈতিক দলগুলি ও বেশ কিছু শ্রমিক সংগঠন ব্যাপক ভাবে পথে নামে বশির-সরকারের বিরুদ্ধে। সুদানের কমিউনিস্ট পার্টি (এসসিপি) এবং সেখানকার শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মী, সরকারি কর্মচারীদের সংগঠন এসপিএ-র ডাকে গোটা দেশের সাধারণ মানুষ স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দেয়। সামরিক বাহিনির একটি গোষ্ঠীও যোগ দেয় তাদের সঙ্গে। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এই আন্দোলনে যদিও হাজার হাজার জনতা যুক্ত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও ব্যবসায়ীদের জোট সামরিক বাহিনির ওই গোষ্ঠীটির সঙ্গে একযোগে নেতৃত্বে চলে আসে। তৈরি হয় একটি সার্বভৌম কাউন্সিল। ২০১৯-এর গ্রেপ্তার হন প্রেসিডেন্ট বশির এবং অন্তর্বর্তী সরকার হিসাবে শাসন ক্ষমতায় বসে ওই সার্বভৌম কাউন্সিল। সামরিক গোষ্ঠীর উপস্থিতির কারণে এসসিপি, এসপিএ এবং বেশিরভাগ শ্রমিক সংগঠনগুলি সরকারে যোগ দেয়নি। প্রধানমন্ত্রী হন আবদুল্লাহ হামদক। সিদ্ধান্ত হয়, অন্তর্বর্তী এই সরকার ২০২২-এর মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার গড়ার দিকে এগোবে। কিন্তু তার আগেই গত ২৫ অক্টোবর সামরিক বাহিনির এক কর্তা জেনারেল বুরহান নিজেকে সার্বভৌম কাউন্সিলের প্রধান ঘোষণা করে সরকারি ক্ষমতা দখল করেন।
এই অভ্যুত্থানকে সমর্থন করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও এই এলাকায় তার সহযোগী সৌদি আরব, বাহারিন, সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর মতো দেশগুলি। গ্রেপ্তার হন হামদক এবং মন্ত্রীসভার অধিকাংশ অসামরিক সদস্য সহ অন্যান্য নেতারা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অসামরিক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনের ডাক দেয় এসসিপি ও তাদের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক সংগঠনগুলি এবং এসপিএ। ধর্মঘট ও আইন-অমান্যের পাশাপাশি নিরস্ত্র গণআন্দোলনকেই প্রতিবাদের পথ হিসাবে বেছে নেয় তারা। কিন্তু হিংস্র সামরিক বাহিনি নিরস্ত্র জনতাকে রেহাই দেয়নি। নির্বিচারে গ্রেপ্তার, কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটানো, পথসভাগুলি ভেঙে দেওয়া, এমনকি সরাসরি গুলি চালিয়েও আন্দোলন ভাঙতে চাইছে তারা। বন্ধ করে দিয়েছে ইন্টারনেট ও টেলিফোন যোগাযোগ। তবুও হঠানো যায়নি আন্দোলনকারীদের। পথে নেমে লাগাতার বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন মানুষ। ধর্মঘটে স্তব্ধ করে দিচ্ছেন গোটা দেশ।
গত ১৭ নভেম্বর দেশ জুড়ে বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছিল। বুরহান সরকারকে সমর্থন করার সাম্রাজ্যবাদী সুপারিশ অগ্রাহ্য করে ‘অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে কোনও আলোচনা নয়’, ‘কোনও ক্ষমতা-ভাগাভাগি নয়’ এবং ‘সেনাকর্তাদের সঙ্গে কোনও আপস নয়’– এই স্লোগান তুলে এ দিনের বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেন দেশের অন্তত ১৬টি শহরের লক্ষ লক্ষ মানুষ।
এদিনও পুলিশ ও মিলিটারি ঝাঁপিয়ে পড়ে শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর। শুধু এ দিনই মারা যান কমপক্ষে ১৫ জন আন্দোলনকারী। প্রায় এক মাস ধরে চলা এই আন্দোলনে মৃতের সংখ্যা এই নিয়ে পৌঁছয় ৩৯-এ। আহত অসংখ্য। মাথায় ও শরীরে বুলেটের গুরুতর আঘাত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি বহু মানুষ। আশঙ্কা, মৃতের সংখ্যা হয়ত আরও বাড়বে। কিন্তু হাল ছাড়তে রাজি নন সুদানের সাহসী জনসাধারণ। এসসিপি এবং এসপিএ সহ আন্দোলনকারী সংগঠনগুলির আহ্বানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনপুষ্ট এই সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখার শপথ নিয়েছেন তাঁরা।