Breaking News

প্রধানমন্ত্রীর কাছে জবাব চাইছেন সাধারণ মানুষ

ফাইল চিত্র। ১৪ নভেম্বর, ২০১৬ কলকাতা

নোট বাতিলের পাঁচ বছর

২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের ঠিক আগে নরেন্দ্র মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে সমস্ত কালো টাকা উদ্ধার করে এনে সকলের অ্যাকাউন্টে বিলি করে দেবেন। দেশের বিরাট অংশের মানুষ সে কথা বিশ্বাস করেছিলেন। দু’বছর পর ২০১৬-র ৮ নভেম্বর আচমকা যখন তিনি ঘোষণা করলেন, অচল হয়ে যাবে পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট, অবাক হলেও ভরসা হারাননি মানুষ। ভেবেছিলেন, এইবার কালো টাকার ধনী কারবারিরা শায়েস্তা হবে। দুর্নীতি দূর হবে। নকল নোট বাজার থেকে হটে যাবে। ভেবেছিলেন সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপেও ভাটা পড়বে। কারণ নরেন্দ্র মোদি আশ্বাস দিয়েছিলেন, নোট বাতিল হলে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলির টাকার জোগান বন্ধ হবে। সেইসব আশ্বাসবাণীতে ভরসা করেই দেশের বিশ্বাসপ্রবণ সাধারণ মানুষ নোট বাতিলের দিনগুলিতে অশেষ যন্ত্রণা সয়েও ধৈর্য হারাননি। ব্যাঙ্কের লাইনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে প্রাণ গিয়েছে ১১৫ জনের। আচমকা অপরিকল্পিত নোট বাতিলের এই সরকারি সিদ্ধান্তে জনজীবনে নেমে আসা দুর্দশার প্রতিবাদে এস ইউ সি আই (সি) সেই সময় পথে নেমে বার বার বিক্ষোভ দেখিয়েছিল। বলেছিল, কালো টাকার উৎস পচা-গলা এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বহাল রেখে শুধু নোট বাতিল করে কালো টাকা দূর করা যায় না। প্রতিবাদ করার আহ্বান জানালে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের ওপর আস্থা রাখার অনুরোধ জানিয়েছিলেন অনেকে।

নোট বাতিলের সুফল সামনে আসার জন্য ৫০ দিন সময় চেয়েছিলেন মোদিজি। কেটে গেছে পাঁচ-পাঁচটা বছর। কালো টাকার সমান্তরাল অর্থনীতি দেশে বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে। চালু থাকা কালো টাকার প্রায় সমস্তটাই রূপ বদলে ব্যাঙ্কে ফিরে এসেছে। শুধু তাই নয়, নোট বাতিলের সময় নতুন যে দু’হাজার টাকার নোট চালু করেছিল মোদি সরকার, ২০২০ সালের তথ্য বলছে, দেশের মোট নকল নোটের ৬০ শতাংশই রয়েছে সেই দু’হাজারেরই নোটে। নোট বাতিলের পরেও একের পর এক সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনা ঘটেছে নানা জায়গায়। মোদিজি এ-ও বলেছিলেন, নোট বাতিল করে নগদহীন অর্থনীতি চালু করবেন তিনি, যেখানে অধিকাংশ লেনদেন হবে অনলাইনে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, দেশের মানুষের হাতে নোট বাতিলের সময়কার তুলনায় এ বছরের অক্টোবরে ১০.৩৩ লক্ষ কোটি টাকা বেশি নগদ অর্থ রয়েছে। অর্থাৎ নগদেই মূলত লেনদেন করছেন দেশের মানুষ। সব মিলিয়ে সকল দেশবাসীর কাছেই এ কথা আজ পরিষ্কার যে মোদিজির সমস্ত প্রতিশ্রুতিগুলিই ছিল ফাঁকা আওয়াজ এবং নোট বাতিলের গোটা কর্মসূচিটাই ছিল জনসাধারণের সঙ্গে একটা নিষ্ঠুর ঠাট্টা মাত্র।

প্রশ্ন হল, কেন এমন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি? কালো টাকার বেশির ভাগ অংশ যে নোটের আকারে থাকে না, থাকে বেনামি জমি, বাড়ি, মূল্যবান ধাতু, রত্নের আকারে– ফলে নোট বাতিলের মাধ্যমে তা উদ্ধার করা যায় না– অর্থনীতির এই গোড়ার কথা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সহযোগীদের জানা ছিল না, তা কি সম্ভব? ভারতের মতো দেশে যেখানে বিরাট অংশের মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই নেই, সেখানে নগদহীন লেনদেনের খোয়াব দেখানোর পিছনে আসলে কী উদ্দেশ্য ছিল তাঁদের?

নোট বাতিলের পাঁচ বছর পরেও মোদিজি কিংবা তাঁর সরকারের কর্তাদের দেশের মানুষের এই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো সাহস নেই। অথচ, এদেশের অধিকাংশ মানুষের রুজি-রুটি জোগায় যে অসংগঠিত ক্ষেত্রটি, প্রধানমন্ত্রীর ‘তুঘলকি’ সিদ্ধান্তে ভেঙে পড়েছিল নগদ টাকার ওপর নির্ভরশীল সেই ক্ষেত্রটি। নগদ টাকার অভাবে কাজ হারিয়েছিলেন কোটি কোটি মানুষ। নাভিশ্বাস উঠেছিল ছোট ব্যবসায়ী ও দোকানদারদের। তাঁদের বড় অংশই আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি। কৃষিক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনেও নেমে এসেছিল অন্ধকার। নগদের অভাবে চাষিরা বিক্রি করতে পারেননি তাঁদের ফসল। কিনতে পারেননি পরবর্তী রবিশস্যের বীজ, সার, কীটনাশক। ঋণের ফাঁসে দমবন্ধ হয়ে মরেছেন খেটে-খাওয়া মানুষ। আজও অর্থনীতির ভাঙা হাল। আজও ছোট শিল্পের উৎপাদন, ছোট ব্যবসা প্রভৃতি নোট বাতিলের আঘাত সামলে উঠতে পারেনি।

একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, নানা ভাবে বৃহৎ পুঁজির মালিকদের সুবিধা করে দিতেই নোট বাতিলের আচমকা সিদ্ধান্তটির যাবতীয় দায় গরিব খেটে-খাওয়া মানুষের কাঁধে এভাবে চাপিয়ে দিয়েছিল বিজেপি সরকার। আম্বানি, আদানিদের মতো মোদিজির স্নেহধন্য বৃহৎ পুঁজিপতিদের সম্পদের সামান্য অংশই যেহেতু নগদে থাকে, তাই তাঁদের গায়ে নোট বাতিলের সামান্য আঁচও লাগেনি। কারণ, শেয়ার বাজার, জমিজায়গার ব্যবসা, বিদেশি ব্যাঙ্কের আমানত, বন্ড ইত্যাদিতে নিয়োজিত এইসব ধনকুবেরদের সম্পদ নোট বাতিলের ফলে ক্ষতির মুখে পড়েনি। বরং নোট বাতিলের কারণে ব্যাঙ্কে জমা পড়া নগদ টাকার পাহাড় পরবর্তী সময়ে সহজে ব্যাঙ্কঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে এঁদের সুবিধাই করে দিয়েছে। পাশাপাশি, নোট বাতিলের ফাঁদে পড়ে ছোট ব্যবসাপত্রের সর্বনাশ হয়ে যাওয়ায় পৌষমাস দেখেছেন বড় পুঁজির মালিকরা। ছোট-মাঝারি ব্যবসার ফাঁকা বাজারের দখল নিয়েছেন তাঁরা। ফুলে-ফেঁপে উঠেছে বিগবাজার, স্পেনসার্স, অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট, বিগ বাস্কেটের মতো সংগঠিত খুচরো বিপণনকারীদের বড় পুঁজির ব্যবসা। ভারতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন কনফেডারেশন অফ অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্স-এর সেক্রেটারি জেনারেল যখন জানিয়েছিলেন, নগদ সংকটে গোটা দেশের বাজারে কেনাবেচার পরিমাণ ৬০ শতাংশ কমে গিয়েছে, ঠিক সেই সময়ে অনলাইনে মুদিখানার পণ্য বেচার সংস্থা বিগ বাস্কেট-এর এক বড়কর্তা জানান, তাঁদের বিক্রি ৪০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। আর এক অনলাইন মুদিখানা ব্যবসায়ী গ্রোফার্সের এক অধিকারিক বলেন, নোট বাতিলের পর তাঁদের বিক্রি ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বেড়েছে, আর দৈনিক অর্ডার বেড়ে গেছে ২০ শতাংশ। (এই সময়, ১০.১২.২০১৬)।

শুধু কি তাই! নানা ঘটনায় এ কথা আজ পরিষ্কার যে, জনসাধারণ না জানলেও বিজেপি-ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিরা ও দলের ধনী নেতারা অনেক আগে থেকেই জানতেন নোট বাতিলের কথা। গুজরাটে বিজেপির প্রাক্তন মন্ত্রী যতীন ওঝা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে এ ব্যাপারে অভিযোগ করেছিলেন। এরপর নরেন্দ্র মোদির নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে সামান্য অসুবিধাও হয় কি?

নোট বাতিলের পিছনে আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল। ঠিক তার পরের বছর ছিল উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। সেই নির্বাচনে বিজেপির হয়ে জনসমর্থন জোগাড় করার দায় ছিল নরেন্দ্র মোদির। এই অবস্থায় দেশের মানুষের সামনে নিজের দুর্নীতিবিরোধী কঠিন-কঠোর ভাবমূর্তি নির্মাণে নোট বাতিলকে হাতিয়ার করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। এর ফলে দেশের অর্থনীতির অসংগঠিত অংশ কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে-খাওয়া মানুষের জীবনে কী ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়তে পারে, সে সব চিন্তা মনের কোণেও ঠাঁই দেননি তিনি। নোট বাতিলকে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘বেইমানদের বিরুদ্ধে ইমানদারদের লড়াই’। দেখা গেল, নোট বাতিলের মাধ্যমে আসলে ইমানদার জনসাধারণের সঙ্গেই বেইমানি করল বিজেপি সরকার। বাস্তবে এটাই হল জনবিরোধী একটি দক্ষিণপন্থী দলের সরকার ও তার নেতার প্রকৃত চরিত্র। নোট বাতিলের পাঁচ বছরে প্রধানমন্ত্রী সহ কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের কাছে এর জবাব দাবি করছেন জনসাধারণ।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ১৬ সংখ্যা ২৬ নভেম্বর ২০২১