Breaking News

খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি নিঃশব্দ মৃত্যু পরোয়ানা

ফাইল চিত্র

রান্নার গ্যাসের দাম আর এক দফা বেড়ে ৯১১ টাকা সিলিন্ডার। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার মাসখানেক আগে এই দাম ছিল ৪১০ টাকা। সাত বছরে মোদি শাসনে ৫০০ টাকার উপর দাম বৃদ্ধি। এই অতিমারি ও লকডাউনের মতো দুঃসময়ে দাম বাড়ানো হয়েছে ২৯০.৫০ টাকা।

শুধু কি জ্বালানির দাম বেড়েছে? খাদ্যের দামও বেড়েছে প্রচুর। রাষ্ট্রপুঞ্জের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের সূচক অনুযায়ী, গত এক বছরে গড়ে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৩১ শতাংশ। এর ফলে দেশের বেশিরভাগ মানুষকে খাদ্য জোগাড় করতেই হিমসিম খেতে হচ্ছে। পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে মানুষ অনাহার-অর্ধাহার-অপুষ্টির পথ বেয়ে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। মূল্যবৃদ্ধি এই ভাবে নিঃশব্দ ঘাতক রূপে হানা দিচ্ছে দুয়ারে।

খাবারের দাম বাড়লে মানুষ অসম খাদ্য অর্থাৎ, যা গ্রহণ করলে পুষ্টি হয় না, এমন জিনিস দিয়েই পেট ভরাতে বাধ্য হয়। সাধারণত মাছ, মাংস, ডিম, ডাল ইত্যাদি প্রোটিন যুক্ত খাবারের মূল্য সর্বাধিক হয়ে থাকে। তুলনায় কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবারের দাম কম থাকে। ফলে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি ঘটলে মানুষ প্রোটিন, ভিটামিন ও বিভিন্ন পুষ্টি গুণসম্পন্ন খাদ্য ক্রমশ কমাতে থাকে। উচ্চবিত্তদের এ নিয়ে সমস্যা নেই। সমস্যা গরিব, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের। কারণ এই অংশের স্থায়ী রোজগার নেই, যতটুকুও বা ছিল অতিমারি লকডাউন জারি তা ভেঙে দিয়েছে। এরাই জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের বেশি। এদের পুষ্টিগুণসম্পন্ন আহারের ভারসাম্য নষ্ট হলে, অর্থাৎ, যে খাদ্য উপাদান যতটুকু পরিমাণে গ্রহণ করা সুস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি, মূল্যবৃদ্ধি সহ রোজগারহীনতার কারণে তা গ্রহণ করতে না পারলে মারণ প্রভাব পড়ে জনজীবনে। বয়স্করা নানা রোগের শিকার হন। শিশুদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। তাদের মানসিক বৌদ্ধিক বিকাশ যথাযথ ভাবে গড়ে ওঠে না। তাদের কর্মক্ষমতায় থেকে যায় ঘাটতি। ঠিক মতো গড়ে ওঠে না রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও। নারীদের ক্ষেত্রে এই সংকট আরও বেশি। বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে এই সংকট ভয়াবহ। প্রসবকালে অনেকেরই জীবন সংশয় ঘটে। জন্ম হয় অপুষ্ট শিশুর। পরিণাম শিশুমৃত্যুর হার বাড়ে। এই ভাবে মূল্যবৃদ্ধি এক ভয়াবহ প্রভাব রেখে যায় জনজীবনে।

মূল্যবৃদ্ধি খাদ্য নিরাপত্তা ধ্বংস করে। বৈদেশিক আক্রমণের চেয়েও এর মারণ ক্ষমতা কোনও অংশে কম নয়। অথচ মূল্যবৃদ্ধি রোধে মোদি সরকারের কোনও হেলদোল নেই। ভোজ্য তেলের দাম এখন ২০০ টাকার কাছাকাছি। গত এক বছরে লিটার প্রতি দাম ৫০ টাকার বেশি বেড়েছে। এখানেও রয়েছে মোদি সরকারের ভূমিকা। মোদি সরকার তিনটি কৃষি আইন প্রণয়ন করে সমস্ত রকম তৈলবীজকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য তালিকার বাইরে রেখেছে, যার অর্থ, এগুলো মজুত করা যাবে, বাজারে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে মুনাফা করা যাবে। এর ফলেই মূল্যবৃদ্ধির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। এর সঙ্গে পেট্রল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি মারাত্মক ঘটেছে। পেট্রল-ডিজেলের উপর কেন্দ্র-রাজ্য ট্যাক্স বসিয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে, যার ফলে পরিবহণের খরচ বৃদ্ধি মূল্যবৃদ্ধিকে অসহনীয় করে তুলেছে।

গ্যাসের এই দাম বৃদ্ধি আন্তর্জাতিক কারণে ঘটেনি। আন্তর্জাতিক বাজারে এলপিজির দাম কমছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি মেট্রিক টন এলপিজির দাম গত তিন বছর ধরে ২০১৪ সালে ছিল ৮৮০ ডলার, ২০১৬ সালে তা কমে হল ৩৯৪ ডলার, ২০২১ এ তা আরও কমে হল ৩৮২ ডলার। (সূত্রঃ পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের পেট্রোলিয়াম প্ল্যানিং অ্যান্ড অ্যানালাইসিস সেল)

এই হিসাবে টাকার মূল্যে এক সিলিন্ডার গ্যাসের দাম হয় ৭৮৬.৬০ টাকা। এর সঙ্গে আমদানি শুল্ক, পরিবহণ, রিফিল, অন্তশুল্ক, ডিলার কমিশন ইত্যাদি যুক্ত করে দাম আরও বেশি ছিল। তা সত্ত্বেও সরকার ভর্তুকি দিয়ে গ্যাস দিত ৪১০ টাকায়। তাহলে দেশের বাজারে দাম বাড়ল কেন? দাম বেড়েছে সরকারি সিদ্ধান্তে। পরিস্থিতি আজ অসহনীয় হয়ে উঠেছে সরকারি সিদ্ধান্তে গ্যাসে ভর্তুকি প্রায় উঠে যাওয়ায়। কয়েক বছর আগেও গ্যাসের দাম বাড়লে ভর্তুকিও বাড়ত এবং ৩০০র বেশি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হত। মোদি সরকার সব বন্ধ করে দিয়েছে। এখন প্রায় কোনও ভর্তুকিই ঢুকছে না।

অনেকেরই হয়ত মনে আছে, ২০০৮ এবং ২০১১ সালে মূল্যবৃদ্ধির ফলে খাদ্যদাঙ্গা ফেটে পড়েছিল আফ্রিকা এবং এশিয়ার ৩০টিরও বেশি দেশে। ‘আরব বসন্ত’ নামে যে বিদ্রোহের বিস্ফোরণ ঘটেছিল আরব দেশগুলিতে, তার পিছনে ছিল মূল্যবৃদ্ধি জনিত খাদ্য সংকট। সেই বিস্ফোরণের অভিঘাতে সরকার বদলেছে, কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি ঘটে যে পুঁজিবাদী অর্থনীতির কারণে, তার গায়ে আচড়টিও পড়েনি। এখন ওই সব দেশে আবারও মূল্যবৃদ্ধির সংকট দেখা দিয়েছে। করোনা অতিমারির সুযোগ নিয়ে পুঁজিপতিরা দাম বাড়িয়ে মানুষকে খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে।

এদেশের মানুষের দুর্ভাগ্য, সরকার তাদের খোঁজ রাখে না। মোদি সরকারের অর্থ মন্ত্রক এমন নির্লজ্জ স্বীকারোক্তি করেছে। দেশের ২৩ কোটি মানুষ অতিমারি লকডাউনে হয় কাজ হারিয়ে, অথবা বেতন হ্রাসের বলি হয়ে প্রবল দারিদ্রে নিমজ্জিত। সিএমআইআই-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, শুধু এই আগস্টেই দেশে সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে ১৫ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছে। এদের প্রতি সরকারের কোনও দায়িত্ব নেই? বেঁচে থাকার যে অধিকারের কথা সংবিধানে লেখা আছে, কী থাকে তার মূল্য, যদি না থাকে খাদ্যের সহজলভ্যতা? যদি খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে নিরন্তর, যদি রান্নার জ্বালানির দাম বাড়ে অবিরাম, তাহলে এই সহজলভ্যতা আর থাকে না, সব অধিকার হয়ে যায় নিষ্ফলা। একটা সরকার গণতান্ত্রিক হলে, নূ্যনতম মানবিক হলে সে দেশের মানুষকে খাওয়ানোর দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। অথচ পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে সরকারি অবহেলায়। এখানেই দরকার গণআন্দোলন। রেশনে পর্যাপ্ত চাল গম ছাড়াও ভোজ্যতেল দিতে হবে, গ্যাসে ভর্তুকি আগের মতো দিতে হবে, এই দাবিতে তীব্র গণআন্দোলন জরুরি।