সত্যের জোর বেশি, না অসত্যের, অন্যায়ের? এর উত্তর যুগে যুগেই খুঁজেছে মানুষ। অর্থের জোর বেশি না কলমের জোর, দুর্নীতির জোর বেশি না নীতির জোর, গায়ের জোর বেশি না বুদ্ধির জোর – সঠিক যুগচিন্তা বলছে ন্যায়ের জোর, সত্যের জোর, কলমের জোর, বুদ্ধির জোর বেশি। তা কোনও কালেই কোনও শাসকগোষ্ঠী শত চেষ্টাতেও উল্টে দিতে পারে না। নিপীড়িত, শোষিত মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সত্যকে জানার, আর সে ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ (বর্তমান সময়েও সংবাদমাধ্যমের যতটুকু নিরপেক্ষতা রয়েছে)। সংবাদমাধ্যমের সেই স্বাধীনতাকেই চূড়ান্তভাবে হরণ করা হচ্ছে।
সম্প্রতি মদ মাফিয়াদের অবৈধ কারবারের বিরুদ্ধে খবর করতে গিয়ে রহস্যমৃত্যু হয়েছে ‘এবিপি গঙ্গা’ পত্রিকার প্রতাপগড় জেলার সাংবাদিক সুলভ শ্রীবাস্তবের। ওই সাংবাদিকের স্ত্রী অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে সুলভকে খুনের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ করেছেন। পরিবারের আশঙ্কা, সুলভের মৃত্যু দুর্ঘটনায় হয়েছে বলা হলেও আসলে তাঁকে খুন করা হয়েছে। এর যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। জানা গেছে, ওই সাংবাদিক খুনের আশঙ্কা করে মৃত্যুর আগের দিনই পুলিশের এডিজি-র কাছে চিঠি দিয়েছিলেন। ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট’ করার অভিযোগে অনলাইন পত্রিকা ‘দ্য ওয়ার’ এবং তার দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এফআইআর করেছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। তাদের অপরাধ, গাজিয়াবাদে এক মুসলিম বৃদ্ধকে মারধর ও জোর করে ‘জয় Àরাম’ বলানোর খবর তারা প্রকাশ করেছিল। পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সরাসরি অভিযোগ করেছেন, যোগী আদিত্যনাথের সরকার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না।
কেরালার একটি মালয়ালম পত্রিকার সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের সাথেও অমানবিক আচরণ করে চলেছে উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারের পুলিশ। কোনও প্রমাণ না থাকা সত্তে্বও তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে গত এক বছর ধরে জেলে আটকে রেখেছে। গত ৫ অক্টোবর হাথরসে এক দলিত কিশোরীকে শারীরিক অত্যাচার করে পুড়িয়ে মেরে ফেলার খবর সংগ্রহ করতে গেলে ওই সাংবাদিক সহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে ইউএপিএ এবং আইটিএ-র (ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যাক্ট) মতো আইনে মামলা দায়ের করা হয়। জেলের ভেতর তিনি বেঁচে রয়েছেন কি না তা একমাস পর্যন্ত জানানো হয়নি তাঁর পরিবারকে। তাঁর মায়ের মৃত্যুর সময়ও তাঁকে ছাড়া হয়নি। অথচ তাঁদের বিরুদ্ধে আনা একটা অভিযোগও আজ পর্যন্ত প্রমাণ করতে পারেনি পুলিশ। বিজেপির স্বপ্নের ‘রামরাজ্য’ দুষ্কৃতীদের স্বর্গরাজ্য, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে জঙ্গলরাজ্যে পরিণত হয়েছে।
কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদের সমালোচনা করায় সে রাজ্যের দুটি সংবাদপত্রের দপ্তর বন্ধ করেছে পুলিশ এবং ১৮ জন সাংবাদিক জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের ভয়ানক জেরার মুখে পড়েছে। ৩০ বছর ধরে চলা জম্মু-কাশ্মীরের সবচেয়ে পুরনো ইংরেজি পত্রিকা ‘কাশ্মীর টাইমস’ বিজেপি সরকারের অবৈধ কাজকর্মের বিরোধিতা করায় তাদের জম্মুর অফিস বন্ধ করে দিয়েছে। সম্পাদক অনুরাধা ভাসিনকে তাঁর ফ্ল্যাট থেকে উচ্ছেদ করা হয় এবং পত্রিকার সমস্ত বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া হয়। জম্মু-কাশ্মীরে সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিস্থিতি বিন্দুমাত্র নেই।
সারা দেশ জুড়ে এরকম অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে। অতিমারির সময়ে সরকার নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে করোনা-বিধির কড়াকড়িকে ঢাল করে সাংবাদিকদের কাজকে নিয়ন্ত্রণ করছে ব্যাপকহারে। দিল্লি গণহত্যার সময় শাসক দলের এক নেতাকে প্রশ্ন করায় টিভি সাংবাদিক পরবিনা পুরকায়স্থ বীভৎস অত্যাচারের শিকার হন। দেশি-বিদেশি পুরস্কারপ্রাপ্ত দিল্লির সাংবাদিক নেহা দীক্ষিত ‘ধর্ষণ, অ্যাসিড হামলা ও হত্যার’ হুমকি পেয়েই চলেছেন। তাঁর ফ্ল্যাট ভাঙচুর হয়েছে, তিনি লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। কৃষক আন্দোলনের খবর করতে গিয়ে বহু সাংবাদিক সরকার ও প্রশাসনের হেনস্থার শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক দলের মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীদের দ্বারা সাংবাদিকদের প্রাণনাশের হুমকি, শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহ, ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা, যে কোনও ঘটনায় সাম্প্রদায়িক রং চড়ানো, রহস্যমৃত্যু, খুন, লকআপে বন্দি করা, রাষ্ট্রদ্রোহী দাগিয়ে দিয়ে নানা অমানবিক আইনের জালে বছরের পর বছর বন্দি করে রাখা, বিচারের নামে প্রহসন ইত্যাদি চলছে। সত্যের আলো জ্বালিয়ে রাখার জন্য শাসক দলের থেকে এই সমস্ত ‘পুরস্কার’ জুটছে সাংবাদিকদের!
বর্তমানে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ভারত বিশ্বের মধ্যে ক্রমাগত নামতে নামতে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪২-এ পৌঁছেছে। ‘মিডিয়া ওয়াচডগ’ রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)-এর মতে, সাংবাদিকদের জন্য ‘বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক’ দেশগুলির একটি ভারত। আরএসএফের মতে, ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি সাংবাদিকদের জোর করে সরকারের হিন্দু জাতীয়তাবাদী লাইনের পক্ষে আনার চেষ্টা করে চলেছে। সেজন্য কখনও দুষ্কৃতীদের দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে তারা সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ নামিয়ে এনেছে, কখনও পুলিশ দিয়ে অত্যাচার চালাচ্ছে।
সত্যকে তুলে ধরাই সংবাদমাধ্যমের কাজ। আজকের দিনে বেশিরভাগ বড় সংবাদমাধ্যমই কর্পোরেট পুঁজির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এর মধ্যেও সাংবাদিকদের কলমে যতটুকু বেরিয়ে আসে, তার টুঁটি চেপে ধরা মানে অসত্য, অন্যায়কে, অন্ধতাকে প্রশ্রয় দেওয়া। এর দ্বারা যুক্তিহীন, সরকারের আজ্ঞাবহ একদল মানুষকে গড়ে তোলার চেষ্টা চলে, যারা সরকারের যে কোনও কাজকেই অন্ধভাবে, ন্যায়-অন্যায় বিচার না করে সমর্থন করবে। সরকারও এদের সমর্থন দেখিয়ে বাহবা কুড়োয়। কোনও রকম সত্যের প্রকাশকে তাই জনবিরোধী সরকারগুলির এত ভয়। কংগ্রেসও জরুরি অবস্থার সময় সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করেছিল। বর্তমানে বিজেপি তা ভয়ঙ্করভাবে করে চলেছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ আসলে মতপ্রকাশের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ। সরকারের এতটুকু সমালোচনা করলেই রে রে করে ওঠা সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশের নয়, সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাবেরই পরিচয়। এইভাবে বিরুদ্ধ মতকে দমন করার মধ্য দিয়ে এবং প্রচারমাধ্যমকে নিজেদের বশংবদ করতে চেয়ে বিজেপি ফ্যাসিবাদের জমিই প্রস্তুত করছে।