বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে এস ইউ সি আই (সি)র কেরালা রাজ্য কমিটির বিবৃতি
সদ্য অনুষ্ঠিত কেরালা বিধানসভা নির্বাচনে এলডিএফ জোটের জয় প্রকৃত বামপন্থী রাজনীতির জয় বলে মনে করে না এস ইউ সি আই (সি)-র কেরালা রাজ্য কমিটি। যে দায়িত্বগুলি পালন করলে কোনও বামপন্থী সরকারকে একটি দক্ষিণপন্থী সরকারের থেকে মৌলিক ভাবে পৃথক করা যায়, পিনারাই বিজয়নের নেতৃত্বাধীন এলডিএফ সরকার সেগুলি পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এই সরকারের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক সমস্ত নীতিই বৃহৎ পুঁজিপতি ও সমাজের ধনী অংশের মুনাফা-শিকার ও বাড়বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে। ভোটের ফল প্রকাশের ঠিক পরের দিনই মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, আগেরবার এলডিএফ সরকারের নীতি ছিল সহজে ব্যবসা-বাণিজ্য করার ব্যবস্থা করা— এবারেও সেই নীতিই অনুসরণ করা হবে। কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজ-এর কেরালা শাখা এলডিএফ সরকারের কাছ থেকে পাওয়া সুযোগসুবিধাগুলির কথা স্মরণ করে এই সরকারের পুনর্নির্বাচিত হওয়ায় যেভাবে আনন্দ প্রকাশ করেছে, তা থেকে পরিষ্কার যে, এই সরকারের মূল নীতিগুলিকে শিল্পমহল কীভাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে।
একটি বাম সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব হল জনগণের সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে গণআন্দোলন গড়ে তোলার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। তাই একটি বামপন্থী সরকার দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করে তোলা থেকে বিরত থাকবে, এটাই হওয়া উচিত। কেরালার এলডিএফ সরকার ঠিক এর বিপরীত কাজটাই করেছে। প্রকৃত বাম রাজনীতির সঙ্গে বেমানান এই নীতিগুলোর কারণেই যদি কেরালায় এই জয় এসে থাকে তাহলে। একে কোনও মতেই বামপন্থী রাজনীতির জয় হিসাবে দেখা চলে না।
এই জয়ের পিছনে আরও একটি বিষয় রয়েছে। সেটি হল, জনগণের জন্য যেসব সামাজিক কল্যাণমূলক কার্যকলাপ করা হয়েছে, সেগুলির ব্যাপক প্রচার সরকারি নীতির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে প্রশমিত করেছে। বিপদের সময়ে সরকারি সাহায্য পাওয়া যে দেশবাসীর অধিকারের মধ্যে পড়ে—এই রাজনৈতিক সচেতনতা প্রসারের পরিবর্তে, শাসকদের দয়ার দানের উপর নির্ভরশীলতার মানসিকতা তৈরির এই অপচেষ্টা, আর যাই হোক, বামপন্থী রাজনীতি নয়। বামপন্থী রাজনীতির প্রকৃত দায়িত্ব হল, নির্ভরশীলতা এবং দাসত্বের মানসিকতা থেকে মুক্ত করে জনগণকে এমনভাবে শিক্ষিত করা যাতে তারা। সরকারি নীতিগুলি বিশ্লেষণ করে গণতান্ত্রিক চেতনার ভিত্তিতে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। দক্ষিণপন্থী সরকারগুলিও জনপ্রিয়তা লাভের জন্য অর্থনৈতিক ও বস্তুগত সাহায্য দেওয়ার নানা প্রকল্প গ্রহণ করে। বিপদের সময়ে জনগণের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করা ও নানাভাবে তাদের সাহায্য দেওয়া একটি সরকারের ন্যূনতম দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ভোটে এলডিএফ জোটের জয়ের অর্থ এই নয় যে এদেরই তৈরি পূর্বতন সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনাগুলি ভিত্তিহীন কিংবা সেগুলি জনগণ মেনে নিয়েছে। চূড়ান্ত অরাজনৈতিক কায়দায় সংঘটিত এই নির্বাচনে জাতীয় বা রাজ্য স্তরের কোনও গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়নি। অর্থাৎ এই বিষয়গুলির ভিত্তিতে জনগণ এই নির্বাচনে তাদের মত প্রকাশ করেনি। ভোটের এই ফলে প্রকাশিত হয়েছে। বিজেপির নীতির বিরুদ্ধে জনগণের তীব্র বিরোধিতা। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী নীতি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জনগণের বিরক্তিকে এলডিএফ বা ইউডিএফ জোট কেউই রাজনৈতিক যুদ্ধে পরিণত করতে পারেনি। ভোট কেনাবেচার জন্য বিজেপির ভোট কমেছে, এই তত্ত্ব খাড়া করে সিপিআই(এম) দেখানোর চেষ্টা করছে যে নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিগুলির কোনও প্রভাবই পড়েনি।
নির্বাচনী প্রচারে এই ফ্রন্টগুলি ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক আবেগ খুঁচিয়ে তুলে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। শবরীমালা কাণ্ড, লাভ জিহাদ, মুসলিম বিরোধী কুকথা ইত্যাদির মাধ্যমে। সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতার তাস খেলা হয়েছিল। বিজেপির দিকে লক্ষ্য রেখে সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতাও ব্যবহৃত হয়েছিল। নায়ার সম্প্রদায়ের সংগঠন নায়ার সার্ভিস সোসাইটি, খ্রিস্টানদের সংগঠন ইয়াকোভায়া সভা, মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা ইত্যাদির সঙ্গে আঁতাত করা হয়েছিল যাতে ভোটে তার ফয়দা তোলা যায়। গোটা রাজনৈতিক দৃশ্যপট জুড়ে সুবিধাবাদ এবং অনৈতিক কার্যকলাপ চলেছে। মাত্র কয়েকটা আসনের জন্য ফ্রন্টগুলি যে কোনও ধরনের ছলচাতুরীর আশ্রয় নিতে এতটুকু দ্বিধা করেনি। এলডিএফ যে মানি কংগ্রেসকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে গত নির্বাচনে দাগিয়ে দিয়েছিল, এ বছর সেই দলটিকেই তারা কাঁধে নিয়ে ঘুরেছে। বাম রাজনীতির সঙ্গে এতটুকু সম্পর্ক নেই এমন অনেককে তারা প্রার্থী করেছে। এলডিএফের জয়ের পেছনে অন্যতম একটি কারণ হল, এই জোটটি অন্য দুটি জোটকে সাম্প্রদায়িক এবং অনৈতিক রাজনীতির প্রতিযোগিতায় পিছনে ফেলে দিয়েছে। আশু সুবিধার লক্ষ্যে এই ধরনের অপরাজনীতি আমদানি করার কঠিন দাম ভবিষ্যতে চোকাতে হবে কেরালাকে।
জনগণের সামনে সঠিক পথ হল, সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করে চলা মহান বামপন্থী রাজনীতির পক্ষ নেওয়া। এলডিএফের জয়ের জন্য যারা কাজ করেছেন তারা সহ সমস্ত বামমনস্ক মানুষকে দুঃখের হলেও একটি কঠিন বাস্তব সত্য স্বীকার করতে হবে, তা হল, কেরালাবাসী দীর্ঘদিন ধরে গৌরবের সঙ্গে যে বামপন্থী মানসিকতার চর্চা করে এসেছে, লালন করেছে, তা আজ অনেকখানি দুর্বল। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বাড়তে থাকা প্রভাব, সামাজিক পরিবেশে বিজ্ঞান চেতনা এবং যুক্তিপূর্ণ চিন্তা ভাবনার অভাব, গণতান্ত্রিক সহনশীলতা কমে যাওয়া, চুড়ান্ত সুবিধাবাদের ব্যাপক প্রসার, সুবিধা পাওয়ার জন্য নির্দ্বিধায় যে কোনও ধরনের হীন কাজে যুক্ত হওয়ার অনৈতিক রাজনীতি, অধিকার আদায়ে সাহসের সঙ্গে লড়াই করার বদলে কর্তৃপক্ষের কাছে ভিক্ষাবৃত্তি ও দাসত্বের মনোভাব, এই সমস্ত কিছুই সমাজে ফ্যাসিবাদী মানসিকতার জমি তৈরি করবে। বিজয় উৎসব এবং নতুন সরকারের কাছে আমাদের আশা ব্যক্ত করার মাঝে এই ঐতিহাসিক শিক্ষাটি আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। তাই, সচেতন চিন্তাভাবনার ভিত্তিতে বাম মানসিকতা পুনরুদ্ধারের কঠোর সংগ্রামে আমাদের আত্মনিয়োগ করা উচিত। বাম রাজনীতির সঠিক পথ হল, জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গণআন্দোলন গড়ে তোলা। গণআন্দোলন গড়ে তোলার এই রাজনীতিকে সর্বশক্তি দিয়ে ঊর্ধ্বে তুলে ধরাই এখন আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।