শত শত মানুষের লাশ বয়ে চলেছে গঙ্গা, বয়ে চলেছে যমুনা। শুধু সহস্র নিরন্ন অসহায় মানুষের হাহাকার নয় শত শত লাশের ভারও আজ বইতে হচ্ছে তাদের। উত্তর প্রদেশের গঙ্গা তীরের মানুষ সম্মুখীন এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার। প্রতিদিন তাদের গ্রামে, শহরে গঙ্গার ঘাটে, মাঝ নদীর চড়ায় এসে ঠেকছে শত শত মানুষের মৃতদেহ। বালির চড়ায় পুঁতে দেওয়া হাজার হাজার মানুষের মৃতদেহ জল বাড়লেই ভেসে উঠছে। কুকুর, শিয়াল, কাকে ঠুকরে খাচ্ছে সেই দেহ। এ যদি নরক না হয়, নরক তবে কোনটা? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যে বারাণসীতে দাঁড়িয়ে তার হিন্দুত্ব আর গঙ্গা প্রেমের বড়াই করেন, সেই বারাণসীর ঘাটেও ভেসে চলেছে লাশ। যে লাশ ভেসে বিহার পর্যন্ত পৌঁছেছে। এঁদের বেশিরভাগই করোনা রোগে প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু কেন এই হতভাগ্য মৃতদের সম্মানজনক শেষকৃত্যটুকুও হল না? এই মর্মান্তিক পরিণতিই কি দেশের নাগরিক হিসাবে পাওনা ছিল তাদের ? অবশ্য যে দেশে সরকার কোনও গণতন্ত্রের ধার ধারে না, যে দেশের শাসক দলগুলি জানে, জনস্বার্থের কোনও তোয়াক্কা না করলেও চলে— একচেটিয়া মালিকদের সেবার বিনিময়ে পাওয়া টাকার থলির জোর আর ধর্মজাতপাতের বিদ্বেষের জিগির তুললেই গদিলাভ নিশ্চিত, সে দেশে মানুষের এই দুর্দশা হবে না কেন! আজ বিজেপি সরকার চাইছে কোভিড আক্রান্ত এবং মৃত মানুষের পরিসংখ্যান চেপে দিতে। কারণ সারা উত্তরপ্রদেশে চিকিৎসা পরিকাঠামো, অক্সিজেন, ওষুধের অভাব চরম জায়গায়। গত ১২ মে ইন্ডিয়া টু ডে-র একটি সংবাদ তারই সামান্য একটা খণ্ডচিত্র তুলে ধরেছে। গ্রেটার নয়ডা গ্রামের আতর সিং তার এক পুত্রকে শ্মশানে দাহ করে এসে দেখেছেন ততক্ষণে আর এক পুত্রও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। ২৮ এপ্রিল থেকে ১১ মে-র মধ্যে ওই গ্রামে ১৮ জন কোভিড লক্ষণযুক্ত রোগীর মৃত্যু হয়েছে। অথচ কারও কোভিড টেস্ট হয়নি। কারণ কাছাকাছি কোভিড পরীক্ষার কোনও সরকারি ব্যবস্থা নেই। যা আছে তার সুযোগ নেওয়ার আর্থিক ক্ষমতা গ্রামবাসীদের নেই। এই নয়ডাকেই এক সময় উন্নয়নের প্রতিরূপ বলে তুলে ধরেছিল সরকার। দিল্লির উপকণ্ঠে নয়ডার অবস্থাই দেখিয়ে দিচ্ছে সারা উত্তরপ্রদেশে চিকিৎসার হাল কোথায় দাঁড়িয়ে!
সংবাদমাধ্যমে যতটুকু খবর বেরিয়ে আসছে সেটাই ভয়াবহ। বাস্তব চিত্রটা যে আরও ভয়াবহ তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কোভিড টেস্টের ব্যবস্থা নেই, চিকিৎসা নেই, অক্সিজেন নেই, ওষুধ নেই, হাসপাতালে পর্যাপ্ত বেড নেই— এই নেই রাজ্য নিয়েই চলছে উত্তরপ্রদেশের কোভিড ব্যবস্থাপনা। সাধারণ মানুষ শুধু নয় বিজেপির নেতা এমনকি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষকুমার গঙ্গোয়ার পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে চিঠি লিখে বলছেন, ভেন্টিলেটর থেকে ওষুধ সব কিছু নিয়ে কালোবাজারি চলছে। একাধিক বিজেপি বিধায়ক চিঠি লিখেছেন, তাদের পরিজনরা পর্যন্ত কীভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন, বেড পাননি এই সব নিয়ে। বিজেপির একজন বিধায়কও করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন। অথচ মানুষকে চিকিৎসা দেওয়ার বদলে বিজেপি সরকার ব্যস্ত সরকারের সমালোচনার গলা টিপে ধরার কাজে। প্রাক্তন আইএএস অফিসার সূরজ কুমার সিংহ সরকারের খামতি তুলে ধরে টুইট করায় তার বিরুদ্ধে এফআইআর করেছে পুলিশ। এর আগে দাদুর জন্য অক্সিজেন চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে আকুল আবেদন জানানো যুবকের বিরুদ্ধেও এফআইআর করেছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ।
এই পরিস্থিতিতে মৃতের সংখ্যা চাপা দিতে সরকারি তত্ত্বাবধানেই অনেক করোনা আক্রান্তের মৃতদেহ নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। লন্ডনের দ্য টেলিগ্রাফ, এশিয়া নিউজের মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও বলা হয়েছে বহু ক্ষেত্রে সরকারি অ্যাম্বুলেন্স চালকরাই নদীতে দেহ ফেলছেন (দ্য টেলিগ্রাফ, এশিয়া নিউজ ১১ মে,২১)। আরও কিছু মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। একেকটা এলাকায় এত বেশি সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটছে যে, শ্মশানঘাট, কবরস্থানে জায়গা নেই। শ্মশানে দাহ করার জন্য ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাওয়া হচ্ছে। ফলে মৃতের নিরুপায় স্বজনেরা। দেহ কোনও রকমে একটু আগুন ছুঁইয়ে ফেলে দিচ্ছেন গঙ্গার জলে। না হয় পুঁতে দিয়ে আসছেন নদীর তীরের বালিতে। পরে জলের ধাক্কায় সেই দেহ বেরিয়ে আসছে।
বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী যাোগী আদিত্যনাথ, প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতোই করোনা সংক্রমণ বাড়ার সময়টাতেই দীর্ঘ দিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের ভোট নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে, নিজের রাজ্যে করোনা পরিস্থিতির উপর নজর রাখতে পারেননি। এর আগেও তিনি ব্যস্ত ছিলেন, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো, গো-রক্ষার নামে নরহত্যায় ইন্ধন দেওয়া ইত্যাদি সব গুরুত্বপূর্ণ কাজে। কুম্ভ মেলায় লক্ষ লক্ষ লোকের জমায়েত হতে দিয়ে সুপার স্প্রেডারের দায়িত্ব বিজেপি নেতারাই পালন করেছেন। একই সাথে শত শত বাইরের লোককে নিয়ে গিয়ে দিনের পর দিন পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে করোনা ছড়িয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে যোগী আদিত্যনাথজি। দেশের অধিকাংশ মানুষকে টিকা দেওয়ার কোনও দায় নেবে না বলে কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়ে দিয়েছে, অথচ প্রধানমন্ত্রীর বিলাসবহুল বাসভবন সহ সেন্ট্রাল ভিস্টার ২০ হাজার কোটি টাকা, প্রধানমন্ত্রীর বিমান কিনতে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা খরচ করতে তাদের অসুবিধা নেই। উত্তরপ্রদেশে বিজেপি সরকার সেই পথেই হেঁটে চিকিৎসার উপরে ঠাঁই দিয়েছে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মীদের হেনস্থা করার কাজকে। মানবদরদী চিকিৎসক কাফিল খান, সরকারের সমালোচক সাংবাদিক, হাথরসে কিশোরীকে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করতে যাওয়া সাংবাদিক সহ সমস্ত সমালোচকের বিরুদ্ধেই দেশদ্রোহের মামলা দেওয়ার কাজই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তারা ভেবেছিলেন সরকারের সমালোচনা বন্ধ হলেই সব ছিদ্র বন্ধ করে তারা সুখে রাজত্ব করবেন। উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে সরকারের বিপদ এড়ানোর এই হাস্যকর প্রচেষ্টা দেখে একাধিকবার দিল্লি হাইকোর্ট, লক্ষৌ হাইকার্ট, বোম্বে হাইকোর্ট, মাদ্রাজ হাইকোর্ট এমনকি সুপ্রিম কোর্টও তীব্র সমালোচনা করেছে। কিন্তু সরকারের কানে জল ঢোকেনি।
শুধু উত্তরপ্রদেশ সরকার নয়, বিজেপি পরিচালিত মধ্যপ্রদেশ, গোয়া, কর্ণাটক সরকারও একই রকমের অপদার্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। অবশ্য বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার এবং তার প্রধান নেতা নরেন্দ্র মোদি কোভিডের টিকা থেকে শুরু করে অক্সিজেনের ব্যবস্থা, টেস্ট করার কেন্দ্র ইত্যাদি সমস্ত ব্যাপারে যে চরম অপদার্থতার পরিচয়। দিয়েছেন, আদিত্যনাথরা সেই পথই অনুসরণ করে চলেছেন। এখন বিজেপি ব্যস্ত নরেন্দ্র মোদি সাহেবের ইমেজ যেন টোল না খায় তা দেখার কাজে। দেশের মানুষ মরুক, মোদি সাহেবের ভাবমূর্তি অটুট থাকলেই হবে।
এত বড় অপরাধমূলক কাজ যারা করে চলেছে দেশের মানুষ তাদের ক্ষমা করতে পারে না। একই সাথে বলতে হয়, এটাই আজ সংসদীয় গণতন্ত্রের আসল চিত্র। মানুষের ন্যূনতম মর্যাদা এই ব্যবস্থার কাণ্ডারিদের কাছে নেই। নরেন্দ্র মোদি, যোগী আদিত্যনাথরা তারই প্রতিনিধিত্ব করছেন।