মোদির ‘ডাবল ইঞ্জিন’ পিষে দিচ্ছে জনগণকে

ভোটে জিততে মরিয়া নরেন্দ্র মোদি প্রায় প্রতিদিন পশ্চিমবঙ্গ সফরে আসছেন। প্রতিটি সভাতেই তিনি ‘ডাবল ইঞ্জিন’ অর্থাৎ কেন্দ্র ও রাজ্যে একই দলের সরকার গড়ার ঢাক পেটাচ্ছেন। তাতে নাকি উন্নয়নের রথ বিপুল গতিতে চলবে, সমৃদ্ধির বান ডাকবে রাজ্যবাসীর জীবনে। উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ সহ আরও কয়েকটি রাজ্যে বেশ কিছুদিন ধরে ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি সরকার। প্রধানমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী, ডাবল ইঞ্জিনের জোরে কেমন চলছে সে সব রাজ্য? একবার দেখে নেওয়া যাক।

উত্তরপ্রদেশ

বেকারি ও ছাঁটাই

  • সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৮-র তুলনায় দেশের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার এই রাজ্যটিতে বেকারত্বের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
  • রাজ্যের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নিজেই গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি বিধানসভায় জানিয়েছেন, আগের দু’বছরে সাড়ে ১২ লক্ষ বেড়ে উত্তরপ্রদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা পৌঁছে গেছে ৩৪ লাখে (বিজনেস টুডে, ২৭-৩-২০)।

দারিদ্র ও ক্ষুধা

  • উত্তরপ্রদেশে জনসংখ্যার ২৯.৪৩ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন।
  • লকডাউনের পর রাজ্যের ৬২ শতাংশ পরিবারের আয় আগের তুলনায় অনেকটা কমে গেছে। মুসাহরি সহ পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন সংকটের চাপে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। মুরগির ফেলে দেওয়া পালক সংগ্রহ করে তা থেকে মাংস খুঁটে খেয়ে বেঁচে থাকে এই মানুষগুলি (কাউন্টারভিউ ১০-১২-২০)।

বিদ্বেষজাত অপরাধ

  • দলিত সম্প্রদায় সহ পিছিয়ে পড়া তথা প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষজনিত অপরাধের সংখ্যায় পর পর তিন বছর সর্বোচ্চ স্থানে উত্তরপ্রদেশ। শুধু ২০১৮ সালেই ২০০-র বেশি বিদ্বেষজাত অপরাধের ঘটনা ঘটেছে এই রাজ্যে (দ্য ফার্স্টপোস্ট, ৬-৩-১৯)।
  • সংখ্যালঘু ও দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর অত্যাচারের নিরিখে উত্তরপ্রদেশ সবচেয়ে এগিয়ে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তথ্য বলছে, ২০১৬-২০১৯– এই তিন বছরে গোটা দেশে এ ধরনের ২ হাজার ৮টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে এগুলির মধ্যে ৮৬৯টি ঘটনা, অর্থাৎ ৪৩ শতাংশ অপরাধই ঘটেছে উত্তরপ্রদেশে।
  • উত্তরপ্রদেশে দলিতদের হয়রানি করার ঘটনা ২০১৬-১৭ সালের তুলনায় ২০১৮-১৯ সালে ৪১ শতাংশ বেড়েছে। এ শুধু জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নথিভুক্ত ঘটনা। এর বাইরে যে আরও অসংখ্য ঘটনা আছে, তা বলাই বাহুল্য। সংসদে ২০২০-র ১৬ জুলাই স্বয়ং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই তথ্য দিয়েছেন।

মহিলাদের ওপর অত্যাচার

  • মহিলা ও শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যায় উত্তরপ্রদেশ শীর্ষে। (হিন্দুস্তান টাইমস, ৩-১০-২০)।
  • ২০১৬ থেকে ২০২০– এই চার বছরে উত্তরপ্রদেশে মহিলাদের ওপর অত্যাচার ৬৬ শতাংশ বেড়েছে।
  • শুধু ২০১৯ সালে উত্তরপ্রদেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ৬৫টি। (জি নিউজ, ৭-১০-২০)।
  • প্রতিদিন এ রাজ্যে ১১টি ধর্ষণের ঘটনা পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত হয়। বাস্তব সংখ্যা নিঃসন্দেহে আরও অনেক বেশি (ঐ)।
  • পণজনিত মৃত্যুর ঘটনায় শীর্ষে উত্তরপ্রদেশ। সংখ্যাটি হল ১১ হাজার ৮০০। (রেডিফ ডট কম, ৩১-১-১৯)।

আইনশৃঙ্খলা

  • হাথরস, উন্নাওয়ের যে ভয়াবহ ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় সারা দেশ শিউরে উঠেছে, তা বিজেপিশাসিত উত্তরপ্রদেশেই ঘটেছে।
  • ২০১৮ সালে উত্তরপ্রদেশে ২১ হাজার ৭১১টি অপহরণ, ৮ হাজার ৯০৮টি দাঙ্গা এবং ৩ হাজার ২১৮টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। গত কয়েক বছরে হিংস্র অপরাধের ঘটনা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে (হিন্দুস্তান টাইমস, ১০-১-২০)।

পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু ও ব্যাপক সংখ্যায় গ্রেফতারি

  • সংসদে সরকারের পেশ করা তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০-তে প্রতিদিন পুলিশ হেফাজতে গড়ে ৫ জন মানুষের মৃত্যু হয়। এই এক বছরে দেশে এ ভাবে মৃত্যু হয়েছে মোট ১৬৯৭ জনের। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে উত্তরপ্রদেশে। সেখানে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ৪০০ জনের। উত্তরপ্রদেশের ৭২টি জেলে বন্দির সংখ্যা ১ লক্ষ ১ হাজার ২৯৭। অথচ জেলগুলিতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে মাত্র ৬০ হাজার ৩৪০ জনের।

ভুয়ো সংঘর্ষ

  • সরকারে আসার পর বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ একটি টেলিভিশন-সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘অপরাধ করলে মেরে ফেলা হবে’। অর্থাৎ আইনের শাসনের বালাই নেই, গায়ের জোরই শেষ কথা। সম্ভবত তাঁর নির্দেশ মেনেই ২০১৭-র মার্চে উত্তরপ্রদেশে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২০ পর্যন্ত অভিযুক্তদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ৬ হাজার ১৪৫টি। মৃত্যু হয়েছে ১১৯ অভিযুক্তের। আহত হয়েছেন ২ হাজার ২৫৮ জন (স্ক্রোল ডট ইন, ২৩-৭-২০)।
  • ২০১৫ থেকে ২০১৮– এই তিন বছরে ভুয়ো সংঘর্ষের ঘটনায় গোটা দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেছে উত্তরপ্রদেশ (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১৫-৬-১৯)।

এসব ছাড়াও যোগী মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে উত্তরপ্রদেশে একের পর এক হত্যা, ধর্ষণ, নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের উপর হামলা, বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মী ও মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেফতার সহ অসংখ্য অপরাধের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। ঘটে চলেছে সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ ও তাঁদের মুখ বন্ধ করানোর অপচেষ্টা। এই পথেই উত্তরপ্রদেশে দুর্নীতি ও অপশাসনের অসংখ্য সত্য ঘটনা গোপন করার চেষ্টা করে চলেছে বিজেপি সরকার। এই রাজ্যেই বিজেপি সরকারের নির্দেশে মানবদরদী চিকিৎসক, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ কাফিল খানের ওপর নির্মম বর্বরতা চালিয়েছে পুলিশ-প্রশাসন। ঘটেছে একের পর এক পিটিয়ে খুন ও সাম্প্রদায়িক হানাহানির ঘটনা। চালু হয়েছে লাভ জিহাদ আইন, যাকে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি দীপক গুপ্তা সম্পূর্ণ সংবিধানবিরোধী বলে অভিহিত করেছেন। যে ডাবল ইঞ্জিনের হয়ে গলা ফাটিয়ে চলেছেন মোদি-শাহরা, তারই প্রভাবে উত্তরপ্রদেশে জনজীবন এভাবেই প্রতিনিয়ত বিপর্যস্ত, অবমানিত, দুর্দশাগ্রস্ত হচ্ছে। (চলবে)