২৪ এপ্রিল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর ৭৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। দেশব্যপী এখন নির্বাচনী প্রচার চলছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের একটি বত্তৃতার অংশবিশেষ এখানে প্রকাশ করা হল।
রাজনীতি করা একটা জিনিস, আর রাজনীতি সঠিক কি বেঠিক, সেটা বোঝবার চেষ্টা করা এবং সেই অনুযায়ী কোন রাজনৈতিক লাইন ধরে চলব তা ঠিক করা আর এক জিনিস। সেটা ঠিক করলেই কারওর রাজনীতি করতে হয় না। অথচ সেটা ঠিক না করলে কোনও লড়াই, কোনও মানবিক লড়াই আজকের দিনে হতে পারে না, কোনও সংগঠনই দানা বাঁধতে পারে না। ফলে এ দুটো জিনিস তাদের কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার। তাদের বলা দরকার, এত ভয় পাচ্ছ কেন? পার্টি পলিটিক্সের কথা শুনলে এত ভয় পেয়ে যাও কেন? জোর করে কাউকে পার্টি করানো যায় কি? বিপ্লবী পার্টি তো করানো যায়ই না। যতক্ষণ না বুঝছ, তোমার উদ্বিগ্ন হবারও প্রয়োজন নেই, দরকারও নেই। কিন্তু একটি জিনিস অবশ্যই দরকার, তা হল, রাজনীতি তোমাকে বুঝতেই হবে। তুমি যদি বল, না, না, রাজনীতি বোঝবার দরকার নেই, তা হলে তুমি না বুঝলেও, রাজনৈতিক স্থিতি এবং চিন্তাভাবনা, যা ভুল, তা যদি দেশে চলতে থাকে এবং তার প্রভাব যদি বাড়তে থাকে তা হলে, যে তুমি রাজনীতি থেকে গা বাঁচাতে চাইছ, সেই তুমি তোমার চিন্তা-ভাবনা, রুচি, সংস্কৃতি, পরিবার এমনকী যে সংগঠনটি তোমরা এখানে খাড়া করতে চাও, সে সবই তো সেই ভুল রাজনীতির প্রভাবে বরবাদ হয়ে যাবে। তাকে তুমি রক্ষা করতে পারবে? এভরি মুভমেন্ট ইজ ইনফ্লুয়েন্সড বাই পলিটি’, প্রতিটি আন্দোলনই রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত। তার প্রভাব থেকে খাদ্য থেকে শুরু করে সব কিছু, মেডিসিন পর্যন্ত মুক্ত নয়– আপনি নিজেকে আলাদা রাখবেন কী করে? ইউ আর এ সোস্যাল বিয়িং (আপনি সামাজিক সত্তাবিশিষ্ট মানুষ)। সংগঠনের কথা তো বহু দূর, এর একটি ব্যক্তি মানসিকতা পর্যন্তও তার থেকে মুক্ত রাখার উপায় নেই। আপনি ভাবতে পারেন, আমি আলাদা থাকব, এ সম্পর্কে আপনি অনবহিত থাকতে পারেন। আপনার চিন্তা-ভাবনা এরকম থাকতে পারে যে, আমি কারওর সঙ্গে, কারওর সংস্পর্শে নেই। এর মানে হল আপনি অনবহিত। আপনি জানেন না কীভাবে আপনি সমাজের সঙ্গে প্রতিনিয়তই সম্পর্কিত হচ্ছেন, কীভাবে বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ আপনার মানসিকতার উপর প্রভাব বিস্তার করছে, আপনার সংগঠনের মানসিকতার উপর প্রভাব বিস্তার করছে, সংগঠন পরিচালনার কায়দার উপর প্রভাব বিস্তার করছে। এই যেটাকে বলছেন, স্টাইল অব অর্গানাইজেশন, সংগঠন পরিচালনার পদ্ধতি বা কৌশল, এই স্টাইল অব অর্গানাইজেশন কথাটার মধ্যেও বুর্জোয়া ভাবনা-ধারণা, প্রোলেটারিয়েটের বিপ্লবী ভাবনা-ধারণা প্রতিফলিত হয়।
যেমন ধরুন একটা ইলেকশন এসে গেছে, তার লড়াই লড়বেন। আপনি ভাবছেন– এটা নির্বাচন, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়ছেন, এর মধ্যে আবার বিপ্লবী রাজনীতির কী আছে? আপনার ধারণা হচ্ছে, কংগ্রেসকে পরাস্ত করার যে কোনও কৌশলটাই বিপ্লবী। না, তা নয়। ইলেকশনে কংগ্রেস একটা পক্ষ, বিপক্ষ দল আর একটা পক্ষ, তার মধ্যে জনসাধারণ এসে যাচ্ছে।
যতদিন বিপ্লব না হয়, জনতা ইলেকশন চাক বা না চাক, পছন্দ করুক আর নাই করুক, ভাল লাগুক, মন্দ লাগুক, জনতাকে টেনে আনা হয়, জনতা এসে যায়। বিপ্লব মানে হল, যখন জনতা বুঝে ফেলেছে ইলেকশনের প্রয়োজনীয়তা নেই, যখন সকলে এই চেতনার ভিত্তিতে সংগঠিত হয়ে গেছে এবং সংগঠিত ভাবে ইলেকশন বর্জন করছে, নেগেটিভলি বর্জন করছে না, পজিটিভলি তারা গণঅভ্যুত্থান করার জায়গায় চলে গেছে, যখন সে বলে, না ইলেকশন নয়, ক্ষমতা দখল, তখনই একমাত্র ইলেকশন অকার্যকরী হতে পারে, না হলে ইলেকশনে জনতা বার বার ফেঁসে যায়। আর জনতার সঙ্গে থাকবার জন্য বিপ্লবী হোক, অবিপ্লবী হোক সকলকেই ইলেকশনে যেতে হয়, সত্যিকারের বিপ্লবীকেও যেতে হয়। শুধু ঐসব সেকটেরিয়ান ট্রুইজম-এর চর্চা যারা করে, যারা বিপ্লবের চর্চা করে না, তারা গা বাঁচায়, না হলে সকলকেই যেতে হয়। তা হলে গেলে সকলের কি দৃষ্টিভঙ্গি এক হবে? ইলেকশন তো সকলেই করছে, বাইরের দিক থেকে দেখলে, আমি করছি, বিপ্লবী লেনিনবাদীরা করছি, সোস্যাল ডেমোক্র্যাটরাও করছে, খাঁটিরাও করছে, মেকিরাও করছে, বুর্জোয়ারাও করছে, মেকি সমাজতন্ত্রীরাও করছে। আর সকলেরই কথা হবে আমি ঠিক, বিপক্ষ দল বেঠিক। তা হলে বিপক্ষ দলকে হারাবার জন্য যে কোনও কৌশলটাই হচ্ছে সঠিক, কারণ আমি সঠিক। এইভাবে যদি আপনি যুক্তি করতে থাকেন, তা হলে বুর্জোয়া আর আপনার মধ্যে কোনও শ্রেণিগত পার্থক্য থাকে না, দৃষ্টিভঙ্গিরও পার্থক্য থাকে না, অথচ গভীর বিচার-বিশ্লেষণে এটা ভুল প্রমাণ হয়।
আসলে বুর্জোয়া আর প্রোলেটারিয়েট এ দু’জনেরই লড়াইয়ের কলা-কৌশল, কায়দা, সংগঠন পদ্ধতি, ইলেকশন সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গি, জেতা-হারার কলা-কৌশলটি ঠিক করাও দেশের বাস্তব বিপ্লবী আন্দোলন, গণচেতনার স্তরের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হয়। বুর্জোয়ার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে যেন তেন প্রকারেণ সর্বোচ্চ সংখ্যক নির্বাচনী আসন দখল করা এবং করে ক্ষমতায় যাওয়া। ক্ষমতায় গিয়ে নানা রিফর্মস (সংস্কারমূলক কাজ) করে, নানা স্লোগান তুলে এই এগজিসটিং সিস্টেম-কেই (বর্তমান ব্যবস্থা) টিঁকিয়ে রাখা। যেমন করে বললে আমি জনতার মধ্যে প্রগতিশীল সেজে কিছুদিন তাকে বিভ্রান্ত করতে পারি, বোকা বানাতে পারি এবং এই ব্যবস্থাটাকেই দীর্ঘস্থায়ী করতে পারি– এ হল তাদের উদ্দেশ্য। তা হলে তার মূল লক্ষ্য হয়, যেভাবেই হোক সর্বাধিক নির্বাচনী আসন দখল কর। এটা ছাড়া রাজনৈতিক কর্মসূচি, আশু কর্মসূচি এগুলোও সে দেয়। এই প্রোগ্রাম ও স্লোগান তাদের যাই হোক, তাদের মূল কথা হচ্ছে, গ্র্যাব ম্যাক্সিমাম সিটস।
আর বিপ্লবী উদ্দেশ্যমুখীনতার লক্ষ্য থেকে প্রোলেটারিয়েট যখন অনন্যোপায় হয়ে জনতার সঙ্গে থাকার জন্য নির্বাচনী লড়াইয়ে যায়, তখন সে একটা জনতার বিপ্লবী রাজনৈতিক লাইনের ভিত্তিতে যায়। সিট জেতবার জন্য সেও চেষ্টা করে সাধ্যমতো। কিন্তু তার উদ্দেশ্যের কেন্দ্রবিন্দুটা কখনই যেভাবেই হোক সর্বাধিক আসন দখল করা হয় না। তার মেইন ফোকাল পয়েন্টটা হয়, পিপলকে, জনতাকে, একটা মাস রেভোলিউশনারি লাইনের (জনতার বিপ্লবী রাজনৈতিক লাইনের) ভিত্তিতে ইলেকশন লড়াই করতে শেখানো এবং এইটা করতে গিয়ে ম্যাক্সিমাম সিট পাই পাব, যদি না পাই, একটাও না পাই, না পাব। যদি দশটা রক্ষা করতে পারি, দশটাই করব, কিন্তু তার সেন্ট্রাল ফোকাল পয়েন্ট কখনই হবে না– যে কোনও উপায়ে কতকগুলো সিট দখল করা।
জনতার সেই বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগ্রামের পদ্ধতিটি কী, যেটা ইলেকশনে জনসাধারণের কাছে আমি নিয়ে যাব? জনতার মধ্যে আমি যাব এই কথা নিয়ে– তুমি যখন ইলেকশন করছই তখন পিপলের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তোমাকে বিপ্লবী রাজনীতির ভিত্তিতে ইলেকশন করতে হবে। সেটা করতে গিয়ে তোমার নিজের ঘাঁটিগুলি তুমি নিজে সামাল দাও। যে কয়টা সিট পাও, যতগুলো ম্যাক্সিমাম পার, এমনকী যদি সব সিটই জিততে পার, এর ভিত্তিতে এই লাইনের ভিত্তিতেই জেত। কিন্তু একমাত্র এর ভিত্তিতেই, এটাকে গোলমাল করে দিয়ে নয়। শত্রুকে হারাবার জন্য যা দরকার তাই কর– এসব যুক্তি যদি তুমি তোল, আর বিপ্লবী তকমা এঁটে তোল, তা হলে কিন্তু বুর্জোয়ারা যেভাবে ইলেকশন ফাইট করে, তুমিও আসলে সেই কৌশলটি, সেই কায়দাটি এবং সেই একই ট্যাকটি’টাকেই বিপ্লবের নামে চালু করার চেষ্টা করবে। এতে কি বিপ্লবী হওয়া যায়? এর দ্বারা কি বিপ্লবের কাজ এগোয়? না, এতে বিপ্লবী হওয়া যায় না এবং এর দ্বারা বিপ্লবী কাজও এগোয় না। এর ফলে, আমরা যে বলি ইলেকশনের মধ্য দিয়ে বুর্জোয়া পার্লামেন্টারি পলিটিক্সকে এক্সপোজ করব, তা হয় কি? এই কথাটা মুখে বলা আর কাজে করা এক জিনিস নাকি? একদল শুধু মুখে বলে, আর একদল বাস্তবে করে। কাজেই কারা এটা শুধু মৌখিকভাবে বলছে, আর কারা প্রকৃতই সেই অনুযায়ী কাজ করছে, এ সম্পর্কে পিপলকে, জনতাকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করাটাই হল আসল জিনিস।
যেমন আন্দোলনের ক্ষেত্রে ঐক্যের কথা সকলেই বলছে, কিন্তু কে শুধু বলছে আর কে ঐক্যের জন্য যা যা করা দরকার সেই অনুযায়ী কাজ পারুক না পারুক করছে, সেটা জনসাধারণকে দেখান। দেখান আর একদল ঐক্যের কথা বলছে কিন্তু বাস্তবে করছে যা, সেটি ঐক্য বিনষ্ট করা ছাড়া আর কিছু নয়। আর জনসাধারণকে এ কথাটি বোঝান, দুটো জিনিসের জন্যই ঐক্য তোমার দরকার। নিজের সংগঠনকে জোরদার করার জন্য ঐক্য দরকার, আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য ঐক্য দরকার। আবার ঐক্য দরকার বিপ্লবী রাজনীতিকে পরিষ্কার করার জন্য, মেকি রাজনীতি থেকে মোহমুক্তি ঘটাবার জন্য।
সমাজে মোহমুক্তি ঘটাবার প্ল্যাটফর্ম অব অ্যাকশন দরকার, ফলে ঐক্য দরকার। কিন্তু এই ঐক্য নীতি বিসর্জন দিয়ে নয়, সংগ্রাম বর্জন করে নয়। ঐক্যের মধ্যে আদর্শের সংগ্রামের স্বীকৃতি চাই। যারাই ঐক্যের মধ্যে আদর্শের সংগ্রামকে ঐক্যবিরোধী কাজ বলে তারাই শেষ পর্যন্ত ঐক্য নষ্ট করে। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের দোহাই দিয়ে আদর্শ কমপ্রোমাইজ করলে সে ঐক্য থাকে না। সে ঐক্যের একটিই মানে– আদর্শ বিসর্জন দিয়ে কোনও একজনের পদলেহন করা। তা না হলে, ঐক্যের মধ্যে যে সংগ্রাম রয়েছে, সেটিকে জনতার সামনে তুলে ধরতে হবে। সেটিকে তুলে ধরে ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত উদ্যোগ নিয়ে আর স্বচ্ছ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আপনাদের গণসংযোগ বাড়িয়ে যেতে হবে, পিপলস ইনস্ট্রুমেন্ট অব স্ট্রাগল, জনতার নিজস্ব লড়াইয়ের হাতিয়ার গড়ে তুলতে হবে, আর তারই মধ্য দিয়ে পিপলস পলিটিক্যাল পাওয়ার, জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। এ যদি করে যেতে পারেন তবে বিপ্লব একদিন আসবেই, ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম কেউই ঠেকাতে পারবে না, আপনাদের ইনকিলাবের স্বপ্ন একদিন সফল হবেই।