ঢালাও প্রতিশ্রুতি বিলি করার বেলায় ভোটবাজ দলগুলির নেতানেত্রীদের যে পরিমাণ উৎসাহ-উদ্যম দেখা যায়, সেগুলি বাস্তবায়িত করার বেলায় চোখে পড়ে ততটাই উদাসীনতা ও নিষ্ক্রিয়তা।
প্রথম দফায় সরকারে বসে নরেন্দ্র মোদি বিরাট ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ‘প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনা’-র কথা ঘোষণা করেছিলেন। বলেছিলেন, দারিদ্রসীমার নিচে থাকা পরিবারগুলিকে এবার থেকে বিনামূল্যে রান্নার গ্যাসের সংযোগ দেবে সরকার। কাঠ বা কয়লা জ্বালিয়ে রান্না করতে গিয়ে ধোঁয়ার কষ্ট আর পেতে হবে না মহিলাদের। শহর ছেয়ে ফেলা বিজ্ঞাপনের বিশাল বিশাল হোর্ডিং ঝলমল করে উঠেছিল প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়ানো হাস্যমুখ দরিদ্র মহিলাদের ছবিতে। প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে বহু মানুষ গ্যাসের ভরতুকি ছেড়ে দিয়েছিলেন সেই সময়। নানা প্রচারমাধ্যমে উজ্জ্বলা যোজনার জোরালো প্রচার করতে গিয়ে খরচও হয়ে গিয়েছিল কয়েকশো কোটি টাকা। কিন্তু ‘সাত মণ তেলও পুড়ল, রাধা নাচল না’। রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও মধ্যপ্রদেশে ‘রিসার্চ ইন্সটিটিউট অফ কমপ্যাশনেট ইকনমি”-এর ২০১৮-তে করা একটি সমীক্ষায় বেরিয়ে এল, এই যোজনার অন্তর্ভুক্ত ১০০টি পরিবারের মধ্যে ৮৫টিই এক সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করার পরেই আবার ফিরে গেছে সাবেক কাঠ কিংবা কয়লার চুল্লিতেই। সিলিন্ডার সরবরাহকারীদের থেকে পাওয়া গেছে এই তথ্য। সংখ্যাটা এতদিনে নিশ্চিতভাবেই আরও বেড়েছে। অর্থাৎ সম্পূর্ণ মুখ থুবড়ে পড়েছে উজ্জ্বলা যোজনা।
কিন্তু গ্যাসের উনুন থাকতেও শ্বাসকষ্ট সহ্য করে জ্বালা করা চোখ জোর করে খুলে রেখে কাঠের আগুনে আবার কেন রান্না করছেন মহিলারা? তাঁরা নিরুপায়। সরকারি দাক্ষিণ্যে গ্যাস মিলেছিল তো ওই একবারই! পরের বার থেকে সিলিন্ডার নিতে হবে নগদ দামে। যোজনা শুরুর সময়ে ২০১৬ সালে গ্যাসের যে সিলিন্ডারের দাম ছিল ৪২১ টাকার আশপাশে, এখন তার দাম প্রায় ৯০০ টাকা। গত ফেব্রুয়ারিতে তিন দফায় গ্যাসের দাম ১০০ টাকা বেড়েছে। তার আগে দু’দফায় বেড়েছিল ১০০ টাকা। মার্চে বেড়েছে আরও ২৫ টাকা। এসবের আগেই গ্রাহকদের কিচ্ছু না জানিয়ে চুপিসারে কার্যত তুলে দেওয়া হয়েছিল ভরতুকি। এখন গ্যাস নিলে গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে ভরতুকির নামে ভিক্ষা দেওয়ার মতো করে ছুঁড়ে দেওয়া ১৯ টাকা ৫৭ পয়সা। বাস্তবে ভরতুকিযুক্ত ও ভরতুকিবিহীন গ্যাস গ্রাহকদের মধ্যে কোনও ফারাকই আজ আর নেই। দু’বেলা পেট ভরা খাবার জোটাতেই যে মানুষগুলির প্রাণান্ত, কোথায় পাবেন তাঁরা সিলিন্ডার নেওয়ার বিপুল টাকা? ফলে কাঠকুটো জোগাড় করে কোনও রকমে দু’মুঠো ফুটিয়ে নেওয়া ছাড়া অন্য গতি নেই উজ্জ্বলা যোজনার মহিলাদের।
এমনিতেই মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারির তীব্রতায় বেহাল দশা মানুষের। তার ওপর অতিমারির ধাক্কা সামলাতে প্রাণান্তকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন তাঁরা। এই পরিস্থিতিতে বিন্দুমাত্র জনদরদ থাকলে একটি সরকারের কী করা উচিত ছিল? উচিত ছিল আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই না পেড়ে পেট্রোপণ্য, বিশেষত উজ্জ্বলা যোজনার গ্রাহকদের জন্য গ্যাসে ভরতুকির ব্যবস্থা করা, নিম্ন আয়ের মানুষকে কিছুটা সুরাহা দেওয়া। কিন্তু দয়ালু নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্রীয় সরকার একচেটিয়া পুঁজিপতিদের দেদার ভরতুকির ব্যবস্থা করলেও সাধারণ মানুষের জন্য গ্যাস সহ পেট্রোপণ্যের ওপর থেকে ভরতুকি ছাঁটাইয়ের পরিমাণ বাড়িয়েই চলেছে।
কিন্তু সামনে যে ভোট! আবার তো ফাঁপা প্রতিশ্রুতিতে ভোলাতে হবে মানুষকে! তাই ফেব্রুয়ারির বাজেটে আবারও বিরাট ঘোষণা মোদি সরকারের। বলা হয়েছে উজ্জ্বলা গ্যাস প্রাপকের সংখ্যা বাড়ানো হবে আরও ১ কোটি! ধন্য ধন্য শুরু করে দিয়েছে ভক্তবৃন্দের দল। সেই ঘোষণা শুনে হয়ত ছেঁড়া আচলে কপালের ঘাম মুুছে কুড়ানো কাঠের বোঝাটা শক্ত করে চেপে ধরেছেন সেই মহিলা– হোর্ডিংয়ের বিজ্ঞাপনে যাঁর হাসিমুখ এখনও জ্বলজ্বল করছে নরেন্দ্র মোদির ছবির পাশে।