২০০৭ সালের ১৪ মার্চ, নন্দীগ্রামের মাটি ভিজেছিল ১৪ জন শহিদের রক্তে। রক্ত দেব, জান দেব, জমি দেব না– গরিব চাষি, সহ সর্বস্তরের খেটে খাওয়া মানুষের দৃঢ় প্রতিরোধে পিছু হটেছিল গর্বোদ্ধত সিপিএম সরকারের পুলিশ। সেদিন সিপিএম সরকার এবং তার দলীয় মদতপুষ্ট দুষ্কৃতী বাহিনীর নৃশংসতা দেখে শিউরে উঠেছিল গোটা ভারত শুধু নয়, গোটা বিশ্বের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। আন্দোলন ভাঙতে শুধু গুলি চালনা নয়, পুলিশের পোশাক পরিয়ে দলীয় বাহিনীকে গণধর্ষণের কাজে সেদিন নামিয়েছিল সিপিএম। নন্দীগ্রাম লড়েছিল একদিন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের বিরুদ্ধেও। রক্ত দিয়েছিল, প্রাণ দিয়েছিল। সেই ব্রিটিশ সরকারও বোধহয় এ ভাবে আন্দোলন ভাঙার কথা ভেবে উঠতে পারেনি।
সেদিন সিপিএম সরকার ঘোষণা করেছিল, নন্দীগ্রামের ৪০ হাজার একর জমি নিয়ে গড়ে উঠবে ইন্দোনেশিয়ার কুখ্যাত সালেম শিল্পগোষ্ঠীর কেমিক্যাল হাব। যা হবে একটি স্পেশাল ইকনমিক জোন (এসইজেড)। এসইজেডকে বলা হয় দেশের মধ্যেই একটি ‘বিদেশি অঞ্চল’। যেখানে লগ্নি করা বৃহৎ পুঁজিপতিদের দেশের কর সংক্রান্ত আইন মানতে হয় না। নামমাত্র বা একেবারে কর না দিয়েই তারা বিপুল মুনাফা করতে পারে। এসইজেডে শিল্পপতিদের মানতে হয় না কোনও শ্রম আইন। মারাত্মক শিল্প দুর্ঘটনাতেও পুঁজি মালিকদের নিতে হয় না কোনও দায়। দেশে দেশে একচেটিয়া কর্পোরেট পুঁজি স্থাপিত এমন এসইজেড-কে শ্রমিকরা চিহ্নিত করেছেন মানব শ্রমকে নিংড়ে নেওয়ার বধ্যভূমি হিসাবে। আর্থিক বিকাশ আর শিল্পায়নের নামে ২০০০ সালে এই সর্বনাশা স্কিম এনেছিল তৎকালীন বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার। ২০০৫ সালে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় সরকার তাকে আইনি রূপ দেয়। সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ, বিশেষত বামপন্থীদের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও বামপন্থী নামধারী সিপিএম সরকার পশ্চিমবঙ্গে একচেটিয়া মালিকদের আশীর্বাদ পেতে নন্দীগ্রামের কয়েক লক্ষ মানুষের বাসস্থান সহ সমগ্র পরিবেশকে ধ্বংস করে এমনই এক এসইজেড গড়ে তুলতে চেয়েছিল।
সিপিএম সরকার ভুলে গিয়েছিল এই নন্দীগ্রামের মাটি বারবার ভিজেছে আন্দোলনকারীদের রক্তে। যে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনকে আজকের বিজেপির অভিভাবক আরএসএস এবং পূর্বসূরী হিন্দুমহাসভা প্রতিক্রিয়াশীল বলে অভিহিত করেছিল নন্দীগ্রাম ছিল তার অন্যতম ঘাঁটি। যে ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে দমন করার জন্য বিজেপির আজকের আইকন, হিন্দুমহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ব্রিটিশের সেনা বাহিনীকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন, আন্দোলনকে অর্থহীন উচ্ছৃঙ্খলতা বলেছিলেন, নন্দীগ্রামের মাটি সেই আন্দোলনের শহিদদের রক্তেও ভেজা। পরবর্তীকালে তেভাগা আন্দোলনে ক্ষুদ্র কৃষক, ভাগচাষি, খেতমজুরদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইতে রক্ত ঝরিয়েছে নন্দীগ্রাম। ১৯৮২ সালে এলাকার মানুষ লড়েছে নন্দীগ্রামের উন্নয়নের দাবি নিয়ে। যে আন্দোলনে সিপিএম সরকারের পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন ছাত্র শহিদ সুদীপ্ত তেওয়ারি। সংগ্রামী চেতনা আর নন্দীগ্রাম দুটি নাম উচ্চারিত হয়ে থাকে এক নিঃশ্বাসে।
এই নন্দীগ্রামে ভোটের প্রচারে গিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি, সিপিএম-কংগ্রেস-আব্বাস জোট শোনাচ্ছে তাদের তথাকথিত উন্নয়নের গল্প। ক’দিন আগেও যিনি ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা, সেই শুভেন্দু অধিকারী এখন বিজেপির প্রার্থী। তিনি এখন নাকি নন্দীগ্রামের শহিদদের স্মরণ করছেন! অথচ যে দলে তিনি ভিড়েছেন, সেই বিজেপিই এসইজেডের হোতা। যে নীতির হাত ধরেই নন্দীগ্রামের জমি কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত শুরু করে সে সময় কেন্দ্রীয় সরকারে থাকা কংগ্রেস আর রাজ্যের গদিতে থাকা সিপিএম। নন্দীগ্রাম যখন লড়ছে এসইজেডের বিরুদ্ধে, বিজেপির ভূমিকা তখন কী ছিল? বিজেপি এই আন্দোলনে অংশ নেয়নি শুধু নয়, তাদের নীতিই ছিল জমি দখলের পক্ষে। বর্তমান নরেন্দ্র মোদি সরকারের জমি নীতি হল, পুঁজিপতিরা চাইলেই যেখানে খুশি যখন খুশি গায়ের জোরে হলেও সরকার তাদের জমি দিয়ে দেবে। চাষির কথা শোনার সুযোগ কেন্দ্রীয় আইনে নেই বললেই চলে। তাদের নীতি তখনও তাই ছিল। এখন শুভেন্দুবাবু বলছেন বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানির জন্যই নাকি নন্দীগ্রামের মানুষ বেঁচে গেছে! অথচ আদবানি সাহেব ঘোলা জলে মাছ ধরতে সে সময় নন্দীগ্রামে এসেছিলেন বটে, কিন্তু এলাকার মানুষের মূল দাবির প্রতি কোনও সমর্থন জানাননি। নন্দীগ্রামের জমি যে সংগ্রামী মানুষ জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে রক্ষা করেছে, যে মা-বোনেরা ধর্ষিতা হয়েও আন্দোলন ছেড়ে যাননি, তাঁরা কোনও নেতার ভোট কেরিয়ার গোছানোর জন্য আন্দোলন করেননি।
নন্দীগ্রামের মানুষ জানে, রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রথম এই লড়াই শুরু করেছে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)। আন্দোলনকে ব্যাপকতর রূপ দেওয়ার জন্য এই দলের উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল ‘ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’। তাতে সামিল হন এলাকার সমস্ত সাধারণ মানুষ। তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় কর্মীরাও কমিটির নেতৃত্বে আন্দোলনে আসেন। এই কমিটির তিনজন আহ্বায়কের মধ্যে দু’জন (নন্দ পাত্র, ভবানী দাস) ছিলেন এস ইউ সি আই (সি)-র, একজন তৃণমূলের (সেখ সুফিয়ান)। আন্দোলন ২০০৬-এর শেষভাগ থেকে শুরু হলেও তৃণমূলের রাজ্য স্তরের নেতারা নন্দীগ্রাম যেতে শুরু করেন ২০০৭-এর ১৪ মার্চের ঘটনার পর।
নন্দীগ্রাম সেদিন কোনও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে তার মাটিতে জায়গা দেয়নি। সিপিএম সে সময় কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকারের সাহায্যে দিল্লির ইমাম বুখারিকে নন্দীগ্রামে হাজির করেছিল মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষকে প্রভাবিত করতে। কিন্তু এলাকার মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষই তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, সংগ্রামের মাটিকে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় বিভেদ দিয়ে কলুষিত করতে কিছুতেই তাঁরা দেবেন না। বিজেপি নেতারাও একইভাবে হিন্দুত্ববাদের ঝান্ডা তুলতে নন্দীগ্রামে ব্যর্থ হয়েছিলেন। আন্দোলনের ময়দানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রক্ত ঝরিয়েছেন যে মানুষ তাঁরা হিন্দু না মুসলিম– এ প্রশ্ন কোনও দিন তুলতেই দেয়নি নন্দীগ্রামের সংগ্রামী জনসাধারণ। মন্দিরের ঘন্টা বেজেছে, মসজিদে আজান হয়েছে, ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ যে যার ধর্ম পালন করেছেন। বিভেদ হয়নি। আজ ভোটের বাজার গরম করার জন্য তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপিতে প্রতিযোগিতা চলছে মন্দিরে মন্দিরে ঘোরার। আখের গোছানোর রাজনীতিতে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া শুভেন্দু অধিকারী দেখাতে চাইছেন তিনি কতবড় হিন্দু! তিনি আসল হিন্দু কে এই নিয়ে বড় বড় ভাষণ দিচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ও প্রার্থী হয়েই ছুটেছিলেন একই কায়দার প্রচারের পিছনে। দুই দলই সংকীর্ণ ভোট রাজনীতি করতে গিয়ে নন্দীগ্রামের লড়াইকে আজ কালিমালিপ্ত করছে।
দিল্লির ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের ময়দানেও নন্দীগ্রাম এবং সিঙ্গুরের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে। আর এই আন্দোলনকে সিপিএম এবং বিজেপি বলছে ভুল। এ তো জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনের শহিদদের প্রতি অশ্রদ্ধা! নন্দীগ্রাম কি ভুলে যাবে তার সেই লড়াইয়ের কথা? মানুষের আত্মত্যাগকে কি ভোট রাজনীতির আখের গোছানোর হাতিয়ারে পরিণত হতে দেবেন তাঁরা? এই প্রশ্ন গণদাবী উপস্থিত করেছিল ১১ মার্চ নন্দীগ্রাম বাজারের দোকানদার, গৃহবধূ, শিক্ষক সহ নানা স্তরের সাধারণ মানুষের কাছে। বিধানসভা নির্বাচনে ওই কেন্দ্রের এস ইউ সি আই (সি) প্রার্থী কমরেড মনোজ দাসের সমর্থনে পথসভা এবং মিছিল সবে শেষ হয়েছে। বাজারের চায়ের দোকানদার বিভাস জানা স্মরণ করলেন, নন্দীগ্রাম রেলপ্রকল্প সম্পূর্ণ করার আন্দোলনের কথা। বললেন, শুধু এই আন্দোলন নয়, হলদিয়া পর্যন্ত পাকা রাস্তা, জেটি তৈরির আন্দোলনে এলাকার মানুষ এস ইউ সি আই (সি)-র ভূমিকা ভুলতে পারবে না। হাসপাতালের উন্নয়ন থেকে শুরু করে আমপান ঝড়ে ক্ষতিপূরণ নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এই দলই থেকেছে এলাকার মানুষের পাশে। গোপীমোহনপুর থেকে বাজার করতে আসা গৃহবধূ মমেনা বিবি জানালেন, বিপদের দিনে পাওয়া যায় এই দলটাকেই। এনআরসির বিরুদ্ধে আন্দোলনে, রেশন দুর্নীতি, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, লোডশেডিং, লো-ভোল্টেজের বিরুদ্ধে নন্দীগ্রামের মাটিতে এদেরই লড়তে দেখেছি। আসাদতলার মোটরভ্যান চালক বাপি শীট মনে করেন, এই দলটা না থাকলে তাঁরা গাড়িই চালাতে পারতেন না। কোনও বড় দলকে দেখা যায়নি মোটরভ্যান চালকদের আন্দোলনের পাশে। গড়চক্রবেড়িয়ার বাসিন্দা পরিযায়ী শ্রমিক সেখ সমসের লকডাউনের সময় থেকে কাজ হারিয়ে বসে আছেন। তিনি বললেন, সেই দুঃসময়ে ত্রাণের হাত বাড়িয়েছে এই দলটাই। বিডিও অফিসে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে গিয়ে ত্রাণের তালিকায় নাম তুলিয়েছে, আন্দোলন করেছে।
জমি রক্ষার আন্দোলনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নাম সোনাচূড়া ভাঙাবেড়া। সেখানে দেখা হল জমিরক্ষা আন্দোলনের কর্মী, পেশায় শিক্ষক তপন মান্নার সাথে। তাঁর কথায়, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলে এই দলটার নামই মনে পড়ে। সম্প্রতি কলকাতার ম্যানহোলে নেমে ছয়জন শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর প্রতিবাদ এই দলটিই করেছে। ভোটেও এই দলেরই পাশে থাকবেন তিনি–জানালেন তপনবাবু।
সংবাদমাধ্যমের ডামাডোল যে প্রার্থীদের ঘিরে, নন্দীগ্রাম তার অভিজ্ঞতা থেকে জানে, ভোট শেষ হলে তাঁদের দেখা যাবে টিভির পর্দায়। এলাকায় পা দিলেও বিশাল বিশাল মঞ্চের উচ্চতায় বসে ভাষণ দেবেন তাঁরা। আর মাটিতে দাঁড়িয়ে লড়বে এস ইউ সি আই (সি)। গড়ে তুলবে গণকমিটি। এই লড়াইয়ের সাথীকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারলেই যে তাঁদের প্রকৃত জয় সে কথা অনেক ডামাডোলেও হারিয়ে যায়নি নন্দীগ্রামের মানুষের মন থেকে।