২০২০ সালের ২৩ – ২৯ ফেব্রুয়ারি পূর্ব দিল্লি জুড়ে কার্যত গণহত্যা চলেছিল। ৫৩ জন নিহত হয়েছিলেন, গুরুতর আহত হয়েছিলেন দুশোরও বেশি। বহু মানুষ চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। সেই ঘটনায় শত শত দোকান, ঘরবাড়ি আগুনে পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে। সর্বস্ব হারিয়েছে অসংখ্য পরিবার। যে বাহিনীর হাত ধরে এই নারকীয় ঘটনা ঘটল এবং যে নেতারা তাতে নেতৃত্ব দিলেন এক বছর পার করেও তাদের কাউকেই নাকি চিহ্নিত করে উঠতে পারেনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পুলিশ!
দিল্লির সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে যাঁর জ্বালাময়ী ভাষণ দাঙ্গায় উস্কানি দিয়েছিল বলে অভিযোগ, বিজেপির সেই নেতা কপিল মিশ্রের বিরুদ্ধে পুলিশ কোনও পদক্ষেপ করার ইচ্ছাই দেখায়নি। ‘গোলি মারো’ বলে উত্তেজক স্লোগান যিনি দিয়েছিলেন, তাঁকেও পুলিশ যথারীতি দাঙ্গার উস্কানিদাতা হিসাবে চিহ্নিত করতে পারেনি। এক বছর ধরে দিল্লি পুলিশ কার্যত কোনও তদন্তই করে উঠতে পারেনি। একই সাথে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় এবং জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা তাণ্ডব চালিয়েছিল, আরএসএস-বিজেপির সেই দুষ্কৃতী বাহিনীর বিরুদ্ধেও কিছু করে উঠতে পারেনি পুলিশ। অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যকলাপ দেখলে দেশের মানুষের এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। দিল্লি পুলিশ সহ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণে থাকা দফতরগুলি সরকার বিরোধী প্রতিবাদকারীদের নানা মামলায় ফাঁসাতে এতটাই ব্যস্ত হয়ে রয়েছে যে, বাকি কাজ করে ওঠার সময় তাদের পাওয়াটাই আশ্চর্যের বিষয়।
যেটুকু চার্জশিট তারা জমা দিয়েছে তাতেও বিপুল পরিমাণে ভুল, বিশেষ বিশেষ অভিযুক্তের ক্ষেত্রে কোনও তদন্ত শুরুই করতে পারেনি তারা। অথচ দাঙ্গার অভিযোগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বেশ কিছু মানুষকে শাস্তি দিতে তারা তৎপর। এমনকি দিল্লির একটি আদালত পর্যন্ত তিনজন এমনই অভিযুক্তকে জামিন দিতে গিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছে, দিল্লি দাঙ্গায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেরাই নিজেদের লোককে হত্যা করেছে– পুলিশের এই যুক্তি মেনে নেওয়া যায় না। পুলিশের তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করেছে আদালত। সব মিলিয়ে একটা বিষয় পরিষ্কার, দিল্লি পুলিশ আদৌ তদন্তটা করতে চায়নি। তারা যে বিশেষ বিশেষ লোক, সুনির্দিষ্ট করে বললে, দাঙ্গায় উস্কানিদাতা বিজেপি নেতাদের আড়াল করতেই সর্বশক্তি ব্যয় করেছে সেটা স্পষ্ট।
ভারতের মতো দেশে পুলিশ-মিলিটারি সহ সরকারি বাহিনীগুলি জনগণের পয়সায় যতই বেতন পাক না কেন, তাদের আসল দায়বদ্ধতা জনগণের প্রতি নয়। তাদের দায়বদ্ধতা প্রধানত দেশের আসল মালিক পুঁজিপতি শ্রেণির প্রতি। একই সাথে তাদের দায়বদ্ধতা পুঁজিপতি শ্রেণির রক্ষক সরকার ও শাসক দলের প্রতি। অতীতে বুর্জোয়া প্রশাসনযন্ত্র তবু কিছুটা নিরপেক্ষতা দেখানোর চেষ্টা করত। এখন সেটুকু দায়ও তারা বহন করতে নারাজ। গণতন্ত্রের খোলসটুকুই আজ সার। ভিতরের সারবস্তুকে শাসকরা প্রায় শেষ করেই দিয়েছে। যেটুকু আজও বাকি আছে, তাকেও একেবারে নিঃশেষ করে দিতে ভারতীয় একচেটিয়া মালিকদের এক মহা-বিশ্বস্ত সেবক হিসাবে দায়িত্ব নিয়েছে বিজেপি। দিল্লি পুলিশ সেই সেবার শিক্ষাটা নিয়েছে একেবারে অন্তর থেকে। তাই কোনও ছাত্রী দেশের সুদূর প্রান্তে বসে দিল্লির কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন জানালে সেটা একেবারে তাদের মর্মে গিয়ে আঘাত করছে। তাঁকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে জেলে ভরতে তাদের তৎপরতার অভাব ঘটছে না। কিন্তু আরএসএস-বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা যেন শুনতেই পায় না। গণহত্যা চলাকালীন দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি মুরলিধর আক্রান্ত মানুষের আর্তিতে সাড়া দিয়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে বারোটায় বাড়িতে আদালত বসিয়ে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আহতদের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। পরদিন দুপুরে তিনিপুলিশকে নির্দেশ দেন অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক ভাষণের জন্য বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর এবং পরবেশ ভার্মার বিরুদ্ধে ২৪ ঘন্টার মধ্যে এফআইআর করতে হবে। কিন্তু ওইদিন গভীর রাতে তাঁকে ট্রান্সফার করার আদেশ জারি করে সরকার। ফলে সেই এফআইআর পুলিশকে আর করতেই হয়নি।
বিজেপি রাজত্বে কাদের পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হবে, বলা যায়, তা এক প্রকার সুনির্দিষ্ট হয়ে গেছে। সরকারের বিরোধিতা, সমালোচনা মানেই কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা অথবা বিজেপি রাজ্য সরকারগুলির পুলিশের চোখে তা দেশদ্রোহ। ঠিক এই কারণেই উত্তরপ্রদেশের পুলিশ মানবদরদী চিকিৎসক ডাক্তার কাফিল খানকে স্থান দিয়েছে অপরাধীর তালিকায়, আর দিল্লি পুলিশ দাঙ্গাকারীদের নিরাপত্তার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। এর পরেও রাজ্যে রাজ্যে ভোটের প্রচারে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহেরা গণতন্ত্রের বাণী দেবেন, আর মানুষকে তা শুনতে হবে?