বেসরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজগুলির অধ্যাপকরা চরম বঞ্চনার শিকার। লকডাউন ঘোষণার পর এপ্রিল মাস থেকেই পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ বিএড কলেজগুলো শিক্ষকদের বেতন দেওয়া বন্ধ করেদেয়। কিছু কলেজ আবার জুলাই মাস থেকে বেতন দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। কিছু কলেজ প্রাপ্য বেতনের অর্ধেক অথবা সামান্য কিছু দিয়ে যাচ্ছে এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পরে কলেজ পূর্ণ উদ্যমে শুরু হলে বাকি বেতন মেটানো হবে। খুব কম কলেজই আছে যারা শিক্ষকদের পূর্ণ বেতন (চুক্তি অনুযায়ী) দিচ্ছে।
বেসরকারি কলেজগুলির বক্তব্য, ‘লকডাউনে ক্লাস হচ্ছে না। শিক্ষকদের কলেজে আসতে হচ্ছে না, পঠন-পাঠন বন্ধ। ট্রেনি ছাত্রছাত্রীদের থেকে টিউশন ফি আদায় হচ্ছে না। সুতরাং শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
শিক্ষকদের বেতন না দেওয়ার পেছনে এটা নেহাতই কুযুক্তি। কারণ, সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় নির্দেশ দিয়েছে অনলাইন ক্লাস নিতে, ক্লাস বন্ধ করা যাবে না। তাছাড়া, কলেজগুলি চুক্তি অনুযায়ী ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ টিউশন ফি সংগ্রহ করে। এখানে মাসিক ভিত্তিতে ছাত্রছাত্রীরা টিউশশন ফি দেয় না। দেয় চুক্তি অনুযায়ী এক বা দুই তিন কিস্তিতে। ফলে কলেজ টাকা পায়নি এই অজুহাতে শিক্ষকদের সম্পূর্ণ বেতন বন্ধ করে দেওয়া চলে না।
উল্লেখ্য, প্রাইভেট এম এড-বি এড-ডি এল এড কলেজগুলোর সহকারী অধ্যাপকরা সরকারি কলেজের অধ্যাপকদের এক-চতুর্থাংশ বেতন পান। বেতনের পরিমাণ গড়ে ৬ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা। খুব কম সংখ্যক অধ্যাপকে মাসিক বেতন ২০-২২ হাজার টাকা।
এমনিতে বেতন এত কম, তার সাথে যুক্ত হয়েছে প্রাইভেট কলেজ পরিচালন সমিতির শিক্ষকদের বেতন না দেওয়ায় নানা কৌশল। যেমন, নিয়োগপত্র না দেওয়া, চুক্তি (মূলত মৌখিক) অনুযায়ী বেতন না দেওয়া, কোনও বেতন স্কেল না থাকা, মাঝে মাঝে বেতন না দেওয়া, হঠাৎ করে বেতন কমিয়ে দেওয়া, বকেয়া রেখে দেওয়া– যাতে সেই শিক্ষক কলেজ ছেড়ে না যেতে পারেন, চাকরি ছেড়ে যেতে চাইলে বকেয়া টাকা না দেওয়া, শিক্ষকদের ব্যাঙ্ক পাসবুক-এটিএম কার্ড কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা রাখা, ১০ হাজার টাকা জমা দিয়ে ২৫ হাজার টাকার চেক দেওয়া, যখন তখন বরখাস্ত করা, প্রয়োজনীয় সংখ্যায় শিক্ষক নিয়োগ না করে দু-চার জন শিক্ষক দ্বারা কলেজের বিভিন্ন বিভাগের কাজ চালানো ইত্যাদি।
এই ধরনের কলেজগুলো এনসিটিই ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত নির্দেশ উপেক্ষা করে, মানবিকতা ও মানবাধিকার পদদলিত করে, বেতন বন্ধ করে শিক্ষকদের ও তাঁদের পরিবারের মানুষগুলোকে চিকিৎসাহীনতা, অপুষ্টি ও নিঃশব্দে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিচ্ছে।
এই সমস্ত কলেজগুলি সোসাইটি অ্যাক্ট দ্বারা চলে। ‘নো প্রফিট নো লস’ ট্রাস্টি বোর্ড থাকে। পরিচালন সমিতির দ্বারা চলে। নিয়ম অনুযায়ী পরিচালন সমিতির সম্পাদক অধ্যক্ষ। বাস্তবে বেশিরভাগ কলেজেই অধ্যক্ষ থাকে না বা থাকলেও তাঁদের ভূমিকা হয় নগণ্য। পরিচালন সমিতির ব্যক্তিরা স্থানীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে বিশেষ করে সরকারি দলের সাথে যুক্ত। ফলে কলেজগুলির পক্ষে শিক্ষকদের বঞ্চনা করতে অসুবিধা হয় না। যারা এক সময় বেসরকারিকরণের পক্ষে দু’হাত তুলে সমর্থন করেছিলেন, এই নির্মম শিক্ষক বঞ্চনা নিশ্চয়ই তাদের ভ্রান্তি দূর করতে সাহায্য করবে।