আন্দোলনের ময়দান থেকে
সকালের প্রথম তারুণ আলো ফাটা মেঘের ভেতর দিয়ে জায়গা করে নিয়েছে অনায়াসে। মানুষের মতো দেখতে কিছু প্রাণী মানুষ হওয়ার অভিনয় করে যাচ্ছে সুকৌশলে। একটা বৃহৎ অংশ অদ্ভুত ভাবে আজ এই প্রতিযোগিতার বাইরে। তাদের কাছে সংগ্রামটা আজ খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য। এমনিতেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল বেহাল। করোনা আবহে তা এখন শীতকালে পর্ণমোচী বৃক্ষের মতো অসহায়। রাষ্ট্রীয় শোষণের যাঁতাকলে সমাজ সভ্যতা সংস্কৃতি আজ নিজের অধিকারের প্রশ্নেও নীরব দর্শক। খোলা আকাশের নিচে সস্তায় বিক্রি হয়ে যাচ্ছে মনুষ্যত্ব মানবতা মূল্যবোধ। এই করোনা আবহের মধ্যেই অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন, নতুন শিক্ষানীতির মতো পাশ হল কৃষি আইন ২০২০। সৌজন্যে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রহসন।
অগ্নুৎপাতটা হয়তো হওয়ারই ছিল। কৃষি আইনকে কেন্দ্র করে শুরু হল প্রতিবাদ প্রতিরোধ, গড়ে উঠল স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলন। মেরুদণ্ড সোজা করে এগিয়ে এল পাঞ্জাব। তারপর হরিয়ানা। একে একে মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান সহ সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কৃষকরা এই কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে শুরু করলেন। ব্যারিকেড, টিয়ার গ্যাস, পুলিশি অত্যাচারকে ছাপিয়ে আন্দোলন আরও শক্তিশালী হতে শুরু করল।
আন্দোলন প্রায় দু’মাস হতে চলেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আন্দোলনে সামিল হচ্ছে। আমরাও চলেছি এই আন্দোলনে সামিল হতে। রাত ৯ টার ট্রেন স্টেশনে পৌঁছল রাত ১১ টায়। অগত্যা রাতটা স্টেশনেই কাটাতে হল। পরের দিন সকালে আনন্দবিহার স্টেশন থেকে অটোতে ঘণ্টা খানেক যাওয়ার পর আমরা পৌছলাম সিংঘু বর্ডারে। দিল্লি-হরিয়ানা বর্ডার। প্রায় ২০০টি পুলিশের বাস ন্যাশনাল হাইওয়ের পাশে দাঁড়িয়ে। কিছুটা পরেই চোখে পড়ল সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী। রাস্তার ওপর সারি সারি ট্রেন এর কনটেইনার, কাঁটাতার। পাঞ্জাব-হরিয়ানা থেকে আগত কৃষকদের পথ আটকে আজ তারা নিজেদের বীরত্ব প্রদর্শনে প্রত্যয়ী। ব্যারিকেডের কিছুটা পর থেকেই শুরু হল কৃষকদের তাঁবু। ব্যারিকেড থেকে প্রায় ২০০ মিটারের মধ্যেই মেইন স্টেজ। যেখান থেকে কৃষক আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের মধ্যে, নির্ধারিত হচ্ছে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি, তুলে ধরা হচ্ছে রাষ্টে্রর চরিত্র। রাস্তার ওপর কৃষকদের তাঁবু , ট্রাক্টর, ট্রাক, লরি। অধিকাংশই ট্রাকের ওপরে ত্রিপল জাতীয় কিছু দিয়ে তার মধ্যেই কোনওরকমে আছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ আন্দোলনে সামিল হয়ে রোজ আন্দোলনকে অক্সিজেন জোগাচ্ছেন। কৃষক থেকে ছাত্র, আট থেকে আশি সমস্ত মানুষ এখানে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আজ এক সাথে। তাঁবুর মাঝে মাঝে কোথাও বসেছে লঙ্গরখানা। আন্দোলনে অংশ নেওয়া লক্ষাধিক মানুষের দিনের শেষে খাওয়ার সংস্থান হয় ওখানেই।
পরের দিন সকালে কুয়াশা সরতে একটু সময় নিল। বেলা ১১ টায় পাশের একটা লঙ্গরখানায় কিছু খেয়ে আমরা বেরোলাম। হিন্দিটা মানিয়ে নিতে আমাদেরও খুব একটা অসুবিধা হল না। চারিদিক কৃষি বিলের বিরুদ্ধে স্লোগান গমগম করছে। বিভিন্ন জায়গায় কৃষি বিলের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করার জন্য বিভিন্ন রকম পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে। কোথাও স্লোগান, কোথাও নাটক, কোথাও আবার ভগৎ সিংকে সামনে রেখে গান করছে আন্দোলনকারীরা। পাঞ্জাবের প্রায় প্রতিটি বাড়ি নিজেদের সামর্থ্যমতো অবদান রেখেছে আন্দোলনে, হরিয়ানাও পিছিয়ে নেই। কেউ অর্থ সাহায্য করছে, কেউ আটা, চাল, ডাল, কেউ বা খেতের সবজি। সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসছে সাহায্য, দেশের বাইরে থেকেও সাহায্য আসছে গণআন্দোলনে। এসেছে মেডিক্যাল টিম। ক্যাম্পে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা। মাঝেমধ্যেই এদিক ওদিক থেকে কিসান আন্দোলনের স্লোগান ভেসে আসছে।
এখানে আজ আমাদের দশদিন। দিন দিন আন্দোলনকারীদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। যেখানে আমি আপনি সন্ধ্যা হলে চার দেওয়ালের মধ্যে থেকেও শীতের তীব্রতা মাপতে মাপতে নিদ্রামগ্ন হই, সেখানে কৃষকরা দিল্লির প্রবল ঠাণ্ডার মধ্যে রাস্তায় দিন কাটাচ্ছে, লড়ছে নিজেদের অধিকার রক্ষার লড়াই, হয়ত আমার আপনার লড়াইটাও। একটা তাঁবুর সামনে বসে আছেন একজন আন্দোলনকারী কৃষক। বয়সটা বোধহয় ষাটের আশেপাশে। আমাদের দেখে ইতস্ততবোধ করতে লাগলেন প্রথমে। কথা বলে জানতে পারলাম আন্দোলনের প্রথম দিন থেকে উনি আছেন রাস্তায়। তবুও চোখে মুখে হতাশার লেশমাত্র নেই। আমাদের একজন প্রশ্ন করল, এইভাবে আর কতদিন? দৃপ্ত কণ্ঠে উত্তর এল– কৃষি বিল রদ না হওয়া পর্যন্ত, চার মাস, ছয় মাস প্রয়োজন হলে আরও। একজন আবার প্রশ্ন করল যদি সরকার মেনে না নেয় তাহলে? তাকে থামিয়েই উনি তাঁবু বাঁধার দড়িটার দিকে ইঙ্গিত করলেন। লজ্জায় আর গর্বে আমরা ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ৬০ বছরের বৃদ্ধের তারুণ্য যেন আজ ১৮ বছরের তরুণকে ছাপিয়ে গিয়েছে।
ক্ষয়িষ্ণু এই সমাজে যেখানে মানুষের মধ্যে তিক্ততা, অসহিষ্ণুতা ক্রমবর্ধমান, সেখানে দিল্লির এই আন্দোলনের আবহে যেন একটা বিপরীত স্রোত। আন্দোলনে অংশ নেওয়া কয়েক লক্ষ মানুষ যেন আজ এক মায়ের সন্তান, কতদিনের চেনা, কতটা কাছের। গণআন্দোলনের উত্তাপে মানুষের চরিত্রও যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
এদিকে সংবাদমাধ্যমগুলো সুচতুর ভাবে এগুলো আড়াল করছে। কৃষকদের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনার পরও রাষ্ট্র কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষায় অনড়। এদিকে আন্দোলনের পটভূমিতে যেন একটি স্লোগান– ‘কিসান বিরোধী কালে কানুন, রদ করো।’ তাঁদের দাবি থেকে তাঁরা একটুও পিছিয়ে যেতে রাজি নয়। দিল্লি সীমান্তে যেন নতুন করে আবার ভগৎ সিং-এর জন্ম হয়েছে।
ফিরেছি প্রায় আরও পাঁচদিন পর। প্রতিটা দিন আমরা দেখেছি মানুষের মধ্যে প্রবল আবেগ ও এগিয়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছাশক্তি। যেন এক নতুন ভারতবর্ষ। যতদূর চোখ যায় শুধু কৃষকদের তাঁবু। কোনোদিনও আন্দোলনকারীদের শেষ তাঁবু অবধি পৌঁছতে পারিনি আমরা। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন সংগঠিত, শান্তিপূর্ণ কৃষক আন্দোলনের নজির বিরল। সিংঘু বর্ডার এর মতোই টিকরি বর্ডার, গাজিপুর বর্ডারে সংগঠিত হয়েছে আন্দোলন।
কৃষক আন্দোলন এখনও অব্যাহত। পৃথিবীর বৃহত্তম সংবিধানও যেন আজ নিজের ওপর লজ্জিত, নিজেই নিজেকে নিয়ে হাসছে। রাষ্ট্র এখনও নির্লজ্জতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। চাইলে আপনিও দিল্লি সীমান্তে কৃষকদের সাথে থেকে এই ঐতিহাসিক আন্দোলনের সাক্ষী হতে পারেন।
আকাশ বেরা, পশ্চিম মেদিনীপুর