প্রধানমন্ত্রীর নামে তৈরি তহবিল। ট্রাস্টের চেয়ারম্যান স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি। অমিত শাহ সহ তিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রয়েছেন ট্রাস্টি বোর্ডে। সরকারি চাকুরেদের তহবিলে অনুদান দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে খোদ কেন্দ্রীয় সরকারি মন্ত্রক। অথচ তা নাকি সরকারি তহবিলই নয়! সুতরাং তথ্যের অধিকার আইনে মানুষ তহবিল নিয়ে কোনও প্রশ্ন তুললে উত্তর মেলে না। কারণ, সরকারি নয় যে সংস্থা, তার ব্যাপারে সরকার উত্তর দেবে কেন! এমন মজার খেল-ই চলছে পিএম কেয়ার্স তহবিল ঘিরে।
বিপর্যয় সামাল দিতে ‘জাতীয় ত্রাণ তহবিল’ থাকা সত্ত্বেও করোনা অতিমারি মোকাবিলার নামে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লকডাউনের মধ্যে যখন ‘পিএম কেয়ার্স’ তহবিল তৈরি করেন, তখনই এর পিছনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠেছিল। সম্প্রতি আবারও এ নিয়ে শুরু হয়েছে শোরগোল। প্রধানমন্ত্রীর নামাঙ্কিত এই তহবিল নথিভুক্ত হয়েছে কেন্দ্রের রাজস্ব বিভাগে। অথচ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এর দলিলে বলা হয়েছে, পিএম কেয়ার্স কোনও সরকারি ট্রাস্ট নয়। কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার– কেউই এর তহবিল বা দানের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে না। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কে নিয়ন্ত্রণ করে এই তহবিল?
এটি নাকি সরকারি ট্রাস্ট নয়। অথচ নথিভুক্ত হওয়ার পরদিনই কেন্দ্রীয় সরকারের কর্পোরেট মন্ত্রক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে– বড় বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচিতে যে টাকা দেয়, সেই ‘সিএসআর’ বা ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি’-র টাকা নিতে পারবে পিএম কেয়ার্স। এদিকে কোম্পানি আইনে পরিষ্কার লেখা আছে, জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা তহবিল, ত্রাণ বা তফসিলি জাতি, জনজাতির উন্নয়ন তহবিল ইত্যাদির মতো কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের তহবিলগুলিই কেবল সিএসআর-এর দান গ্রহণ করতে পারে। তাহলে কিসের ভিত্তিতে সরকারি মন্ত্রক এমন বিজ্ঞপ্তি দিল? পিছনে কাদের নির্দেশ ছিল? উত্তর মেলেনি।
২৭ মার্চ ‘পিএম কেয়ার্স’ গঠনের পর ১৭ এপ্রিল অর্থমন্ত্রকের রাজস্ব দফতর কর্মচারীদের উদ্দেশে একটি সার্কুলার দেয়। তাতে বলা হয়, কর্মচারীরা ২০২১-এর মার্চ পর্যন্ত প্রতি মাসে একদিনের বেতন পিএম কেয়ার্স-এ দান করবেন। মজার ব্যাপার হল, এই দান কিন্তু কর্মচারীদের ইচ্ছাধীন নয়। সার্কুলারের ভাষা বলছে, কার্যত কর্মচারীদের বাধ্য করা হয়েছে ওই টাকা দিতে। সেখানে বলা হয়েছে, কোনও অফিসার বা কর্মচারীর যদি এতে আপত্তি থাকে, তাহলে নিজের ‘এমপ্লয়ি কোড’ উল্লেখ করে তিনি যেন ২০ এপ্রিলের মধ্যে লিখিতভাবে রাজস্ব দফতরের ‘ড্রয়িং অ্যান্ড ডিসবার্সিং অফিসার’-কে সে কথা জানান। এ তো কর্মচারীদের ওপর রীতিমতো চাপ সৃষ্টি করা! প্রশ্ন হল, কী কারণে এবং কাদের নির্দেশে সরকারি নয় এমন একটি তহবিলে টাকা দেওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রক এ হেন উদ্যোগ নিল? কেনই বা একটি অ-সরকারি তহবিলের ভাণ্ডার ভরাতে সরকারি মন্ত্রকের এত মাথাব্যথা? তথ্যের অধিকার আইনে প্রশ্ন করা হলে উত্তর দেওয়ার দায় নেয়নি বিজেপি সরকার– কারণ পিএম কেয়ার্স সরকারি তহবিল নয়।
এবার দেখা যাক, কী পরিমাণ টাকা জমা পড়েছে এই তহবিলে। সংবাদসূত্রে জানা গেছে, তৈরি হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে সেখানে জমা পড়ে সাড়ে ছ’হাজার কোটি টাকা। এ বছরের ৩১মে পর্যন্ত জমা পড়া টাকার পরিমাণ ১০ হাজার কোটি। বড় অঙ্কের টাকা এসেছে কর্পোরেট পুঁজির মালিক এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে। কেন্দ্রীয় শক্তি মন্ত্রকের অধীনস্থ সংস্থাগুলি ৩ এপ্রিল পর্যন্ত এই তহবিলে ঢেলেছে ৯২৫ কোটি টাকা এবং ওএনজিসি, আইওসি, ভারত পেট্রোলিয়ামের মতো সরকারি তেল কোম্পানিগুলি দান করেছে ১০০০ কোটি টাকা। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এতদিনে অনুদানের পরিমাণ আরও বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর নামে তহবিল। অথচ বন্যার স্রোতের মতো তহবিলে ঢোকা বিপুল টাকার হিসাব-নিকাশের কোনও দায় কিন্তু মোদীজি বা তাঁর সরকারের নেই। পিএম কেয়ার্সের ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণই নেই সরকারি সংস্থা সিএজি-র। কারণটা খুব সোজা। এটি সরকারি তহবিলই নয়। তার মানে, কোথা থেকে আসছে এই বিপুল টাকা, কারা কী উদ্দেশ্যে ও কোন শর্তে এই টাকা দিচ্ছে, কোথায়, কোন খাতে এবং কী পদ্ধতিতে তা খরচ হচ্ছে বা হবে– এই সব অত্যন্ত জরুরি প্রশ্নের কোনওটিরই উত্তর দিতে রাজি নন প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকার। তার মানে, অতিমারি বিপর্যয় মোকাবিলার নামে তোলা এই বিপুল টাকা ইচ্ছামতো, এমনকী নিজস্ব দলীয় স্বার্থ পূরণে ইচ্ছামতো ছড়ানোয় কোনও বাধা নেই মোদিজীর ও অমিত শাহ সহ তাঁর সঙ্গীসাথীদের।
তবে কি করোনা অতিমারিজনিত বিপর্যয়কে কাজে লাগিয়়ে এবং সরকারি পদমর্যাদা ব্যবহার করে এভাবে বিপুল লুঠতরাজের ব্যবস্থা করলেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা! এ প্রশ্নের উত্তর তাঁদেরই দিতে হবে। দেশের মানুষের সঙ্গে এ যদি চূড়ান্ত প্রতারণা না হয়, তাহলে এ আর কী! তবে কি ধরে নিতে হবে, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সঙ্গীরা এই ‘দিনে ডাকাতি’কে অধিকার বলে মনে করেন? নৈতিকতা দূরে থাক, চক্ষুলজ্জাটুকুও কি তবে বিসর্জন দিয়েছেন বিজেপি সরকারের বড়কর্তারা!
মানুষ আজ প্রশ্ন তুলছে, তাদেরই ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকারে বসে তাদেরই কষ্টার্জিত টাকা ইচ্ছামতো লুট করার এই সাহস বিজেপি নেতারা পেলেন কোথা থেকে! তাঁরা কি ভাবছেন দেশের মানুষ এ জিনিস চুপচাপ মেনে নেবে? আজ হোক, কাল হোক এর হিসেব তারা বুঝে নেবেই।