দেশের সংগ্রামরত কৃষকদের পাশে দাঁড়ান এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর আহ্বান

‘‘কৃষক এবং শ্রমিকরা সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ,তবে শোষক শ্রেণি তাদের কঠোর পরিশ্রমে উপার্জিত আয় লুঠ করে এবং তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখে। কৃষক, যারা প্রত্যেকের জন্য খাদ্য জোগায়, সপরিবারে ক্ষুধায় মারা যায়। সবার জন্য কাপড় বোনা তাঁতিদের সন্তানেরাও পোশাক পায় না। ছুতোর, কামার এবং রাজমিস্ত্রি যারা বিশাল বিশাল প্রাসাদ বানান তারা বস্তিতে বাস করতে বাধ্য হয়। … বিপ্লবের যথার্থ সৈনিক কারখানায় ও গ্রামে আছে, তারা হচ্ছেন শ্রমিক ও কৃষক। … ঘুমন্ত সিংহকে যদি জাগানো হয়, তাহলে… এই শক্তি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে।… আমাদের আদর্শ পুরণ করার জন্য, … শ্রমিক ও কৃষকদের সমর্থন পাওয়া ও তাদের সংগঠিত করা প্রয়োজন।’’    – শহীদ-ঈ-আজম ভগৎ সিং

বন্ধুগণ,

দিল্লীর বুকে সংগ্রামরত কৃষকরা প্রতিদিন ইতিহাস রচনা করে চলেছেন। শীতের রাতেও খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন লক্ষ লক্ষ কৃষক নারী-পুরুষ। সাথে রয়েছে তাদের শিশু সন্তানরাও। প্রতিদিন হাজারে হাজারে কৃষক যোগ দিচ্ছেন সেই অবস্থানে। সেখানে জাত-ধর্মের বেড়া গিয়েছে ভেঙ্গে মন্দির মসজিদ গুরুদ্বারের খোলা প্রাঙ্গণে রাস্তাতেই সারিবদ্ধ হয়ে বসে আছেন সকলে। এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের দমন করার জন্য কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এমন কোন পন্থা নেই, যা গ্রহণ করেনি। সরকার নিজে রাস্তা কেটে দিয়েছে, বিশাল কংক্রিটের ব্যারিকেড তৈরি করেছে, নির্বিচারে লাঠি চালিয়েছে, ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়ার গ্যাস ছুঁড়েছে, দিল্লীর প্রবল ঠাণ্ডায় জলকামানের জলে ভিজিয়ে দিয়েছে কৃষকের শরীর। আবালবৃদ্ধ কৃষকরা বুক চিতিয়ে জল কামানের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘কত জল দেবে দাও। এর চেয়ে বেশি ঘাম তো আমরা মাঠেই ঝরাই।’  রাষ্ট্রের এইসব দমন পীড়নের আয়োজন কৃষকদের অদম্য প্রতিরোধের স্রোতে খড়কুটোর মত ভেসে গিয়েছে। ইতিমধ্যে ৭ জন আন্দোলনকারীর মৃত্যু ঘটেছে। এরকম মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা যে আরও ঘটতে পারে —তা কৃষকদের অজানা নয়। তবু আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে তারা অটল। তাদের দাবি—সর্বনাশা কৃষি আইন-২০২০ ও বিদ্যুৎ আইন সংশোধনী-২০২০ বাতিল করতে হবে। আন্দোলনের চাপে বিজেপি সরকার কৌশল করে কিছু সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু কৃষকরা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। দৃঢ়প্রত্যয়ে সম্মিলিত কণ্ঠে তারা দাবি তুলেছেন – ‘সংশোধন নয়, বাতিল কর’। আন্দোলনের নেতৃত্ব দিল্লির সিংঘু বর্ডারের ধনা অঞ্চলের ৫টি এলাকার নামকরণ করেছেন বাবা বান্দা সিং, অজিত সিং, গুলাব কাতর, শহীদ-ই-আজম ভগৎ সিং ও শহীদ সাধু সিং তখত পুরার নামে। প্রেস গ্যালারির নামকরণ করা হয়েছে শহীদ আশফাকউল্লা খানের নামে। আন্দোলনকারীদের এই মর্যাদাবোধের দৃষ্টান্তে শুধু দিল্লি সীমান্ত নয়, গোটা দেশ এখন উত্তপ্ত, আলোড়িত, অনুপ্রাণিত।

নতুন এই কৃষি আইনের উদ্দেশ্য হল, খাদ্য সহ সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যকে বহুজাতিক পুজির হাতে তুলে দেওয়া। তারা জলের দরে কৃষকের ফসল কিনবে, আর অগ্নিমূল্যে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করে মুনাফা লুটবে। ফলে কৃষকদের আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়তে থাকবে, সাধারণ মানুষের জীবনও হবে দুর্বিষহ। দ্বিতীয়ত, ফসলের দাম পাওয়ার যতটুকু সরকারি ব্যবস্থা এখনো আছে, তা তুলে দেওয়া হবে। তার দ্বারা কৃষকসমাজ হবে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের কৃপার পাত্র। তৃতীয়ত, চুক্তি চাষ চালু করে কৃষকদের পরিণত করা হবে ক্রীতদাসে। এই আইন চালু হলে বাস্তবে রেশন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে, মজুতদারি-ফাটকাবাজি ব্যাপকভাবে বাড়বে। যার পরিণতিতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সহ সর্বন্তরের নেতারাও চুড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ‘বিদ্যুৎ বিল সংশোধনী ২০২০’র মধ্য দিয়ে কর্মী, সাধারণ গ্রাহক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে বৃহৎ ব্যবসায়ীদের যথেচ্ছ মুনাফা লুণ্ঠনের ক্ষেত্রে পরিণত করা হবে। তাই এই সংগ্রাম শুধু কৃষকের নয়, আপনার-আমার—সকলের।

ভারত বনধের দিনে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর উদ্যোগে এক বিশাল মিছিল শিয়ালদহ থেকে এসপ্ল্যানেডে যায়।
ডোরিনা ক্রসিং অবরোধ করে বিক্ষোভ চলে। বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড অমিতাভ চ্যাটার্জী।
প্রধানমন্ত্রীর কুশপুতুলে অগ্নিসংযোগ করেন রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য

এই আন্দোলনের সূচনাপর্ব থেকেই আমাদের দল এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) ও কৃষক সংগঠন এআইকেকেএমএস পশ্চিমবঙ্গ সহ সমস্ত রাজ্যে কৃষকদের সংগঠিত করার সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করে আসছে। দিল্লির আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সংগঠনগুলির মধ্যে এআইকেকেএমএস উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছে। সর্বভারতীয় নেতৃবৃন্দ আন্দোলনকারীদের সাথেই রাজপথে বিভিন্ন ভাষায় প্রচারপত্র ও পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়েছে। গ্রামে গ্রামে কৃষকদের সভা করে ‘কৃষক কমিটি’ গঠন করা হচ্ছে। ২৫ সেপ্টেম্বর ‘গ্রামীণ ভারত বনধ’, ১৪ অক্টোবর ‘সারা ভারত কিষাণ প্রতিরোধ দিবস’ ও ৩ ডিসেম্বর ‘কৃষক সংহতি দিবস’ পালিত হয়েছে। জনস্বার্থবিরোধী কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ২৬ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকা ভারত বনধের দিনে কৃষকরা যখন দিল্লী অভিযান শুরু করল, সেদিন আমাদের দল এবং কৃষক সংগঠনের কর্মীরা তাদের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে সক্রিয়ভাবে সেই ব্যারিকেডে অংশ নিয়েছিল। মধ্যপ্রদেশ থেকে আমাদের ‘কিষাণ জাঠা’ দিল্লীর দিকে যাত্রা শুরু করলে উত্তরপ্রদেশ সীমান্তে তাদের খোলা আকাশের নিচে ৬৮ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। কিন্তু তাদের জন্য সংগ্রামী মানসিকতার ফলে শেষ পর্যন্ত দিল্লী যাওয়ার অনুমতি দিতে বাধ্য হয় উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার। কৃষক সংগঠনগুলির আহ্বানে গত ৮ ডিসেম্বরের দেশ জুড়ে ভারত বনধকে ভাঙতে কোন চেষ্টাই বাদ রাখেনি বিজেপি সরকার। কোথাও জোর করে বাস চালিয়েছে, পুলিশবাহিনী নামিয়ে রুখে দিতে চেয়েছে মিছিলের জনজোয়ার। গুজরাট জুড়ে জারি করেছে ১৪৪ ধারা পুলিশের দমন পীড়ন আমাদের দল ও কৃষক সংগঠনের উপর নেমে এসেছে। উত্তর প্রদেশের বদলাপুরে আমাদের দলীয় দপ্তরে হামলা চালিয়েছে পুলিশ। শুধু তাই নয়, এআইকেকেএমএস-এর হরিয়ানার রাজ্য সম্পাদক কমরেড জয়করণকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়েছে, অন্ধ্রপ্রদেশে দলের রাজ্য সম্পাদক কমরেড অমরনাথকে গ্রেফতার করেছে, উত্তরপ্রদেশের কৃষক নেতাদের গৃহবন্দী করে রেখেছে, জৌনপুর জেলা সম্পাদক কমরেড রবিশঙ্কর মৌর্যকে গ্রেপ্তার করেছে, ওড়িশার কটকে ৪৫ জন এসইডসিআই (সি) কর্মীসহ ৫৫ জন বামনেতা কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত রাজ্য সরকার সহ অন্যান্য রাজ্যের অবিজেপি সরকারগুলি আন্দোলনের প্রতি প্রবল জনসমর্থন দেখে দাবিগুলিকে সমর্থন করতে বাধ্য হলেও ধর্মঘটের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু কোনো কিছুই সর্বাত্মক ধর্মঘটের স্বতঃস্ফুর্ততাকে আটকাতে পারেনি। এই সফল ধর্মঘট আন্দোলনে আরও তীব্র গতি সঞ্চার করেছে।

 

সকলেই জানেন, করোনা অতিমারী ও লকডাউনের সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার একটার পর একটা জনবিরোধী আইন পাশ করিয়ে ভেবেছিল কারোরই কিছু করার ক্ষমতা থাকবে না। কিন্তু রেল সহ জনগণের সম্পত্তি বেসরকারী পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে একদিকে গড়ে উঠেছে শ্রমিকদের লাগাতার আন্দোলন, অন্যদিকে দিল্লীর বুকে সংগঠিত এইক্ষক আন্দোলনের জোয়ার সারা দেশে লড়াইয়ের এক নতুন প্রেরণার সৃষ্টি করেছে। শিক্ষক-অধ্যাপক-ডাক্তার-আইনজীবী-শিল্প-বুদ্ধিজীবী সহ দেশ-বিদেশের নানা সংগঠন কৃষকদের এই আন্দোলনের সমর্থনে সোচ্চার হয়েছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রাস্তায় নেমে হাজার হাজার মানুষ মিছিল করছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্ধত আচরণের প্রতিবাদে আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিভিন্ন ক্রীড়াবিদ, বিজ্ঞানী সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সরকারি পদক প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং ফিরিয়ে দিতে শুরু করেছেন। এআইডিএসও, এআইডিওয়াইও, এআইএমএসএস, এআইইটিইউসি সহ দেশের বিভিন্ন ছাত্র যুব মহিলা শ্রমিক সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন আন্দোলনরত কৃষকদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন। অবস্থানরত কৃষকদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন আমাদের মেডিক্যাল ফ্রন্টের কর্মী সহ ডাক্তারদের বিভিন্ন সংগঠন।

এই অভূতপুর্ব আন্দোলনের প্রতি পূর্ণসংহতি ও সমর্থন জানিয়ে আমাদের দল এসইউসিআই (কমিউনিস্ট)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আন্দোলনকে দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিতে হবে এবং একে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রত্যেকটি গ্রামে আন্দোলনের নিজস্ব হাতিয়ার হিসাবে ‘কৃষক কমিটি’ গড়ে তুলতে হবে, তৈরী করতে হবে ‘ভলান্টিয়ার বাহিনী’। তারই ভিত্তিতে আমরা পশ্চিবাংলার সমস্ত জেলায় অসংখ্য ধর্ণামঞ্চ গড়ে তোলার কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। দিল্লিতে সংগ্রামরত কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে এই সমস্ত ধর্ণামঞ্চে কৃষকসহ ছাত্র-যুব-মহিলা-শ্রমজীবী মানুষ হাজারে হাজারে সমবেত হচ্ছেন, আন্দোলনের প্রতি তাদের সুদৃঢ় সমর্থন জানাচ্ছেন। আমাদের স্থির বিশ্বস, তারা আরও ব্যাপক সংখ্যায় সামিল হয়ে আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করবেন। আমরা মনে করি নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, বা নির্বাচনীস্বার্থে আন্দোলনের মহড়া নয় — বামপন্থী ও যথার্থ গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমেই গণআন্দোলনকে সঠিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব এবং একমাত্র তার দ্বারাই জনসাধারণের বিজয় অর্জন সম্ভব।

বন্ধুগণ, কৃষকদের এই লড়াই শুধু কৃষকদের নয়। শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সর্বস্তরের শোষিত মানুষের লড়াই। একদিকে ধনকুবের মালিক ও তাদের স্বার্থরক্ষাকারী সরকার, আর অন্যদিকে কৃষক-শ্রমিক সহ নিম্নবিত্ত দরিদ্র-শোষিত-নিপীড়িত জনসাধারণ। এই ঐতিহাসিক লড়াইকে সর্বতোভাবে সাহায্য করার জন্য আমরা সকল অংশের মানুষের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি।

সংগ্রামী অভিনন্দন সহ

চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য্য

সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি

এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)