প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় জাতীয় শিক্ষানীতি-২০ রচিত হয়েছে ২১ শতাব্দীর ডিজিটাল যুগ ও বাজার অর্থনীতির উপযোগী কর্মশক্তি তৈরি করার দিকে লক্ষ্য রেখে। তাই এবারের শিক্ষানীতিতে বৃত্তিমুখী শিক্ষার উপরে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বৃত্তিমুখী শিক্ষা শুরু হবে একদম স্কুল স্তরে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় পরিচিত পরিবেশ, সম্পদ ও স্থানীয় পেশার সাথে যুক্ত প্রশিক্ষককে কাজে লাগানো হবে। প্রশ্ন হল, মাত্র ১২ বছর বয়সে একজন কিশোর বা কিশোরী কিভাবে শিক্ষার পাঠ্যক্রমথেকে তার বৃত্তি (ভোকেশন) বা পেশা নির্বাচন করবে? সেই অভিজ্ঞতা বা পরিপক্কতা কি তার গড়ে উঠেছে? স্বাভাবিকভাবে ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে ও মফঃস্বলের সরকারি ও বিশেষত সরকার পোষিত হাজার হাজার স্কুলে একদিকে উপযুক্ত পরিকাঠামো ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষকের অভাব অন্যদিকে জাতপাত ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ ও চূড়ান্ত আর্থিক বৈষম্যে বিভাজিত এ দেশের অধিকাংশ তথাকথিত নিম্নবর্ণ এবং প্রান্তিক সমাজের ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের পারিবারিক পেশা গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। অর্থাৎ কুমোরের ছেলেকে কুমোরের কাজ, কামারের সন্তানকে কামারের কাজ, মালির সন্তানকে বাগানের কাজ, ছুতোর মিস্ত্রির সন্তানকে ছুতোরের কাজ, তাঁতির ছেলেকে তাঁত বোনা শিখেই দিন গুজরান করতে হবে! তাদের বৃহত্তর জগতের অন্য পেশায় যাওয়ার রাস্তাটা বন্ধ হবে। এবারের জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে বছরে অন্তত দশটা দিন তারা স্কুল ব্যাগ ছেড়ে দিয়ে স্থানীয় চাষি বা মালি, ইলেকট্রিক এবং ছুতোর মিস্ত্রি, তাঁতি, কুমোর অথবা কামার বা রাজমিস্ত্রির কাছে গিয়ে হাতেকলমে কাজ শিখবে। ছুটির দিনগুলোতেও তাই। কারণ এই শিক্ষানীতি অনুযায়ী, এরাই হচ্ছেন স্থানীয় প্রশিক্ষক। ছাত্র-ছাত্রীদের একটা বড় অংশ যাদের দু’বেলা ভালো করে আহার জোটে না, তাদেরও নাকি অনলাইনে বৃত্তিমুখী শিক্ষা দেওয়া হবে পুরো স্কুল ব্যবস্থায় এটাই চলবে। কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত (জাতীয় শিক্ষানীতির দলিল অনুযায়ী Clause.১৬.৫) ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০% ছাত্রছাত্রীকে পুরোপুরি বৃত্তিমুখী শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা হবে। আগামী দিনে এরাই নাকি হবেন প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের ‘আত্মনির্ভর’ ভারতের প্রধান শক্তি।
বৃত্তিমুখী শিক্ষার উপরে মাত্রাতিরিক্ত জোর দেওয়ার ফলে দেশের একটা বিশাল অংশের ছাত্র-ছাত্রী মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে দূরে সরে যাবে। মূল ধারার শিক্ষা বা সাধারণ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে দেশের অধিকাংশ দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া অংশের ছাত্র সমাজের উচ্চশিক্ষা, উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার যে সুযোগ থাকবে না। কারণ উচ্চস্তরের বা উন্নত (স্নাতক স্তরের) পেশাগত শিক্ষায় (professional education) প্রবেশ করতে গেলে অন্তত উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। ডিপ্লোমা স্তরের পেশাগত শিক্ষায় প্রবেশ করতে গেলে অন্তত মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। এমনকি আইটিআই বা বিভিন্ন অ্যাপ্রেনটিসশিপ কোর্সে প্রবেশ করতে গেলে নূ্যনতম অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। এ বারের শিক্ষানীতিতে তার পরিবর্তন ঘটিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা করা হল। একটা স্তর পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার পর একজন ছাত্রের বৃত্তিমুখী প্রশিক্ষণ নেওয়া এক জিনিস, আর পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে বৃত্তিমুখীকরন করা সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং অত্যন্ত বিপদজনক ঝোঁক। এর ফলে ন্যূনতম সাধারণ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে গরিব সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা উচ্চশিক্ষা ও উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার যে আকাঙক্ষা বা স্বপ্ন দেখতে পারত তা গড়েই উঠবে না। শিক্ষার উচ্চ প্রাথমিক স্তরেই সেই মনটাকে মেরে দেওয়ার বন্দোবস্ত এবারের জাতীয় শিক্ষানীতিতে করা হয়েছে। কারণ যথার্থ ও উন্নত সাধারণ শিক্ষা (decent general education) সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা ও উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ভিত গড়ে তুলতে সাহায্য এবং আগ্রহ সৃষ্টি করে। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত ছিল জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে আগামী দিনে সরকারি ও সরকার পোষিত স্কুল শিক্ষাকে সমস্ত যথাসম্ভব ত্রুটিমুক্ত করে উন্নত ও শক্তিশালী করা। প্রয়োজন ছিল সরকারি ও সরকার পোষিত স্কুলগুলিতে শিক্ষকের লক্ষ লক্ষ খালি পদ যত দ্রুত সম্ভব পূরণ করা ও পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটিয়ে হারিয়ে যাওয়া শিক্ষার মানকে উন্নত করার জন্য সর্বপ্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সরকারি ব্যবস্থাতেও যে উন্নত শিক্ষা সম্ভব, তা দিল্লির সাম্প্রতিক স্কুলশিক্ষা ব্যবস্থায় দেখা গেছে। তা না করে কেন্দ্রীয় সরকার বর্তমান জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে গরিব ছাত্রদের স্কুলের সাধারণ শিক্ষা থেকে দূরে হঠানোর আয়োজন সম্পুর্ণ করেছেন। ফলে আগামী দিনে আমরা দেখতে পাব জাতপাত, ধর্ম, বর্ণ ও অর্থনৈতিক বৈষম্যে ভরা আমাদের দেশে শিক্ষায় আরেক ধরনের বিভাজন বা বৈষম্য। সাধারণ স্কুলগুলোতে গরিব ছাত্ররা যখন ছোট ছোট অপটু হাতে বই ছেড়ে রাজমিস্ত্রির কর্নিক, ইলেকট্রিক মিস্ত্রির যন্ত্র, কিংবা ওয়েল্ডিং যন্ত্রের হাল ধরবে, তখন অবস্থাপন্ন ঘরের ছাত্রছাত্রীরা বেসরকারি পাঁচতারা স্কুলগুলোতে কম্পিউটারের সামনে বসে আধুনিক শিক্ষালাভ করছে, বিশেষ কোচিং নিয়ে ইলেকট্রিক্যাল বা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, আইনজীবী অথবা ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানী হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এটাই হল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘হার্ভার্ড শিক্ষা বনাম হার্ডওয়ার্ক শিক্ষা’র তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ! আমাদেরদেশের তথাকথিত উন্নাসিক ‘এলিটিস্ট’ অংশের কিছু লোক এবং অধিকাংশ সরকারি মন্ত্রী-আমলারা ভাবেন– গরিব মানুষের ছেলেমেয়েদের এত লেখাপড়া ও উচ্চশিক্ষা দিয়ে অথবা ইংরেজি শিখে কী হবে? যেমনটি আমরা শুনেছিলাম ১৯৭৮-৭৯ সালে পশ্চিমবাংলায় প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি এবং পাশফেল তুলে দেওয়ার সময় সিপিএমনেতারা বলতেন, ‘চাষি মজুরের ছেলেদের এত ইংরেজি শিখে কী হবে? তাদের তো কোনও রকমে নিত্যদিনের কাজটা চালিয়ে নিতে পারার মতো শিক্ষা হলেই হল’।
বিভিন্ন বৃত্তি ও পেশার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বাধীনতার আগে এবং পরে সরকারি, জনসাধারণের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল। সমাজ ও দেশের বিকাশ ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু শিক্ষার সামগ্রিক বৃত্তিমুখীকরণের কথা ভারতীয় নবজাগরণের প্রাতঃস্মরণীয় মনীষীগণ অথবা স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ স্বপ্নেও চিন্তা করেননি। বরং মানুষ গড়া, চরিত্রদান ও জ্ঞানার্জনের জন্য তারা বিভিন্ন স্কুল-কলেজের স্থাপনের কথা বলেছেন এবং প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু বর্তমান শাসকরা ঠিক উল্টো পথে চলেছেন! শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মনুষ্যত্ব অর্জন, চরিত্র নির্মাণ ও জ্ঞানার্জনের পরিবর্তে ছাত্র-ছাত্রীদের তারা শিক্ষিত ‘রোবট’ বা ‘মেকানিক’ অথবা মিস্ত্রিতে পরিণত করতে চাইছেন। তাদের ভাবখানা এমন যেন দেশে প্রচুর কাজ পড়ে রয়েছে, অভাব শুধু সত্যিকারের কর্মক্ষম মানুষের? তাই জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০তে বৃত্তিমুখী শিক্ষার এত আয়োজন ও গুরুত্ব! কিন্তু দেশের বাস্তব অবস্থা অন্য কথা বলছে। সরকারি তথ্য অনুসারে প্রতি বছর গ্রাজুয়েট ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, আইটিআই ও অন্যান্য অ্যাপ্রেনটিসশিপ কোর্সে পাস করা ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৫০-৫৫ লক্ষ (সূত্র সর্বভারতীয় উচ্চশিক্ষার সার্ভে রিপোর্ট ২০১৮-১৯) কিন্তু এই বৃত্তিমুখী ও পেশাগত শিক্ষা প্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীদের ৭০ শতাংশেরও উপযুক্ত কাজ মেলে না! মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ৬২১৪টি ইঞ্জিনিয়ারিং ও টেকনোলজি কলেজ রয়েছে। প্রতি বছর গড়ে ১৫ লক্ষ ছাত্রছাত্রী ইঞ্জিনিয়ারিং স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে। কিন্তু এর মাত্র ২০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী তাদের পাঠ্য বিষয়ে চাকরি পেতে সক্ষম হয়। বর্তমান সরকারি হিসেব বলছে বিগত এক বছরে বেকার সমস্যা ৫০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে! সরকারি সূত্র অনুসারে বিশ্ব তথা ভারতবর্ষের বাজার অর্থনীতি ভয়াবহ সংকটের করাল গ্রাসে উৎপাদন শিল্পের বিকাশ সূচক ঋণাত্মক। কৃষিও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোচ্ছে। এমনকি পরিষেবা ক্ষেত্রের বিকাশ ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। জিডিপি একদম তলানিতে এসে ঠেকেছে। সরকারি, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার দ্রুত বেসরকারিকরণ হচ্ছে এবং বেসরকারি সংস্থায় কর্মসংস্থান ব্যাপক হারে কমছে। লে অফ, লকআউট, ছাঁটাই এবং কোনও নতুন কর্মী নিয়োগ না করার ফলে! অন্যদিকে বর্তমান শিল্পের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘পুঁজি প্রধান’ যাতে আর্থিক বিনিয়োগ প্রচুর কিন্তু ন্যূনতম কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। তাই সর্বত্রই কাজের হাহাকার।
তাই এই ভয়াবহ বেকার সমস্যা থেকে জনসাধারণের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য বৃত্তিমুখী শিক্ষার এই ঢাক পেটানো ছাড়া কোনও উপায় নেই। তদুপরি কেন্দ্রীয় সরকার এ কথা ভালোভাবেই জানে যে এই বৃত্তি শিক্ষা নিয়ে ছাত্রসমাজ ভবিষ্যতে কোনও সরকারি বা বেসরকারি চাকরি পাবে না। আবার সরকারি বা বেসরকারি লোন নিয়ে (যদিও এটা জোগাড় করা সহজ নয়) কোনও কিছু করাটাও সহজ কাজ নয়! চূড়ান্ত অর্থনৈতিক ও ব্যাবসায়িক সংকটের যুগে কিছু হাতের কাজের ট্রেনিং নেওয়া ছাত্রছাত্রীরা কর্পোরেট ও বৃহৎ পুঁজির সাথে প্রতিযোগিতা করে স্বাধীন ব্যবসা দাঁড় করাবে, তা কল্পনারও অতীত। বাস্তবতা হচ্ছে, মাটির বাসনের পরিবর্তে মানুষ ব্যবহার করে অ্যালুমিনিয়াম, স্টেনলেস স্টিল অথবা ক্রকারি। কামারের তৈরি জিনিস ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা অনেক সস্তায় দেবে। তাঁতি সস্তা মিলের কাপড়ের সাথে পেরে উঠবে না। মাটির পুতুল বা খেলনার পরিবর্তে এসেছে প্লাস্টিকের পুতুল ও চীনের সস্তার খেলনা। পুরানো ছুতোর মিস্ত্রি আধুনিক কর্পোরেট ফার্নিচার কোম্পানির সামনে টিকবে কী করে? এক কথায় বাজার অর্থনীতিতে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে ছোট হস্তশিল্পের টিকে থাকবার জায়গা নেই। দু-একটি ছোটখাটো পেশা যথা ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, প্লাম্বার বা রাজমিস্ত্রির কাজেরক্ষেত্রে যখন লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী বৃত্তিমুখী শিক্ষা নিয়ে বেরোবে তখন কাজ পাবে কোথায়? তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে আবাসন শিল্প ধুঁকছে, এটাই তো বাস্তব! গৃহস্থ বাড়িতে ক’জন কাজ পাবে? ফলে সরকার বাহাদুর ছাত্রদের বৃত্তি শিক্ষা দিয়ে বলবেন, বৃত্তি শিক্ষা নিয়েছ, এবার ‘আত্মনির্ভর’ হও! সরকারের কাছে চাকরির আশা না করে ‘করে খাও’ বা ‘চরে খাও’। এ কথা কি আমরা ভুলে যেতে পারি যে, ইতিপূর্বে স্কুলে নবম-দশম শ্রেণীতে ‘ওয়ার্ক এডুকেশন’ শিক্ষা চূড়ান্ত ব্যর্থ ও প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এ তো শিক্ষার নামে চূড়ান্ত কপটতা!
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের বৃত্তিমুখী শিক্ষার উদ্দেশ্য হল, তত্ত্বগত শিক্ষা বাদ দিয়ে বিজ্ঞান ও কলা বিষয়ে কেবল ব্যবহারিক দিকটা শেখানো। যার ফলে ছাত্রদের মধ্যে গড়ে উঠবে না সাহিত্য, বিজ্ঞান ও ইতিহাসের ঘটনাগুলিকে বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংযোজিত করে সৃজনশীল জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার কোনও সুযোগ। পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, অংকশাস্ত্র ও জীববিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ের মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও বিজ্ঞানের যে সুনির্দিষ্ট যুক্তিধারা নিহিত আছে, ন্যায়নীতিবোধ ও দর্শনকে উপলব্ধি করার প্রয়োজন আছে, তাকে যদি অস্বীকার করা হয়, তা হলে কিছু ব্যবহারিক জ্ঞান গড়ে উঠতে পারে মাত্র, কিন্তু শিক্ষাগত যে শূন্যতা সৃষ্টি হবে তাতে যুক্তিবাদী মন, প্রজ্ঞা, সামগ্রিক মানবিক গুণাবলী বা সুকুমারবৃত্তি এবং এগুলিকে ভিত্তি করে ছাত্র-ছাত্রীদের চরিত্র গঠন, কোনও কিছুই গড়ে উঠবে না। স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশে আমাদের সরকার বারবার শিক্ষাক্ষেত্রে এই প্রচেষ্টাই নিয়েছে। শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হল, মনুষ্যত্ব অর্জন, চরিত্র নির্মাণ ও জ্ঞানার্জন যা যথার্থ মানুষ গড়ে তোলে। কিন্তু নিছক বৃত্তিমুখী শিক্ষা তা দিতে পারে না। তাই মহান মানবতাবাদী বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন মার্কিন যুক্তরাষ্টে্র সেই সময় এই প্রবণতা লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘একজন মানুষকে কোনও বিদ্যার বিশেষত্বের শিক্ষা দেওয়াটাই যথেষ্ট নয়, এর ফলে সে একটি প্রয়োজনীয় যন্তে্র পরিণত হতে পারে, কিন্তু কখনোই পরিপূর্ণ বিকশিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে পারে না। মূল্যবোধ সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা এবং জীবনানুগ উপলব্ধি অর্জন করা ছাত্রদের পক্ষে অপরিহার্য। যা কিছু সুন্দর এবং নৈতিক দিক থেকে শুভ সে সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট উপলব্ধি তাকে অবশ্যই গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে তার বিশেষত্বের জ্ঞান দিয়ে সে একটা ‘সুশিক্ষিত কুকুরের’ মতই গড়ে উঠবে, সর্বাঙ্গ বিকশিত মানুষের মত নয়’। এমনকি আমাদের দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন এই ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্রদের সম্পর্কে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে বলেছিলেন,- ‘educated barbarians’ অর্থাৎ ‘শিক্ষিত বর্বর’। কেন্দ্রীয় সরকার এবারের নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-র মাধ্যমে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে শিক্ষার সামগ্রিক বৃত্তিমুখীকরন করছেন তার পরিণতিতে আগামী প্রজন্ম হয় যুক্তিহীন ‘যান্ত্রিক রোবট’ না হলে ‘সুশিক্ষিত কুকুর’ অথবা ‘শিক্ষিত বর্বর’ এ পরিণত হবে! দেশের বড় অংশের শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাপ্রেমী মানুষের মনে এই আশঙ্কাই আজ কাজ করছে। তাই ভবিষ্যৎ বংশধরদের শিক্ষার সর্বনাশের কথা ভেবে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাপ্রেমী মানুষেরা জোটবদ্ধ হচ্ছেন ‘অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটি’র পতাকাতলে।
তথ্যসূত্র ১) জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ দলিল, ২) অভিরূপ গুপ্তের নিবন্ধ -আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩) সারা বাংলা সেভ এডুকেশন কমিটি প্রকাশিত জাতীয় শিক্ষানীতি সংক্রান্ত পুস্তিকা, ৪) অধ্যাপক সংহতি মঞ্চ কর্তৃক প্রকাশিত জাতীয় শিক্ষানীতি সংক্রান্ত পুস্তিকা, ৫) আনন্দবাজার পত্রিকা ১ ডিসেম্বর ২০২০ প্রস্তুতি পৃষ্ঠা।