করোনা মহামারির মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে শারদোৎসবে বুক স্টলের মাধ্যমে আদর্শগত প্রচার জারি রাখল এস ইউ সি আই (সি)। অন্যবারের মতো হাতে হাতে বই নিয়ে মানুষকে বই কেনার অনুরোধ জানানোর উপায় ছিল না এই বছর। ছিল না বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই পৌঁছে দেওয়ার কর্মসূচি। মূলত শহর, গঞ্জ বা গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়ে সুসজ্জিত স্টলে বই সাজিয়ে কর্মীরা বসেছিলেন। সেখানেও মানতে হচ্ছিল স্বাস্থ্যবিধি, পারস্পরিক দূরত্ব। কিন্তু তাতে দলের কর্মী-সমর্থক-দরদিদের উৎসাহের অভাব ছিল না। তাঁরা নিজ নিজ এলাকার স্টল সাজিয়েছেন অতি যত্নে। কেউ কেউ পরিচয় দিয়েছেন নানা ধরনের উদ্ভাবনী শক্তির। তাঁদের চিন্তা– কঠিন এই সময়ে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে সঠিক পথের দিশা। হতাশার অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে পথ চলা মানুষকে দেখাতে হবে আশার আলো।
তার জন্য প্রয়োজন মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মহান আদর্শকে মানুষের সামনে সহজ করে উপস্থিত করা। প্রয়োজন, এই মহান আদর্শকে ভারতের বুকে বিশেষীকৃত করতে গিয়ে মহান নেতা কমেরেড শিবদাস ঘোষ যে জ্ঞানভাণ্ডার রেখে গেছেন তা মানুষের কাছে তুলে ধরা। প্রতিবছরই দেখা যায় এস ইউ সি আই (সি)-র বক্তব্যকে জানার জন্য মানুষের আগ্রহ এতটাই যে, উত্তরোত্তর দলের বইপত্রের বিক্রি বেড়েই চলে। এই বছরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। স্টলে এসে মানুষজন বই দেখেছেন, প্রশ্ন করেছেন, বিজ্ঞানের এত উন্নতির দিনে মহামারিতে এতবড় বিপর্যয় কি পুরোপুরি অনিবার্য ছিল? কী বিশ্লেষণ এস ইউ সি আই (সি)-র? জানতে চেয়েছেন সামাজিক ক্ষেত্রে, রুচি-সংস্কৃতিতে, পারিবারিক ক্ষেত্রে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে, মানুষে মানুষে সম্পর্কে যে বিষ আজ পুঁজিবাদী সমাজ ঢেলে দিয়েছে তার থেকে মুক্তির পথ কী?
কলকাতার উপকণ্ঠে নিউ টাউনে এইবার প্রথম স্টল করেছিল এস ইউ সি আই (সি)। সেখানে একসময় ছিল সিপিএমের একচ্ছত্র দাপট, পরে শাসক বদলেছে। দাপট বেড়েছে তৃণমূলের। কিন্তু দেখা গেল এতকিছুর মধ্যেও মেহনতি মানুষের লাল পতাকা উড্ডীন, আর তা ধরে রেখেছে একমাত্র এস ইউ সি আই (সি)। তাই পুরনো বামপন্থী কর্মীরা এসে বারে বারে বলে গেছেন, ভরসা আপনারাই। এক যুবক এসে বলেছেন, বাবা একসময় একটি বামপন্থী দলে ছিলেন। এখন হতাশ। আমি মার্কসবাদ জানতে বুঝতে চাই। বই দিন। বেশ কয়েকটি বই নিয়ে গেছেন। পরের দিন আবার এসছেন কমরেড শিবদাস ঘোষ রচনাবলীর সমস্ত খণ্ড নিতে। শ্যামবাজারের স্টলে এক ঝাঁক তরুণ এসে খোঁজ করেছেন স্ট্যালিন বিরোধী অপপ্রচারের জবাব সংক্রান্ত বই। খুঁজে খুঁজে যে কটি পেয়েছেন নিয়ে গেছেন। মধ্য কলকাতার তালতলাতে পুলিশ স্টল করতে বাধা দেওয়ায় স্থানীয় পুজো কমিটির কর্মকর্তা সহ সাধারণ মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছেন। পার্কসার্কাসেও দেখা গেল একই চিত্র। পুলিশের বাধা সত্ত্বেও দৃঢ়তার সাথে রুখে দাঁড়িয়ে কর্মীরা স্টল করেছেন। সারা কলকাতায় এবার হয়েছিল ৭৩টি স্টল। এছাড়াও অস্থায়ী স্টল মিলিয়ে প্রায় ১০০টি জায়গায় দলের পত্রকপত্রিকা বই বিক্রি হয়েছে।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার মৈপীঠে তৃণমূল দুষ্কৃতীরা চড়াও হয়ে স্টল ভেঙে দিলে এলাকার মানুষ রুখে দাঁড়িয়ে আবার স্টল শুরু করেন। বজবজের বাওয়ালিতে তৃণমূল দুষ্কৃতীরা স্টল গুটিয়ে নেওয়ার হুমকি দিলে স্থানীয় ক্লাবের সদস্যরা এবং দোকানদারের রুখে দাঁড়ান। পিছু হঠতে বাধ্য হয় দুষ্কৃতীরা।
বাঁকুড়ার সোনামুখীতে করোনা পরিস্থিতিতে হতাশ হয়ে ঘরে বসেছিলেন একজন পুরনো বামপন্থী দলের কর্মী। তাঁর স্ত্রী এবং মেয়ে জোর করেছেন– হতাশা কাটবে, যাও এস ইউ সি আই (সি)-এর স্টলে। জোরাজুরিতে যখন বেরোচ্ছেন স্ত্রী দিয়ে দিয়েছেন কিছু খাবার, বলেছেন ওদের খাইয়ো। তিনি স্টলে এসে আপ্লুত। বলেছেন, আমি অন্য দল করি। কিন্তু আজ বুঝলাম আপনারা কোথায় আলাদা। বুঝলাম কেন শিবদাস ঘোষের কথাগুলো মনে গেঁথে যায়। বাঁকুড়া শহরের এক বিশিষ্ট চিকিৎসক স্টলে এসে বলে গেছেন, এই মহামারির মধ্যেও মানুষকে মনোবল জোগাচ্ছে আপনাদের কাজ, আর এই বই।
মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে অষ্টমীর বিকালে বহরমপুর গ্রান্ট হলের সামনে দেখা গেল তন্ময় হয়ে বই খুঁজছেন এক যুবক। অনেকক্ষণ সময় পেরিয়ে যেতে সঙ্গী তাড়া দিচ্ছেন, কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। কমরেড শিবদাস ঘোষের রচনা ‘ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং আমাদের কর্তব্য’ বইটি দেখে তাঁর আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। একে একে তুলে নিলেন বর্তমান সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের লেখা বাম ঐক্য প্রসঙ্গে, বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে নানা বিশ্লেষণ। জঙ্গিপুরের স্টলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ তরুণ, সদ্য অ্যাডভোকেট হওয়া যুবক থেকে শুরু করে এক ঝাঁক ছাত্র বারাবার এসেছেন, বই নিয়ে গেছেন। ফরাক্কায় পুলিশি বাধার জন্য প্রধান রাস্তায় স্টল করতে না পেরে কর্মীরা সরে গেছেন বাহাদুরপুরে। সেখানে স্টল খুলতে খুলতেই ২২ জন ছাত্র ঘিরে ধরে নানা বই নিয়েছেন। ডোমকলের পুরনো সিপিএম কর্মী ওহাব সাহেব আবার বলে গেছেন বই অনেক পড়েছি, কিন্তু এবার বই কিনছি পথ চেনার জন্য। এই জেলা জুড়ে ছিল ৪৭টি বুকস্টল।
উত্তর ২৪ পরগণায় গত বছরের চেয়ে বেশি স্টল হয়েছে। কমরেড শিবদাস ঘোষের বই ছাড়াও কৃষি আইন সম্পর্কে দলের কিষাণ খেতমজদুর সংগঠনের বই, এনআরসি সমস্যা সম্পর্কে বইয়ের আগ্রহ ছিল বেশি। স্টলে অন্যান্য বাম দলের কর্মী সমর্থকরা, দলের সঙ্গে নতুন যুক্ত কমরেডরা ভাল সংখ্যায় বই কিনেছেন।
হুগলির খামারগাছিতে এক বামমনস্ক ব্যক্তি এস ইউ সি আই (সি)-র মধ্যে বামপন্থার নতুন ধারা লক্ষ করে কিছু বই নিয়ে গেছেন। বলাগড়ের বিশ্বজিৎ দাস বই নিয়ে বলে গেছেন, বুঝতে চাই এস ইউ সি আই (সি)-র সাথে অন্যান্য বাম দলগুলোর পার্থক্য কোথায়?
সারা রাজ্য জুড়েই এমন অসংখ্য অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে দলের কর্মীরা অনুভব করেছেন যথার্থ সংগ্রামী বামপন্থার জন্য মানুষের হৃদয়ের আসনটি কত যত্নে পাতা আছে। এই ভালবাসা এবং আকাঙক্ষার মূল্য দিতে বিপ্লবী রাজনীতির একাগ্র চর্চা আর জনসাধারণের দুঃখ দুর্দশা নিরসনে আপসহীন লড়াইয়ে বিপ্লবী পথ থেকে আমরা বিচ্যুত হব না– স্টল শেষে কর্মী-সমর্থকদের মনে অনুরণিত হয়েছে এই অঙ্গীকার।