আঠাশ বছর ধরে চলা বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলার রায়ে অভিযুক্ত লালকৃষর আদবানী, মুরলীমনোহর জোশী, উমা ভারতী, অশোক সিঙ্ঘল সহ ৩২ জন বিজেপি-ভিএইচপি নেতা বেকসুর খালাস পেয়ে গেলেন। মসজিদ ধ্বংসে তাঁদের প্ররোচনার কোনও প্রমাণ নাকি পাওয়া যায়নি।
প্রমাণ কাকে বলে? প্রকাশ্যে, দিনের বেলায় সংবাদমাধ্যম, পুলিশ ও প্রশাসনের ডজন ডজন কর্তার চোখের সামনে, এই সব নেতাদের প্রবল উৎসাহে ও উপস্থিতিতে লাখখানেক করসেবক গাঁইতি শাবল হাতুড়ি দিয়ে মসজিদ ভাঙল, এবং ভাঙা যে হচ্ছে তা সারা দেশের মানুষ, বিশ্বের মানুষ ভিডিও ফুটেজে দেখল, তবুও ভাঙার প্রমাণ পাওয়া গেল না? অবশ্য প্রমাণকে অপ্রমাণ করাই যখন শাসকের উদ্দেশ্য হয় তখন আর কোনও প্রমাণই যথেষ্ট প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয় না। বাস্তবে শাসক দলের নির্দেশিত এই রায় নাটক হিসাবেও অতি নিকৃষ্ট মানের, এ ছাড়া আর কিই বা বলা যায়!
আদালত নাকি মসজিদ ধ্বংসকাণ্ডে বিজেপি-ভিএইচপি নেতাদের প্ররোচনার স্পষ্ট প্রমাণ পায়নি। মসজিদ ধ্বংসের পরই কেন্দ্রীয় সরকার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এস লিবেরহানকে দিয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল। সেই কমিশন ১৭ বছর ধরে তদন্ত করে যে রিপোর্ট দিয়েছে তার ছত্রে ছত্রে বিজেপি-ভিএইচপি নেতা-নেত্রীদের প্ররোচনার প্রমাণ তুলে ধরে তাঁদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, বিচারালয় তাকে প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করল না কেন? কেন বিচারপতি লিবেরহানকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আদালতে ডাকা হল না। মসজিদ ধ্বংসের দিনই রামজন্মভূমি পুলিশ স্টেশনের সাব ইন্সপেক্টর প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে বিজেপি-ভিএইচপি নেতা-নেত্রীরা ধ্বংসকাণ্ডে যুক্ত বলে যে এফআইআর করেছিলেন, কিংবা লালকৃষ্ণ আদবানীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ফৈজাবাদের তৎকালীন এএসপি অঞ্জু গুপ্ত আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে এইসব নেতানেত্রীরা সেদিন কী ভাবে করসেবকদের প্ররোচনা দিয়েছিলেন, কী ভাবে মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর উল্লাস প্রকাশ করেছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে তার বর্ণনা দিয়েছিলেন। তবু নাকি কোনও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য পাওয়া যায়নি!
প্রকাশ্যে মসজিদের ধ্বংসকাণ্ড দেখেও উপস্থিত পুলিশ-প্রশাসন যখন হাত গুটিয়ে বসে থাকল, রাজ্য সরকার চুপ করে থাকল, কেন্দ্রীয় সরকার চুপ করে থাকল, তা আটকানোর জন্য প্রশাসনকে এতটুকু সক্রিয় করল না, প্রয়োজনে আধাসেনা নামাল না, হাজারে হাজারে করসেবক কয়েক দিন ধরে অযোধ্যায় জমায়েত হচ্ছে জেনেও মসজিদ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করল না, তখন কী ভাবে এগুলিকে পূর্বপরিকল্পনা নয় বলে উড়িয়ে দেওয়া হল? এই সব প্রতিটি ঘটনাই কি এক নিখুঁত সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অঙ্গ নয়? বিচারের রায়টিই যদি পূর্বপরিকল্পিত না হয়, এই ষড়যন্ত্র চোখে না পড়াটাই অসম্ভব। বিজেপি শাসনে ভারতে ন্যায়ের শাসন, আইনের শাসনের এই হচ্ছে চেহারা। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে বিচারপতি লিবেরহান এই রায়কে বিচারের প্রহসন বলেছেন।
দেশের মানুষ এই রায়ে এতটুকুও বিস্মিত নয় ঠিকই, কিন্তু তারা চরম লজ্জিত। সুপ্রিম কোর্ট যেদিন ভেঙে ফেলা মসজিদের জায়াগায় রামমন্দির নির্মাণের রায় দিল এবং রাম যে মসজিদের জায়গাটিতেই জন্মেছিলেন, শুধুমাত্র কিছু মানুষের বিশ্বাসকেই প্রমাণ ও যুক্তির উপর স্থান দিল, সেদিনই দেশের মানুষ বুঝে গিয়েছিলেন, মসজিদ ধ্বংসকাণ্ডে জড়িত বিজেপি-ভিএইচপি নেতাদের জন্য কোন রায় অপেক্ষা করছে। স্বাভাবিক ভাবেই দেশের মানুষের মনে এই সম্ভাবনাও দৃঢ় হয়ে উঠেছে যে অবিলম্বেই আবার কোনও বিচারপতি রাজ্যসভার সদস্য কিংবা এমনই কোনও একটি উচ্চপদে নিযুক্ত হয়ে পুরস্কৃত হবেন।
এই মামলায় তথ্যপ্রমাণ পেশে সিবিআইয়ের ব্যর্থতার অভিযোগ উঠেছে। এতগুলি বছর সময় পাওয়া সত্তে্বও সিবিআই আরও নিখুঁত ভাবে তথ্যপ্রমাণ যে পেশ করতে পারল না, তা কি শুধুমাত্র ‘খাঁচার তোতা’ হওয়ার জন্যই নয়? কংগ্রেস আমলে সর্বোচ্চ আদালতই সিবিআইকে এমন শিরোপা দিয়েছিল। তার চরিত্র যে বিজেপি শাসনেও একই রকম আছে তা তাদের এই স্বেচ্ছাকৃত অপদার্থতায় আবার প্রমাণিত হল। যারা কোনও বড় অপরাধ দেখলে সিবিআই তদন্ত চাই বলে দাবি তোলেন, আশা করা যায় এরপর তাঁরা এমন দাবি তোলার আগে নিশ্চয় পাঁচ বার ভাববেন।
সাড়ে চারশো বছরের পুরনো ঐতিহাসিক একটি মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে এই সব অপরাধীরা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রে উপর যে আক্রমণ সেদিন নামিয়ে এনেছিল তার বিচার যদি বাদও দেওয়া যায়, সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যায় রাজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ মামলার রায়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে ‘বেআইনি কাজ’ এবং ‘আইনের শাসনের গুরুতর লঙ্ঘন’ বলে যে আখ্যা দিয়েছিল, তার কোনও বিচারও এই রায়ে দেশের মানুষ পেল না। অথচ আদালত দোষীদের শাস্তি দিয়ে একদিকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নজির তৈরি করতে পারত, অন্য দিকে দেশের বিরাট অংশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষ, যারা দেশের নাগরিক হয়েও মসজিদের ধ্বংসের সময় থেকে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, তাঁদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিতে পারত। বাস্তবিক এই রায় একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক, এক অশনিসংকেত। এই ধরনের রায় একমাত্র স্বৈরতন্ত্রীদের, ক্রিমিনালদেরই– যারা আজ প্রশাসনের সর্বত্র বসে রয়েছে– শক্তিশালী করবে। এই রায় আইনের প্রতি, বিচারব্যবস্থার প্রতি দেশের মানুষের বিশ্বাসকে, আস্থাকে ধূলিসাৎ করবে।
বিচারের এই প্রহসন দেখাচ্ছে, বিজেপি শাসনে বিচারব্যবস্থা তার আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতাটুকুও কী ভাবে হারিয়ে ফেলেছে। সাধারণ মানুষের পক্ষে ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা এর ফলে ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। এই অবস্থায় সাধারণ গণতান্ত্রিক মানুষের সামনে একটিই রাস্তা খোলা থাকছে, তা হল, গণআন্দোলনের রাস্তা। সংগঠিত জনমত এবং গণআন্দোলনের প্রবল চাপই পারে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে।