ভারত থেকে আমেরিকা বিভিন্ন দেশের শাসকরা নির্বাচন নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছে। করোনা অতিমারিতে দেশে দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছেন, আরও বহু কোটি আক্রান্ত। আক্রান্তের সংখ্যায় প্রথম হওয়ার দৌড়ে ব্রাজিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় রয়েছে ভারত। অথচ প্রধানমন্ত্রী সহ দেশের শাসকদের চোখ এখন নির্বাচনের দিকে। ক্ষমতা দখল কিংবা পুনর্দখল ছাড়া আর কোনও লক্ষ্য নেই, তা সে যে প্রকারেই হোক না কেন! রাজ্যে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন, কোথাও উপনির্বাচন যে করেই হোক সেরে ফেলতে চান তারা। না হলে ‘পবিত্র’ গণতন্ত্র রক্ষা হবে কী করে? তার জন্য যত খরচ হয় হোক, ভারতের জিডিপি পিছনের দিকে যতই এগিয়ে যাক, ‘ভগবানের মার’ বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে, কিন্তু নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া চলবে না। তাতে করোনা সংক্রমণ বাড়লে বাড়বে! এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়েছিল এই করোনা পরিস্থিতিতে নির্বাচনের দিকে মন না দিয়ে সরকার কাজ হারানো, রোজগার হারানো সর্বস্বান্ত সাধারণ মানুষ ও পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করুক। বলা বাহুল্য, তাতে কর্ণপাত করেনি সরকার।
অক্টোবরের শেষে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বিহারে বিধানসভা নির্বাচন। ভোটের প্রচারে প্রধানমন্ত্রী আঞ্চলিকতাবাদকে উস্কে দিয়ে বলেছেন, বিহার হল ‘পাওয়ার হাউস অফ ট্যালেন্ট’। হঠাৎ এই সময় বিহারের ট্যালেন্ট প্রধানমন্ত্রীর চোখে পড়ল কেন? কারণ, এতে বিহারি ভাবাবেগ কাজে লাগিয়ে বিহারের মানুষের ভোট পাওয়া সহজ হবে। বিহারে তিনটি পেট্রোলিয়াম প্রকল্পের উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী নীতীশ কুমারকে বিজেপি-জেডিইউ জোটের মুখ বলে ঘোষণা করেছেন। লক্ষণীয়, এতদিন পেট্রো-প্রকল্পের কোনও ঘোষণা শুনতে পাননি মানুষ। আর ৯০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের অর্ন্তভুক্ত গ্যাস পাইপলাইন যাবে পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুর থেকে বিহারের বাঁকা পর্যন্ত। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গেও বিধানসভা নির্বাচন। তাই এই প্রকল্পে কর্মসংস্থানের ধুয়ো তুলে দু’রাজ্যেই নির্বাচন বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। অথচ এই বিজেপি সরকারই লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিপিসিএলকে বেচে দিয়েছে তেল-ব্যবসায় কর্পোরেট মালিকদের (রিলায়েন্সের ) একচেটিয়া মুনাফা করার জন্য।
তাই না খেতে পাওয়া, অপুষ্টিতে ভোগা ৩ লক্ষ শিশুর মৃত্যু দেখেও, এক বছরে ৪২ হাজারের বেশি কৃষক-দিনমজুর়কে আত্মহত্যা করতে দেখেও, কাজ হারানো কোটি কোটি বেকারের যন্ত্রণা জেনেও ‘গণতন্তে্রর উৎসব’ নির্বাচনে মেতে উঠতে কোথাও আটকায় না এ দেশের নেতা-মন্ত্রীদের। গণতন্ত্র শুধু কি ভোট দেওয়ার অধিকার? খাদ্য, কাজ, চিকিৎসা এই অধিকারগুলি কি বেঁচে থাকার তথা গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য নয়?
করোনা অতিমারিজনিত কারণে যখন লাগামহীন ভাবে ছাঁটাই চলছে সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে, রোজগারহীন মানুষ সংসার চালাতে আলু-পটল বেচতে বাধ্য হচ্ছে, উচ্চশিক্ষিত যুবকেরা ভ্যান চালিয়ে, লজেন্স বিক্রি করে দু’পয়সা রোজগারের চেষ্টায় মুখে রক্ত তুলে ফেলছে, খরচ চালাতে না পেরে বহু বাবা-মা সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন, চিকিৎসা অনেকের কাছে বিলাসিতার নামান্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন শাসক-বিরোধী ভোটবাজ সব দলগুলিই কল্পতরু সেজে ভোটের ভিক্ষাপাত্র নিয়ে ময়দানে নেমে পড়েছে। বিপুল ব্যয়ে ভোট হয়ত হবে, তার দ্বারা মানুষের জীবনের এই দুর্বিষহ অবস্থার কোনও পরিবর্তন হবে কি?
সমস্ত পুঁজিবাদী দেশেরই এক পরিস্থিতি। আমেরিকাতেও ক্ষমতায় মদমত্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসের ভান দেখিয়ে গণতন্ত্র, সংবিধান, নৈতিকতা সমস্ত উড়িয়ে দিয়েছেন এক ফুৎকারে। দেশজুড়ে বর্ণবিদ্বেষী সংঘর্ষ, মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভ বাড়ছে, করোনায় কয়েক লক্ষ মানুষ মারা গেছেন, সংক্রমিত হয়েছেন আরও অসংখ্য। তার আবহেই নির্বাচনের প্রচার চলছে বিপুল অর্থ ব্যয়ে। এত আয়োজনের ভোট না হয় হল, সকলে ভোটও দিলেন, তাতে গণতন্ত্র রক্ষা পাবে? গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে যে শাসকরা দু’বেলা চিৎকার করে চলেছে, তারা মানুষের কোন অধিকারটা রক্ষা করছে? রুটি-রুজির অধিকারটুকু পর্যন্ত দিচ্ছে না। বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে হোক, আমলাতন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে হোক, পুলিশ-প্রশাসনকে দিয়ে হোক, কেড়ে নেওয়া হচ্ছে মানুষের সব অধিকারই।
শ্রেণিবিভক্ত বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় গণতন্ত্র হল শেষ পর্যন্ত মালিক শ্রেণির গণতন্ত্র। মালিক শ্রেণির সেবাদাস সরকারগুলি তাদের পায়েই বাকি সব মানুষের গণতন্ত্রকে সঁপে দিয়েছে। শ্রমিক কিষান সাধারণ মানুষের কোনও গণতান্ত্রিক অধিকার নেই, একমাত্র ভোটাধিকার ছাড়া। তাও নিয়ন্ত্রিত হয় বুর্জোয়া প্রচারমাধ্যম, বিপুল অর্থ ও পেশিশক্তির জোরে । আর এসবই মালিকদের দখলে। তাই নির্বাচন এলেই নেতা-মন্ত্রীদের মুখে সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে বড় বড় প্রতিশ্রুতি শোনা যায়। যেমনটা শোনা গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর মুখে– ৫ লক্ষ ডলারের অর্থনীতির কথা, দু’বছরের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার কথা, বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরির কথা, আমজনতার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা দিয়ে দেওয়ার কথা। স্বাভাবিকভাবেই সেগুলির কোনওটারই হদিশ নেই। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে কবজায় রাখতে ৮০০০ পুরোহিতকে মাসিক ১০০০ টাকা করে ভাতা দেওয়ার ঘোষণা করেছেন। স্বাস্থ্য-শিক্ষা খাতে খরচের কথা উঠলেই যে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সরকারের টাকা নেই, তারা এ বাবদ খরচ করছেন মাসে ৮০ লক্ষ টাকা। এর আগে ২০১২ সালে ইমাম ও মোয়াজ্জেমদের ভাতা চালু করেছিল সরকার। ভোট বড় বালাই। কারণ ভোটই ক্ষমতার তখতে পৌঁছনোর একমাত্র রাস্তা। তাই তখতে বসতে গণতন্তে্রর ঠাঁটবাট নিয়ে টিকে থাকা নির্বাচন করতে হবে।
কিন্তু এসব ভোটবাজ দলগুলির নীতিহীনতা, চুরি, দুর্নীতিতে বিরক্ত হয়ে এদেরই এক দলের পরিবর্তে আর একটি দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে যে জনগণের জীবনের স্থায়ী দুরবস্থার কোনও পরিবর্তন হবে না– এটা স্বাধীনতার পর বহু নির্বাচনের অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে, পচে যাওয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রক্ষক হিসাবে প্রতিটি দলই দুর্নীতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। একমাত্র পুঁজিবাদী শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের দাবি নিয়ে লড়াই করা একটি দলই পারে এই সমস্ত বুর্জোয়া ক্লেদ থেকে মুক্ত থাকতে। তাই তেমন দলকেই আজ শক্তিশালী করতে, সেই লড়াইকেই শক্তিশালী করতে হবে। সেই লড়াইয়ের মধ্যেই রয়েছে জনগণের সত্যকারের স্বার্থ।