দু’বছরে এদেশে পুলিশের সাথে কৃষকদের সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ল আট গুণ! ২০১৪ সালে সরকারি নথিতে এই ধরনের সংঘর্ষের সংখ্যা ছিল ৬২৮৷ ২০১৬–তে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪,৮৩৭–এ৷ ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর দেওয়া এই সাম্প্রতিক রিপোর্টে এ দেশের গ্রামীণ কৃষকদের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ ও বিক্ষোভের আঁচ পাওয়া যায়৷ এ বছরের হিসেব ধরলে সে সংখ্যা আরও বাড়বে৷ এই বছর শুরু থেকেই ফসলের ন্যায্য দাম এবং কৃষিঋণ মকুবের দাবিতে মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, হরিয়ানা সহ বিভিন্ন রাজ্যগুলিতে ব্যাপক বিক্ষোভ আন্দোলন হয়৷ গত জুন মাসে মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌরে বিজেপি সরকারের পুলিশের গুলিতে ছয়জন কৃষকের হত্যা এবং বহু কৃষকের আহত হওয়ার ঘটনার পর সমগ্র দেশেই এই আন্দোলন উত্তাল হয়ে ওঠে, যার ফলে বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকার ঋণ মকুবের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে৷
বস্তুত কৃষকদের আন্দোলনের এই মাত্রা বৃদ্ধির শুরু পশ্চিমবঙ্গের নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরের সফল লড়াইয়ের পর থেকে৷ বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থে এসইজেড গড়ার পরিকল্পনায় কৃষকের বহুফসলি জমি কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে পরিচালিত এই আন্দোলনের ফলে নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণ থেকে তৎকালীন সরকারকে পিছিয়ে আসতে হয়েছিল এবং সিঙ্গুরের কৃষকদের জমি ফেরত দিতে হয়েছিল৷ কেন্দ্রীয় সরকারকেও তার এসইজেড নীতি পরিবর্তন করতে হয়েছিল৷
দেশ জুড়ে কৃষকদের এই ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের কারণ কী? এ দেশের গ্রামীণ জনসংখ্যার শতকরা ৯৫ ভাগই কৃষক৷ তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি, যাদের ১ থেকে ২ হেক্টরের বেশি জমি থাকে না৷ অলাভজনক এই জমিতে চাষের খরচ অনেক বেশি৷ কারণ উচ্চফলনশীল বীজ, সার, সেচের জল কোনওটাই কৃষকের নাগালের মধ্যে থাকে না৷ বিশ্বায়নের ফলে বহুজাতিক সংস্থাগুলি সার ও বীজের বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রচুর মুনাফা কামায়৷ বিদ্যুৎ ও ডিজেলের দামবৃদ্ধির ফলে সেচের জল পেতে কৃষককে অনেক বেশি টাকা গুণতে হয়৷ ফলে চাষের প্রাথমিক খরচ জোগাতে কৃষককে ঋণ করতে হয়৷ সরকারি ঋণ পাওয়ার জটিল প্রক্রিয়ার কারণে অপেক্ষাকৃত সহজলভ্য বেশি সুদের মহাজনি ঋণের দ্বারস্থ হতে হয় বেশিরভাগ চাষিকে৷ ঋণ করে চাষের এই প্রাথমিক খরচ মিটিয়ে কৃষক আশায় থাকে ফসল বিক্রি করে ধার শোধ করে সংসার খরচ জোগাতে পারবে৷ কিন্তু বীজ, সারের মতো ফসলের বাজারেও তার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই৷ সরকারি আমলা, পুলিশ প্রশাসন, ফড়েদের দুষ্টচক্র, শাসকদলের নেতাদের মদতে এই বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাই সরকার ঘোষিত ন্যায্য মূল্যে ফসল কেনার প্রক্রিয়া শুরু হতে দেরি হয়ে যায়৷ এই সুযোগে ফড়েরা কৃষকদের অভাবি বিক্রিতে বাধ্য করে৷ কৃষক নিরুপায়, কারণ যথাসময়ে ঋণ শোধ করতে না পারলে তাকে সুদ গুনতে হবে বেশি, আবার যদি খরা, বন্যা, অসময়ের বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হতে হয়, তা হলে আরও কঠিন পরিস্থিতি এসে দাঁড়ায়৷
এই যাঁতাকলে পড়ে অনন্যোপায় হয়ে অবসাদগ্রস্ত কৃষক আত্মহত্যা করে৷ গত দু’দশকে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কৃষক আত্মহত্যা করেছে৷ সংবাদে জানা যায় যে, গত দু’বছরে আত্মহত্যা বেড়েছে ২৬ শতাংশ৷ মহারাষ্ট্রে চার মাসে ৮৫২ জন কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন৷ পশ্চিমবঙ্গও বাদ যায়নি৷ গত মাসের শেষ পনেরো দিনে ৮ জন কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন শুধু বর্ধমান জেলায়৷
দেশের সব মানুষের মুখে খাদ্য জোগায় যে মানুষগুলি, তাঁদের জীবনের কোনও মূল্য নেই সরকারগুলির কাছে৷ এ ক্ষেত্রে বিজেপি শাসিত রাজ্য আর কংগ্রেস শাসিত রাজ্যের মধ্যে বিশেষ ফারাক কিছুই নেই৷ তাই ফসলের ন্যায্য দাম চাইলে বা খরা–বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা ঋণ মকুবের দাবি করলে সরকার তাদের গুলি করে মারে৷ ক্রমবর্ধমান কৃষক সংঘর্ষের এই ঘটনাগুলিকে একটা সচেতন সংঘবদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের অংশ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে দরকার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের দাবিকে অগ্রাধিকার দিয়ে আপসকামী নেতৃত্ব থেকে আন্দোলনগুলিকে মুক্ত করা৷ সঠিক নেতৃত্বে আন্দোলনের সংগ্রামী দিশা জাগাতে পারলেই হতাশা–বসাদ–জড়তা ভেঙে জঙ্গি কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠতে পারবে, যা শুধু চাষিদের জীবনে পরিবর্তন আনবে না, সমাজেরও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটাবে৷