আমাদের দেশের শাসকদের রসবোধ নেই কে বলে? না থাকলে কী আর করোনা অতিমারিতে বিপর্যস্ত দেশের সামনে ‘মন কি বাত’ বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী দুর্দশাগ্রস্ত, ক্ষুধার্ত শিশুদের খেলনা দিয়ে ভোলানোর চেষ্টা করতেন! ৩০ আগস্টের সেই অনুষ্ঠানে তিনি রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত টেনে এনেছেন এই কাজে। কিন্তু শুধু একটা কথা বলে যদি দেশকে ধন্য করতেন তিনি এই দুঃসময়ে ওই কচি পেটগুলোতে দু’টো ভাতের জোগাড়ের দিশা কোথায় পাওয়া যাবে?
বিগত ৪ মাসেই শুধু ২ কোটি মানুষ বেকার হয়েছেন। ফলে ওই সমস্ত পরিবারের শিশুরা সব প্রধানমন্ত্রীর ‘খেলনা হাবে’র জন্য হাপিত্যেশ করে আছে এই তথ্যটা কে তাঁকে দিয়েছে জানতে পারা যায়নি অবশ্য। করোনার জন্য স্কুল বন্ধ। এদিকে বাবা-মায়ের কাজ চলে যাওয়ায় তথাকথিত অনলাইন ক্লাস তাদের ধরাছোঁয়ার অনেক বাইরে। আর যে সব পরিবারে শিশুটিকেই ইট বয়ে, মাটি কেটে, হোটেলের বাসন ধুয়ে, মোট বয়ে সংসারের ক্ষুধার আগুনের রসদ জোগাতে হয়, তারা কী করছে? তারা যে আগের চেয়ে আরও কম মজুরিতে, আরও বিপদের কাজে আরও বেশি সময় ধরে কাজ করতে করতে ওই ক্ষুদ্র প্রাণটাকে শেষের দিকেই নিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী তার খোঁজ রাখেন না। শিশুশ্রম বাড়ছে। শুধু এ কথা বললে কিছুই বোঝা যাবে না হয়ত। আগে যত শিশু রোজগারের বাজারে নামতে বাধ্য হত, তাদের সংখ্যা বেড়েছে ১০৫ শতাংশ। এর মধ্যে ছেলেদের সংখ্যা বেড়েছে ৯৪.৭ শতাংশ, মেয়েদের ১১৩ শতাংশ হারে। আগে স্কুলে গেলে দুপুরে যারা দু’মুঠো খেতে পেত তাদের অভিভাবকদের হাতে স্কুল ধরিয়ে দিচ্ছে শুকনো চাল আর কিছু আলু। তাও মাসে একবার। অভাবের সংসারে ওই চালটা ফুটিয়ে দেওয়ার সময় কোথায়। সকলে মিলে যেভাবে হোক কিছু জোগাড়ের আশায় হন্যে হয়ে ঘুরছে। বাড়ছে তাই শিশুদের রোগ, অপুষ্টি। শুধু এই সময় নতুন করে দেশে ৩ লক্ষেরও বেশি শিশু মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে।
আর শিক্ষা! ওয়েস্ট বেঙ্গল রাইট টু এডুকেশন ফোরাম এবং ক্যাম্পেন এগেনস্ট চাইল্ড লেবার নামে দুটি সংগঠন লকডাউন পিরিয়ডে শিশুদের পরিস্থিতি নিয়ে সমীক্ষা করেছে। রাজ্যের ১৯টি জেলার ২১৫৪টি শিশুর মধ্যে সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, মাত্র ২৯ শতাংশ শিশু অনলাইনে শিক্ষা নিতে পারছে অর্থাৎ বাকি ৭১ শতাংশ শিশু শিক্ষাক্ষেত্রের বাইরে ছিটকে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল ভারতে জাতীয় গড় কিন্তু আরও শোচনীয়। মাত্র ১৪ শতাংশ শিশু অনলাইন ক্লাসের সুযোগ পাচ্ছে। অর্থাৎ ৮৬ শতাংশ শিশু শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না।
যাদের ঘরে একটু খাবারের সংস্থান আছে তাদের হালও ভাল নয়। ইউনিসেফের সমীক্ষা দেখাচ্ছে। একদিকে ঘরে বদ্ধ অবস্থা, অন্যদিকে ডিজিটাল পড়াশোনার নানা অসুবিধা– সাঁড়াশির চাপে তাদের ত্রাহি অবস্থা। কল্পনাপ্রবণ শিশুমন ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছে। অনলাইনে পরীক্ষা তাদের উপর আরও ভীতির সৃষ্টি করছে। অনেকের বাড়িতে বাবা-মা দু’জনে কাজে বেরোলে নেট-নির্ভর পড়াশোনায় ক্রমাগত পিছিয়ে পড়াও প্রবল চাপ তৈরি করছে শিশুদের মনে।
এই পরিস্থিতিতে বাড়ছে নাবালিকা বিয়ে। নিরুপায় বাবা-মা পরিবারের সকলের অনাহার কাটাতে নামমাত্র টাকায় পাচারকারীদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন সন্তানকে। একদিকে খাবারের অভাব, পুষ্টির অভাব, চিকিৎসাহীন অবস্থা, অন্যদিকে দমবন্ধকর পরিস্থিতিতে বেড়ে ওঠা শিশুমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভয়ঙ্করভাবে। বহু পরিবারে আর্থিক দুরবস্থার কারণে অশান্তি লেগেই রয়েছে। তারও প্রভাব পড়ে শিশুদের উপর। শারীরিক ও মানসিক দু’দিক থেকেই ভয়ঙ্করভাবে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুমন।
প্রধানমন্ত্রী কিংবা তার সরকার এই সব শিশুদের কথা ভেবেই কি হঠাৎ খেলনা হাবের খোয়াব দেখিয়েছেন? না, আসলে দেশি-বিদেশি বহুজাতিক সংস্থাগুলি এই অতিমারির সুযোগে চীনের ধাক্কা খাওয়া খেলনার বাজারটিকে নিয়ে মুনাফার নতুন রাস্তা খুলতে চায়। তাই হঠাৎ প্রধানমন্ত্রীর খেলনা প্রীতি। এ দেশের বুভুক্ষু, শ্রমের ভারে ক্লান্ত শিশুদের কাছে যা এক অতি নিষ্ঠুর রসিকতা। কত নিচে নামলে একটা সরকার এমন করে বলতে পারে সেটাই আজ মানুষকে বুঝতে হবে।