জাতীয় শিক্ষানীতি অশিক্ষা প্রসারের ব্লু-প্রিন্ট

প্রাচীন গল্প আছে, এক রাজাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি তাঁর রাজত্বের প্রতিরক্ষার জন্য কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন? রাজার জবাব, আমি প্রচুর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছি।

–কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিরক্ষার কোন কাজে লাগবে?

রাজার জবাব, মানুষ যথার্থ শিক্ষিত হলেই সচেতন হয়ে ওঠে। আর সচেতন মানুষই হল প্রতিরক্ষার সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান।

বাস্তবের রাজা অবশ্য চিরকাল ঠিক উল্টো কাজটাই করে। সেই ধারাবাহিকতা, বিশেষত জনশিক্ষার ক্ষেত্রে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি সযত্নে বহন করছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শিক্ষা সংস্কার’ নিবন্ধ শেষ করেছেন মহান রুশ সাহিত্যিক লিও টলস্টয়ের একটি বক্তব্য দিয়ে– ‘জনগণের অজ্ঞতার মধ্যেই নিহিত আছে সরকারের শক্তি। সরকার তা জানে, তাই সবসময়ই যথার্থ শিক্ষার বিরোধিতা করে’। বিজেপি পরিচালিত ভারতের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারও এই ‘যথার্থ শিক্ষা’র পথ বন্ধ করতে ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০’ এনেছে। এই নীতি তারা এনেছে আদ্যন্ত অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। এই শিক্ষা নীতি সম্পর্কে দেশের শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞদের মতামত পুরোপুরি উপেক্ষা করেছে তারা। কেন না সেই মতামতগুলি তাদের হিন্দুত্ববাদী শিক্ষাধাঁচাকে মানতে চায়নি।

এ দেশে গণতান্ত্রিক, বৈজ্ঞানিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর ১৩০তম প্রয়াণ দিবসেই কেন্দে্রর বিজেপি সরকার ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০’ দেশে চাপিয়ে দিল। এই নীতির ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক, বৈজ্ঞানিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির রেশটুকুও বিলুপ্ত হবে।

শিক্ষায় বৈজ্ঞানিক, ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি যতটুকু টিকে ছিল, তার প্রধান কারণ বিদ্যাসাগরের ঐতিহাসিক শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রভাব। স্বাধীনতা আন্দোলনের মনীষীরাও সকলের জন্য শিক্ষা, উন্নত চরিত্র গঠনের শিক্ষা চেয়েছিলেন এবং তার জন্য সোচ্চারও হয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী স্বাধীনতার পর ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় খাতায়-কলমে হলেও কিছু জনমুখী নীতি ঘোষিত হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন দেশীয় পুঁজিপতি শ্রেণি নিজেদের স্বার্থে স্বভাবতই জনগণের ‘যথার্থ শিক্ষা’ চায়নি। তাই জনশিক্ষা সম্পর্কে ভাল ভাল কথাগুলি খাতায়-কলমেই থেকেছে এবং ধীরে ধীরে খাতা থেকেও অনেকগুলি মুছে ফেলা হয়েছে।

সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের উপর ধর্মের নামে সামন্ততান্ত্রিক শোষণ-নিপীড়ন-অত্যাচারের প্রতিবাদে ইউরোপীয় নবজাগরণের মনীষীরা দাবি তুলেছিলেন, (১) শিক্ষা ব্যবস্থাকে রাখতে হবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্বের পুরোপুরি বাইরে। (২) শিক্ষার সিলেবাস হবে বিজ্ঞানসম্মত। (৩) রাষ্ট্র কোনও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করবে না। (৪) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় খরচ দেবে সরকার এবং শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হবে শিক্ষাবিদদের দ্বারা, সরকার সেখানে কোনও হস্তক্ষেপ করবে না।

দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল গণতন্ত্রের প্রধান দু’টি শর্ত হিসেবে শিক্ষা ও উন্নত চরিত্র গঠনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মিল তাঁর ‘কনসিডারেশন অন রিপ্রেজেনটেটিভ গভর্নমেন্ট’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘জনগণের জন্য সার্বজনীন ভোটাধিকার নিশ্চিত করার আগে সার্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।’

নবজাগরণের সেই উন্নত চিন্তাকে এ দেশের কুসংস্কারাচ্ছন্ন, পচাদপদ জনজীবনের প্রয়োজনে প্রয়োগ করতে গিয়ে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষীয় সর্বসাধারণ লোক বিদ্যানুশীলনের ফলভোগী না হইলে তাহাদিগের চিত্তক্ষেত্র হইতে চিরপ্ররূঢ় কুসংস্কারের সমূলে উন্মূলন হইবে না” (সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব)। এখানে বিদ্যাসাগরের শব্দপ্রয়োগ বিশেষভাবে লক্ষ করার মতো। তিনি বলছেন, ‘ভারতবর্ষীয় সর্বসাধারণ লোক’। তিনি ‘হিন্দু’ বা ‘ব্রাহ্মণ’ বলেননি। প্রসঙ্গত স্মরণীয় তাঁর অন্য বক্তব্য, ‘‘পুরাতন প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি বিশিষ্ট মানুষের চাষ উঠাইয়া দিয়া, সাতপুরু মাটি তুলিয়া ফেলিয়া নূতন মানুষের চাষ করিতে পারিলে, তবে এ দেশের ভাল হয়” (করুণাসাগর বিদ্যাসাগর)। সেই লক্ষ্যেই তিনি আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য সারা জীবন উৎসর্গ করেছেন। মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাশিক্ষার উপর খুবই জোর দিয়েছেন। স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে বয়স নয়, যোগ্যতাকে মাপকাঠি করতে বলেছেন।

অথচ ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০২০’-তে শিক্ষাকে ছেলেখেলায় পর্যবসিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে :

(১) স্কুল স্তরে (দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত) আলাদা করে সায়েন্স, আর্টস, কমার্স থাকছে না। কেউ ফিজি’ নিয়ে পড়ার সাথে সাথে ইতিহাস বা যা হোক কিছু নিয়েও পড়তে পারে। (২) উচ্চশিক্ষায় এন্ট্রি বা এক্সিটে অনেক অপশন থাকছে। যেমন, ৩-৪ বছরের গ্র্যাজুয়েশন। কেউ মনে করলেন, ১ বছর পর আর পড়বেন না। তাকে ওই ১ বছরেরই সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। ২ বছর হলে অ্যাডভান্সড ডিপ্লোমা। ব্যাচেলর ডিগ্রি ৩ বছরে। আর পুরো কমপ্লিট করলে, ব্যাচেলর উইথ রিসার্চ। (৩) ইংরেজি ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব যথাসম্ভব কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর সাথে, অনেক মিষ্টি কথার আড়ালে শিক্ষা নিয়ে আরও যা যা পরিকল্পনা সরকার করেছে তাতে শিক্ষাক্ষেত্রের স্বাধিকার পুরোপুরি বিলুপ্ত হবে। শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষাবিদদের বদলে ছড়ি ঘোরাবেন সরকারি আমলা এবং মন্ত্রী ও শাসক দলের নেতারা। তাঁরা তাঁদের প্রয়োজনে যতটুকু শিক্ষা দিতে চাইবেন তা নিয়েই খুশি থাকতে হবে ছাত্র-শিক্ষকদের। রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়তে পারে, ‘কর্তৃপক্ষ আজকাল আমাদের শিক্ষার মধ্যে পোলিটিক্যাল মতলবকে সাঁধ করাইবার চেষ্টা করিতেছেন, তাহা বুঝা কঠিন নহে। সেইজন্য তাঁহারা শিক্ষাব্যাপারে দেশীয় লোকের স্বাধীনতা নানা দিক হইতে খর্ব করিতে উদ্যত হইয়াছেন। শিক্ষাকে তাঁহারা শাসনবিভাগের আপিসভুক্ত করিয়া লইতে চান’ (শিক্ষা সংস্কার)।

শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত সমস্ত ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর কুঠারাঘাত করেছে জাতীয় শিক্ষানীতি। শিক্ষার প্রসারের নামে সরকার আদতে একই সাথে গরিব-মধ্যবিত্তের কাছ থেকে যথার্থ শিক্ষার সুযোগ কেড়ে নিয়ে কেবলমাত্র কাজ চালানোর মতো করে-খাওয়ার শিক্ষা দিয়েই বিদায় করতে চায়। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই দরিদ্র ঘরের সন্তানদের বেছে নিতে হবে ভোকেশনাল শিক্ষার কোনও রাস্তা। তারা পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকবেন। এর পাশাপাশি চলবে শিক্ষা ব্যবসার রমরমা। ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে স্থানীয় ভাষার মধ্যেই বেশিরভাগ ছাত্রকে আটকে রাখা হবে। দেশি-বিদেশি শিল্পপতিদের ব্যাপকভাবে ‘এডুকেশন ট্রেডিং’-এর ব্যবস্থা করে দিতে চাইছে। ঔপনিবেশিক আমলে রবীন্দ্রনাথের একটি বিশ্লেষণ ছিল, ‘‘প্রাইমারি শিক্ষার প্রস্তাবে কর্তৃপক্ষের নানারকম দুশ্চিন্তার লক্ষণ দেখা যাইতেছে। তাঁহারা ভাবিতেছেন খাল কাটিয়া বেনো জল ঢোকানো কাজটা ভালো নয়– শিক্ষার সুযোগে আমাদের দেশের ভদ্রলোকের ঢেউটা যদি চাষার মধ্যে প্রবেশ করে, তবে সে একটা বিষম ঝঞ্ঝাটের সৃষ্টি করা হইবে।

অতএব চাষাদের শিক্ষাকে এমন শিক্ষা করা চাই, যাহাতে মোটের উপর তাহারা চাষাই থাকিয়া যায়। তাহারা যেন কেবল গ্রামের ম্যাপটাই বোঝে; পৃথিবীর ম্যাপ চুলায় যাক, ভারতর্ষের ম্যাপটাও তাহাদের বুঝিবার প্রয়োজন নাই। তা ছাড়া তাহাদের ভাষা শিক্ষাটা প্রাদেশিক উপভাষার বেড়া ডিঙাইয়া না যায়, সেটাও দেখা দরকার” (পূর্বপ্রশ্নের অনুবৃত্তি)।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-তে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব কৌশলে ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যারা পড়বে তারা শিক্ষা কিনতে পারবে উচ্চমূল্যে। তারা ইংরেজি শিখবে ভাল ভাবে, বাকিদের জন্য থাকবে কাজ চালানোর শিক্ষা। অথচ রবীন্দ্রনাথের অভিমত, ‘…ইংরেজি শিক্ষাকে সহজ স্বাভাবিক ও সাধারণের আয়ত্তগম্য করিতে হইবে, যাহাতে শিশুকাল হইতে তাহার সার গ্রহণ করিতে পারি, যাহাতে বহুব্যয়ে ও সাংঘাতিক চেষ্টায় তাহাকে ক্রয় করিতে না হয়, যাহাতে অন্তঃপুরেও তাহার প্রবেশ সুলভ হয়” (শিক্ষার হেরফের প্রবন্ধের অনুবৃত্তি)। প্রসঙ্গত, আইনস্টাইনের একটি উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘একজন মানুষকে বিশেষত্বের শিক্ষা দেওয়াই যথেষ্ট নয়। এর দ্বারা তিনি একটি প্রয়োজনীয় যন্ত্রে পরিণত হতে পারেন, কিন্তু পূর্ণ মানুষ হয়ে গড়ে উঠবেন না। বিশেষত্বের শিক্ষা নিয়ে তিনি একটি প্রশিক্ষিত সারমেয়র সঙ্গে তুলনীয় হবেন।’

‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’-তে শিক্ষার প্রকৃত মর্মবস্তু (যেটুকু এখনও অবশিষ্ট আছে) যথাসম্ভব ছেঁটে ফেলে নিষ্ফলা রোজগারমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং উচ্চ প্রাথমিক স্তর থেকেই সে ষড়যন্ত্রের জাল ছড়াবার আয়োজন রয়েছে। এহেন ঔপনিবেশিক ধাঁচের শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধিতা করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শিক্ষার হেরফের’ আলোচনায় দেখিয়েছিলেন, ‘আমরা যে-শিক্ষায় আজন্মকাল যাপন করি, সে-শিক্ষা কেবল যে আমাদিগকে কেরানিগিরি অথবা কোনও একটা ব্যবসায়ের উপযোগী করে মাত্র, যে সিন্দুকের মধ্যে আমাদের আপিসের শামলা এবং চাদর ভাঁজ করিয়া রাখি সেই সিন্দুকের মধ্যেই যে আমাদের সমস্ত বিদ্যাকে তুলিয়া রাখিয়া দিই, আটপৌরে দৈনিক জীবনে তাহার যে কোনও ব্যবহার নাই, ইহা বর্তমান শিক্ষাপ্রণালীগুণে অবশ্যম্ভাবী হইয়া উঠিয়াছে। আমাদের শিক্ষা যেদিকে পথ নির্দেশ করিয়া দিতেছে সেদিকে সভ্যতা নামক একটি মায়াবিনী মহামিথ্যার সাম্রাজ্য। আমাদের চরিত্রের উপর তাহার সম্পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করিতে পারে না এইরূপে আমাদের শিক্ষার সহিত জীবনের গৃহবিচ্ছেদ ক্রমশ বাড়িয়া উঠে, প্রতিমুহূর্তে পরস্পর পরস্পরকে সুতীব্র পরিহাস করিতে থাকে এবং অসম্পূর্ণ জীবন ও অসম্পূর্ণ শিক্ষা লইয়া বাঙালির সংসারযাত্রা দুই-ই সঙের প্রহসন হইয়া দাঁড়ায়।’

‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০’ তে এই প্রহসনের আয়োজনই তো আরও পাকাপোক্ত ভাবে করা হয়েছে।

ইতিহাসের এইসব মূল্যবান অভিজ্ঞতা থাকা সত্তে্বও আরএসএস-বিজেপি সেগুলির কোনও মূল্য দিচ্ছে না। দেশি-বিদেশি পুঁজিপতি ও কর্পোরেট মালিক শ্রেণির স্বার্থে তারা দেশের জনগণকে অশিক্ষার অন্ধকারে ঠেলে দিতে চাইছে, দেশপ্রেমের নাম করে। শুভবোধসম্পন্ন সকলের কর্তব্য এই চরম অন্যায়ের প্রতিরোধে সক্রিয় হওয়া।