সেদিন দেখি পাড়ার চায়ের দোকানের পাশের দেওয়ালে সাঁটানো পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক সাদা চুল বৃদ্ধা৷ তাঁর দিকে তাকাতেই বললেন, কী লেখা আছে বাবা ওগুলোতে? বললাম, জিনিসের দাম যাতে কমে, সবাইকে যাতে রেশন দেওয়া হয়– সে সবের কথা৷ বললেন, আমার তো রেশন কার্ড নেই৷ তিনি কী করেন জিজ্ঞেস করায় বললেন, লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করি বাবা৷ এখন কাজ করছেন কি না জিজ্ঞেস করায় বললেন, এখন করোনার সময় সবাই তো বাড়িতে যেতে দেয় না৷ বললাম, মাইনে? বললেন, সবাই তো দেয় না, কেউবা খানিকটা দেয়৷
পাশের কয়েকটা বাড়ি পরেই থাকে একটি ঝকঝকে তরুণী৷ একটি প্রাইভেট স্কুলে পড়ান৷ নাটক করতে ভালবাসেন৷ বাবা কাজ করেন একটি প্রাইভেট সংস্থায়৷ স্কুলের চাকরি বন্ধ৷ মাইনেও৷ বাবার অফিস মালিকের বাড়িতে৷ তাই খুব প্রয়োজন না হলে ডাকেন না৷ মাইনে দিচ্ছেন অর্ধেক৷ সেদিন মেয়েটির সঙ্গে দেখা হল৷ মুখটি শুকনো৷ বললেন, দাদা, করোনা কবে থামবে বলতে পারেন৷
পরিচিত আর একটি মেয়ের খোঁজ নিতেই বলল, দাদা, আমার টিউশনগুলো সব বন্ধ৷ ভাইয়ের কাজটাও চলে গেছে৷ বাবা একটা মেয়েদের হোস্টেলে নাইটগার্ডের কাজ করত৷ হোস্টেল এখন বন্ধ৷ রোজগার বলতে শুধু মা কয়েকটা বাড়িতে এখনও কাজ করছে৷ চার জনের সংসারটা কী করে চলবে বলতে পার? বাড়ি ভাড়া দিয়ে মায়ের ওই কটা টাকায় চলে? বললাম, রেশন পাচ্ছ না? বলল, চালটা পাচ্ছি৷ কিন্তু শুধু চালে কি খাওয়া হয়? তারপর নিজেই বললে, দাদা জান, অনেক রাতে শিয়ালদার বাজারে যাই৷ যখন সবজিওয়ালারা দোকান তুলে দেয় তখন৷ খানিকটা সস্তা পাই৷ মেয়েটি থাকে বউবাজারের কাছে৷
অবশ্য সবার অবস্থাই এমন নয়৷ সব খবরও এমন নয়৷ পরিচিত এক ব্যাঙ্ক অফিসার৷ সেদিন ফোন করে জানালেন, দাদা, গাড়ি একটা বুক করে দিলাম৷ করোনার মধ্যে অফিসে যাতায়াত করতে অসুবিধা হচ্ছে৷ আমি বললাম, কী? বাইক? বললে, না, চার চাকা৷ ছবিটা হোয়াটস্যাপ করে দেবো৷ রঙটা পছন্দ হয় কি না দেখবেন৷ সংখ্যায় কম হলেও এই অংশটি রয়েছে৷ আবার, কাগজ লিখছে, লকডাউনের মধ্যেই নাকি প্রাইভেট জেট চড়ে নির্জন দ্বীপে বিলাসবহুল নিভৃতবাসে পাড়ি দেওয়ার জন্য ধনকুবেরদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে৷ ভারতেও এমন ১০০ জন মানুষ আছেন যাঁরা জাহাজ কিংবা আস্ত একটা দ্বীপ কিনেই ফেলেছেন এই লকডাউনের সুযোগে পাওয়া বাড়তি টাকায়৷
কিন্তু করোনা পরিস্থিতি জীবনে দুর্দশা নামিয়ে এনেছে, এঁদের সংখ্যাটাই তো সমাজে বেশি৷ লকডাউনের মারাত্মক ফল প্রবল আর্থিক সংকটের আকারে মেহনতি মানুষের ঘাড়ের উপর হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ছে৷ দরিদ্র মানুষ, নিম্নবিত্ত মানুষ, এমনকি মধ্যবিত্তেরও বড় অংশ এর শিকার৷ বাস্তবে সরকারগুলো, কী কেন্দ্রীয় সরকার, কী রাজ্য সরকার, রেশনে খানিকটা খুদ–কুঁড়ো ছুঁড়ে দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করে দিচ্ছে৷ জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া৷ দোকান, ছোট ব্যবসা, ছোট সংস্থাগুলি বেশিরভাগই হয় বন্ধ না হয় ধুঁকছে৷ এগুলির সঙ্গে যুক্ত কয়েক কোটি মানুষের জীবনে ঘন অন্ধকার নামিয়ে এনেছে লকডাউন৷ এই মানুষগুলোর জীবন চলবে কী করে তা নিয়ে সরকারগুলির কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই৷ অথচ এই সরকারগুলোই পুঁজিপতিদের মুনাফা কী ভাবে অটুট থাকবে, কী ভাবে তা আরও বাড়বে তাই নিয়ে চিন্তার শেষ নেই৷ এই করোনা মহামারির সময়ে যখন রোজগার হারিয়ে কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন, অর্থনীতিতে চলছে ভয়ঙ্কর মন্দা, সাধারণ মানুষ কী করে বাঁচবে, কী করে সংসার চালাবে তাই নিয়ে ভেবে কূল পাচ্ছে না, তখনও দেশের একচেটে পুঁজিপতিদের মুনাফা বেড়েই চলেছে৷ আর কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এই করোনা মহামারির সময়ে মানুষের অসহায়তার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে, প্রতিবাদ–আন্দোলন গড়ে তোলার অসুবিধাকে হাতিয়ার করে পুঁজিপতিদের জন্য দেদার দানছত্র খুলে বসেছে৷ জনগণের টাকায় তৈরি রাষ্ট্রায়ত্ত সব সম্পদ, রেল থেকে প্রতিরক্ষা, কয়লা থেকে বিদ্যুৎ, ব্যাঙ্ক থেকে টেলিকম, প্রতিরক্ষা থেকে তৈলক্ষেত্র সবই জলের দামে তুলে দিচ্ছে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের হাতে৷ অন্য দিকে শ্রমিক–কর্মচারীদের জীবনে নামিয়ে আনছে নিত্যনতুন আক্রমণ৷ কেড়ে নিচ্ছে অর্জিত অধিকারগুলি৷ বাড়িয়ে দিচ্ছে খাটনির সময়৷
এই যে কোটি কোটি সাধারণ মানুষ, সরকার যাদের দিকে এই ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে ফিরেও তাকাচ্ছে না, তাদের ভোটেই তো এমএলএ–এমপি–মন্ত্রী ক্ষমতার চূড়ায় পৌঁছেছে৷ তা হলে তারা কীসের জনপ্রতিনিধি? জনগণের প্রতিনিধি হলে তো তারা জনগণের স্বার্থই দেখত, এমন নির্লজ্জভাবে পুঁজিপতিদের স্বার্থ দেখত না৷ এই করোনা পরিস্থিতি মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে রাজ্যে রাজ্যে কিংবা কেন্দ্রের গদিতে বসে থাকা এদের কোনওটিই জনগণের সরকার নয়৷ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেই কোনও সরকার জনগণের স্বার্থ রক্ষাকারী সরকার হয় না৷ আর নানা রঙের সরকারগুলির চরিত্রের অদ্ভুত মিল এটাও স্পষ্ট প্রমাণ করে দিচ্ছে যে জনগণ ভোট দিয়ে একটা সরকারকে বদলে আর একটা সরকার আনলে সেটা জনগণের স্বার্থরক্ষা করবে, এটা সত্য নয়৷ জনগণ ভোটবাজ এই সব দলগুলির যাকেই ভোটে নির্বাচিত করুক, তাতে জনগণের স্বার্থ রক্ষিত হয় না, রক্ষা হয় শুধু পুঁজিপতিদেরই স্বার্থ৷ তা হলে জনগণের স্বার্থ কীসে রক্ষা পাবে?
ভুলে গেলে চলবে না, দেশের নিরানব্বই ভাগ সাধারণ মানুষই দেশের সমস্ত সম্পদের স্রষ্টা৷ তারাই আজ বেঁচে থাকার নূ্যনতম উপায়টুকু থেকে বঞ্চিত৷ বঞ্চিত ক্ষুধিত উৎপীড়িত মানুষের মধ্যে জমা হচ্ছে ক্ষোভের বারুদ৷ যে কোনও সময় তা সরকাগুলির বিরুদ্ধে বিস্ফোরণের আকারে ফেটে পড়বে৷ লকডাউন পরিস্থিতি মানুষকে মরিয়া করে তুলেছে৷ কোনও সাম্প্রদায়িক জিগির, যুদ্ধের জিগির, ধর্মের কোনও সুললিত বাণী মানুষের খিদেকে চাপা দিতে পারবে না৷ কিন্তু সমাজের সমস্ত সম্পদকে কুক্ষিগত করে রাখা, সমাজের সমস্ত সুবিধা ভোগ করতে থাকা শাসক শ্রেণি অত্যন্ত সংগঠিত৷ শাসনের সব যন্ত্র, প্রচারের সব যন্ত্র তাদেরই হাতে৷ তাদের থেকে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারগুলি আদায় করতে হলে শোষিত মানুষকে যেমন নিজেদেরও অত্যন্ত সুসংগঠিত ভাবে গড়ে তুলতে হবে তেমনই শাসক শ্রেণির এবং সরকারগুলির মুখোশ খুলে দিয়ে তাদের জনবিরোধী চরিত্রকে, মানুষকে বিভক্ত করার তাদের সমস্ত ষড়যন্ত্রকে দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে৷ অন্য দিকে, খাদ্য, চাকরি, জিনিসের দাম কমানো প্রভৃতি বেঁচে থাকার দাবিগুলি নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারগুলিকে বাধ্য করতে হবে দাবি মানতে৷